জাপানে মন্দিরে বুদ্ধের বাণী শোনাচ্ছে ‘রোবট দেবী’

জাপানে কয়েকশ বছরের পুরনো একটি মন্দিরে ভক্তদের সামনে বুদ্ধের দর্শন আওড়ে চলেছে এক রোবট। আশির্বাদ দেওয়ার ভঙ্গিতে দুই হাত উপরে তুলছে; কখনও দুই হাত প্রার্থনার মতো জোড় করে রাখছে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 August 2019, 04:29 PM
Updated : 15 August 2019, 05:24 PM

ক্যানন দেবীর আদলে গড়া অ্যান্ড্রয়েড রোবটটির সামনে ভক্তি জানাতে যেমন ভিড় জমছে; তেমনি মন্দিরে রোবট স্থাপনে সমালোচনারও কমতি নেই।

জাপানে অনেক বৌদ্ধ মন্দিরই ক্যানন দেবীর অর্চনার জন্য নিবেদিত। কিয়োটো শহরে চারশ বছরের পুরনো কোদাইজি মন্দিরটিও তাই। এ বছরের গোড়া থেকে এই মন্দিরে ভক্তদের সামনে হাজির হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রোবট  ‘মিন্দার’, যা  ‘ক্ষমার দেবী’ ক্যাননেরই অ্যান্ড্রয়েড রূপান্তর বলে জানিয়েছে জাপান টাইমস।

মন্দিরে আগত ভক্তদের উদ্দেশে মোলায়েম কণ্ঠে রোবটটি বলে চলে, “তুমি আত্মসর্বস্ব অহমিকার বেড়াজালে আটকে আছো। এইসব পার্থিব বাসনা সমুদ্রের অতলে তলিয়ে যাওয়া মন ছাড়া আর কিছুই না।”

বৃহস্পতিবারের একটি প্রতিবেদনে জাপান টাইমস জানিয়েছে, মন্দিরের পুরোহিত ভূমিকা নেওয়া রোবটটি কাঁধ, মাথা, হাত নাড়াতে পারে। মানুষের গায়ের চামড়ার মতো দেখাতে রোবটটির হাত, মুখ, বাহু সিলিকনে মুড়ে দেওয়া হয়েছে। রোবটের বাম চোখে বসানো হয়েছে একটি ক্ষুদ্র ভিডিও ক্যামেরা।

জেন টেম্পল এবং ওসাকা ইউনিভার্সিটির রোবটিক্সের অধ্যাপক হিরোশি ইশিগুরোর মিলিত প্রচেষ্টায় ১০ লাখ ডলার খরচে অবয়ব পেয়েছে মিন্দার। 

ভক্তদের সামনে দেবী মূর্তির বদলে রোবট উপস্থাপন নিয়ে  মন্দিরের পুরোহিত তেনশো গোতো জাপান টাইমসকে বলেন, “রোবটের সৌন্দর্য তো এটাই; এর জ্ঞান ধারণের ক্ষমতা অসীম ও আজীবন।   

“আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স দিয়ে এর জ্ঞানের পরিধি বাড়তে থাকবে, যা মানুষের সবচেয়ে সঙ্কটের সময় কাজে দেবে।”

তরুণ প্রজন্মকে ধর্মে মনযোগী করতে প্রথাগতরা যা পারেনি, এই রোবট সেই দূরত্বই ঘোচাবে বলে আশা করছেন প্রবীণ এই পুরোহিত।

তিনি বলেন, “তরুণরা মনে করে প্রার্থনা ঘর শুধু অন্তেষ্টিক্রিয়া আর বিয়ের জন্যই।”

“আমার মত পুরনো ধ্যান-ধারণার পুরোহিতের সাথে সহজ হওয়াটা কঠিনই তরুণদের জন্য; কিন্তু এই দূরত্ব ঘোচাতে এই রোবট একটি আনন্দের যাত্রা হবে। আমরা চাই, মানুষ রোবটটি দেখতে আসুক এবং বুদ্ধের সত্ত্বাকে অনুভব করুক।”

জাপানের হাজারো মন্দিরে অর্ঘ্য পাওয়া দেবী ক্যানন ৩৩ রূপে আবির্ভূত হতে পারেন বলে বিশ্বাস করেন ভক্তরা। দেবীর কোনো কোনো রূপে রয়েছে এক হাজার হাত আর ১১টি শির। 

জাপানে কোনো কোনো মন্দিরে দেবীর মূর্তি গড়া হয় পদ্মফুল হাতে, অন্য হাতের আঙুল থাকে ধ্রুপদী ভঙ্গিমায় ভাঁজ করা, যার অর্থ ভয়হীন। কোনো কোনো মন্দিরে ক্যানন আসীন হন পদ্মফুলে আর দেবীর মাথা থাকে ঘোড়ার।

ক্ষমার দেবী ক্যানন অসুস্থতা থেকে রক্ষা করেন বলে জাপানিরা বিশ্বাস করেন। আবার ক্যানন দেবী প্রাণিদের রক্ষকও বলে মানেন তারা।

সারাবিশ্বে পরিচিত ক্যামেরার নামি জাপানি ব্র্যান্ড ক্যাননের নামও এই দেবীর নাম থেকেই এসেছে।

মন্দিরে রোবট স্থাপন পর্যটকদের কাছ থেকে আয় করার কোনো কৌশল নয় বলে জানালেন পুরোহিত তেনশো গোতো। বরং এই অ্যান্ড্রয়েড রোবট মানুষকে তার কষ্ট জয় করার পথ বাতলে দেয় বলে মনে করেন তিনি।

“যারা সহযোগিতা খুঁজছে, তাদের পাশে থাকার জন্যই এই রোবট।”

মন্দিরে রোবটের মুখে বুদ্ধের বাণী শুনে দর্শনার্থী ও ভক্তদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পেয়েছে ওসাকা ইউনিভার্সিটি।

তাদের করা এক জরিপে দেখা গেছে, অনেকেই এই রোবট দেখে ও তার কথা শুনে মুগ্ধই হয়েছে।

জরিপে অংশ নেওয়া একজন বলেন, “শুরুতে আমার কিছুটা অস্বস্তিকর মনে হলেও তারপর দেখলাম এই অ্যান্ড্রয়েড রোবটকে অনুসরণ করা সহজ।”

সবাই যে রোবটটিকে স্বাগত জানাচ্ছেন এমনটাও নয়।

রোবটের মুখে কথাকে ‘কপট’ লাগছিল বলেও মন্তব্য করেছেন একজন।

জাপানিরা অ্যান্ড্রয়েড দেবীকে গ্রহণ করলেও মন্দিরে আগতদের মধ্যে বিদেশি দর্শনার্থীরা এর বিপক্ষে মত দিয়েছেন।

পশ্চিমা দর্শনার্থীরা মন্দিরে রোবটকে সায় জানাতে ইচ্ছুক নন বলে জানালেন পুরোহিত গোতো।

তিনি বলেন, পশ্চিমারা একে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের সঙ্গে তুলনা করছেন।

“তবে জাপানিদের মধ্যে রোবটবিরোধী কোনো মানসিকতা নেই। আমরা কমিকস পড়ে বড় হই যেখানে রোবটকে বন্ধু হিসেবেই পাওয়া যায়। যদিও পশ্চিমারা একটু ভিন্ন রকম করেই ভাবে।”

‘মেশিনের মন না থাকলেও’ বুদ্ধের দর্শন অনুসরণ করানোটাই এখানে মুখ্য বলে মনে করেন মন্দিরের এই পুরোহিত।

“আর সেই দর্শন কোনো মেশিন না কি লোহা না কি কোনো বৃক্ষ প্রচার করল, সেটা কোনো বিষয় নয়।”

কোদাইজি মন্দির দেবী ক্যাননের বহু রূপে আর্বিভাব হওয়ার কথা বলে।

আর সেই পথ ধরে দেবী ক্যানন এবার  ‘অ্যান্ড্রয়েড’ রূপে এসেছে বলে মনে করছে তারা।

গোতো বলেন, “আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্সের পরিসর এতটাই বিস্তৃত যে দেবীর রোবটিক রূপ ধারণকে আমাদের কাছে খুবই যৌক্তিক মনে হয়েছে।”