বেনজেমার শূন্যতা পূরণ করবে কে?

হঠাৎ করেই ফরাসি স্ট্রাইকার চলে যাওয়ায় নাম্বার নাইন পজিশন নিয়ে বিপাকে পড়ে গেছে স্পেনের সফলতম দলটি।

স্পোর্টস ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 June 2023, 08:44 AM
Updated : 5 June 2023, 08:44 AM

খুব প্রয়োজনের সময় কেউ না কেউ আড়াল ভেঙে, ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে পথ দেখায়। যেমন করিম বেনজেমা! রিয়াল মাদ্রিদে ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো থাকাকালীন ছিলেন ছায়াতলে, পর্তুগিজ মহাতারকা চলে যেতেই বেরিয়ে আসেন তেড়েফুঁড়ে। দলের আক্রমণভাগের হাল ধরেন পরম বিশ্বস্ততায়। এবার যখন সান্তিয়াগো বের্নাবেউয়ের আঙিনা থেকে বেনজেমার বিদায়ের ক্ষণ হাজির, তখন প্রশ্নটাও উঠছে- ফরাসি স্ট্রাইকারকে ছাড়া রিয়ালের সামনের পথচলাটা কেমন হবে? আপন কাঁধে কে তুলে নেবে আক্রমণভাগের মহাভার?

দিন দুয়েক আগেও এই প্রশ্ন ছিল অর্থহীন। একটু-আধটু গুঞ্জন উঠেছিল বটে, কিন্তু বেনজেমা তাতে জল ঢেলে দিয়ে বলেছিলেন, “মাদ্রিদেই তো আছি”। দলটির সমর্থকদের মন থেকেও সরে গিয়েছিল শঙ্কার পাথর। মুহূর্তেই তা ফিরে এসে চেপেও বসেছে।

রোববার বিবৃতি দিয়ে রিয়াল জানিয়ে দিয়েছে, হঠাৎ ওঠা গুঞ্জন সত্যি করে দিয়ে চলে যাচ্ছেন বেনজেমা। অবশ্য তার ভবিষ্যৎ গন্তব্য এখনও অজানা। যদিও চাউর হয়েছে সৌদি আরবের দল আল ইত্তিহাদে এক পা দিয়ে রেখেছেন তিনি।

রিয়ালকে এখন খুঁজতে হবে বেনজেমার বিকল্প, তার মতো নির্ভরতা। ২০১৮ সালে রোনালদো চলে যাওয়ার সময় বাকবদলের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে স্পেনের সফলতম দলটিকে। ওই সন্ধিক্ষণে আলোর বার্তা নিয়ে সাড়া দিয়েছিলেন বেনজেমা। ছায়া থেকে বেরিয়ে হয়ে ওঠেন রিয়ালের নির্ভরতা; ক্লাবের কিংবন্তিদের একজনও।

২০০৯ সালে তিনি ২১ বছরের টগবগে তরুণ। বাড়ির উঠানের ক্লাব লিওঁ থেকে নোঙর ফেললেন মাদ্রিদে। এক এক করে ১৪টি বছর কাটিয়েও দিলেন প্রিয় এই দলের জার্সি গায়ে জড়িয়ে।

অর্জনের শোকেস আলোকিত করেছেন পাঁচটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ৪টি লা লিগাসহ আরও অনেক ট্রফিতে। ঝলমলে পারফরম্যান্সের সুবাদে ব্যক্তিগত অর্জন ব্যালন দ’রের আলোতেও উদ্ভাসিত হয়েছেন ২০২২ সালে।

মাদ্রিদের দলটির হয়ে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৬৪৮ ম্যাচে বেনজেমার গোল ৩৫৪টি। তার চেয়ে বেশি গোল আছে কেবল রোনালদোর, ৪৫০টি। কিন্তু পরিস্থিতির বিচারে বিশেষ করে গত পাঁচ মৌসুমের গোলগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। রোনালদোর পাশে পার্শ্বনায়ক হয়ে থাকার সময়ে পেরিয়ে বেনজেমার ‘নায়ক’ হয়ে ওঠার গল্প এই সময়েই লেখা।

পরিসংখ্যানও বলছে সে কথা। রোনালদো যখন রিয়ালে ছিলেন, সেই সময়ে মৌসুম প্রতি বেনজেমার গোলের গড় ছিল ২১.৩। রোনালদোর বিদায়ের পর সেই গড় ওঠে ৩২.২-এ। এই পরিসংখ্যান পরিষ্কারভাবেই দেখাচ্ছে ফরাসি স্ট্রাইকারের সামর্থ্য, ব্যক্তিগত অর্জনের চেয়ে দলের প্রয়োজনের সময় সাড়া দিতে পারার দারুণ সক্ষমতা।

কেবল কি এতটুকুই? যখন তিনি রিয়ালের আক্রমণভাগের মূল অস্ত্র, তখনও বাকিদের ভোতা হয়ে যেতে দেননি একটুও। গত কয়েক বছরে ভিনিসিউস জুনিয়র ও রদ্রিগোর উন্নতি এবং তাদের গোল পাওয়ার পেছনের কারিগরদের একজন বেনজেমা। এ কারণেই ৩৫ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ডের নামের পাশে আছে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ১৩৮টি অ্যাসিস্টও।

এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নিলে স্রেফ গোলদাতা নয়, রিয়ালের জার্সিতে বেনজেমা স্মরণীয় হয়ে থাকবেন একজন ‘পরিপূর্ণ নাম্বার নাইন’ হয়ে। কেবল নিজে গোল করা নয়, মাঝমাঠ থেকে আক্রমণের সুর বেঁধে দেওয়া, নিঃস্বার্থভাবে গোলের সুযোগ তৈরি করে দেওয়ার কাজটি তিনি করে গেছেন বিরামহীনভাবে।

কিন্তু এই মৌসুমে বয়স আর চোটের সঙ্গে বেনজেমাকে লড়াই-সংগ্রাম করতে হয়েছে বেশ। বয়স হয়ে গেছে ৩৫ বছর; চোটের কারণে কাতার বিশ্বকাপ খেলতে পারেননি ফ্রান্সের হয়ে, লা লিগায় এ মৌসুমে শুরুর একাদশে ছিলেন মাত্র ২৩ ম্যাচ। বিশেষ করে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমি-ফাইনালে ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে বিবর্ণ পারফরম্যান্সে যেন নিজের ছায়া হয়েই ছিলেন তিনি।

রিয়ালের জার্সিতে আর সেই চেনা রূপে ফিরে আসার সুযোগ পেলেন না বেনজেমা। চলেই যাচ্ছেন সান্তিয়াগো বের্নাবেউ ছেড়ে। শোনা যাচ্ছে, বাৎসরিক ২০ কোটি ইউরোয় দুই বছরের চুক্তিতে তিনি যোগ দিতে যাচ্ছেন সৌদি আরবের দল আল-ইত্তিহাদে। ফলে নতুন মৌসুমে বেনজেমার বিকল্পের খোঁজে বের হতে হচ্ছে রিয়ালকে।

আসলে ‘অলরাউন্ডার’ বেনজেমার বিকল্প পাওয়া কার্লো আনচেলত্তির জন্য বেশ কঠিন। কিছুদিন আগে শোনা গিয়েছিল রিয়াল ছেড়ে ব্রাজিলের দায়িত্ব নিচ্ছেন তিনি। এখনও অবশ্য  রিয়ালেই আছেন তিনি।

এ মুহূর্তে হাতে যে রসদ আছে, তা নিয়েই হয়ত আনচেলত্তি চেষ্টা করবেন বেনজেমার শূণ্যতা পূরণের। মাঝেমধ্যে রদ্রিগোকে ‘ফলস নাইন’ হিসেবে খেলানোর চেষ্টা তিনি করেছেন, কিন্তু খুব একটা কাজে দেয়নি। রদ্রিগো বরং নিজের পজিশন রাইট উইংয়ে খেলতে সাচ্ছ্বন্দ্যবোধ করেন বেশি।

এদেন আজারকে এখন আর বিবেচনায় রাখার সুযোগ নেই রিয়ালের। বেলজিয়ান ফরোয়ার্ড বিপর্যয়কর চারটি মৌসুম শেষে চলে যাচ্ছেন। এই সময়ে ৭৬ ম্যাচে মাত্র ৭ গোল করা আজারের উপর আস্থা রাখার উপায় কার্যত ছিল না। তার মতো মৌসুম শেষে দলছুট হচ্ছেন মারিয়ানো দিয়াসও।

মানেটাও পরিষ্কার, বেনজেমার অভাব পূরণে রিয়ালকে দলে টানতে হবে নতুন খেলোয়াড়। শোনা যাচ্ছে বর্তমানে এস্পানিওলে খেলা স্টোক সিটি ও নিউক্যাসলের সাবেক ফরোয়ার্ড হোসেলু আছে তাদের ভাবনায়। এ মৌসুমে লা লিগা থেকে এস্পানিওল অবনমিত হয়ে গেলেও দলটির আক্রমণভাগে নিজের সামর্থ্যের জানান দিয়েছেন এই ফরোয়ার্ড; চলতি লিগে তিনি গোল করেছেন ১৬টি। কিন্তু এই স্প্যানিশের বয়স যে ৩৩!

হোসেলু আর যাই হোক বেনজেমার বিকল্প নন। বড় জোর বদলি হিসেবে খেলানোর মতো । রিয়ালকে তাই নাম্বার নাইন পজিশনে বেনজেমার উত্তরসূরি পেতে হলে আরও উঁচু মানের খেলোয়াড়ের খোঁজ করতে হবে।

চেলসির কাই হাভার্টজ, নাপোলির হয়ে সেরি আ শিরোপা জেতা ভিক্টর ওসিমেন, টটেনহ্যাম হটস্পারের হ্যারি কেইনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে রিয়াল। এদিকে ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড রবের্তো ফিরমিনো লিভারপুল ছেড়ে নতুন চ্যালেঞ্জের সন্ধানে আছেন। তিনিও হতে পারেন বেনজেমার উত্তরসূরি। তবে রিয়ালের মূল টার্গেট এক জনই-দীর্ঘদিন ধরে তারা যাকে দলে টানার প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছে, সেই কিলিয়ান এমবাপে।

যদিও গত গ্রীষ্মে অনেক আলোচনার পর প্রকাশ্যেই রিয়ালকে না বলে লিগ ওয়ানের দল পিএসজিতে থেকে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন এমবাপে। তাতে দুই পক্ষের মধ্যে কিছু ‘তিক্ততা’ জন্মে। সম্প্রতি এই ফরাসি ফরোয়ার্ড আবার জানিয়েছেন, পিএসজিতে চুক্তির মেয়াদ পূর্ণ করতে চান। ২০২৪ পর্যন্ত ফরাসি চ্যাম্পিয়নদের সঙ্গে চুক্তি রয়েছে তার। তবে বেনজেমার বিদায়ের ফলে এমবাপেকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে পারেন রিয়াল সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেস।

তবে যাই হোক না কেন, নিশ্চিতভাবে বেনজেমার রেখে যাওয়া শুন্যতা পূরণ করতে হলে রিয়ালকে এই গ্রীষ্মে নামকরা সেন্টার ফরোয়ার্ডই দলে ভেড়াতে হবে।

রিয়ালকে আসলে গুছিয়ে নিতে হবে আরও অনেক কিছু। গত দুই বছর ধরে ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তারা। দীর্ঘদিনের সারথী সের্হিও রামোস চলে গেছেন। দলছুটের তালিকায় আগেই উঠেছে রাফায়েল ভারানে, গ্যারেথ বেল, ইসকো, মার্সেলো ও কাসেমিরোর নাম। এই চেনামুখগুলোর বিদায়ে রিয়ালের বর্তমান দলটি খুব নতুন একটা ‘চেহারা’ পেয়েছে।

তাছাড়া বিদায়ের যে রাগিনী বেড়ে উঠেছে প্রবলভাবে, তা সহসা থামার সম্ভাবনা নেই। এই গ্রীষ্মে লুকা মদ্রিচের মোটা অঙ্কের বিনিময়ে সৌদি আরবের দলে যোগ দেওয়ার জোর গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। বৈচিত্রময় ফরোয়ার্ড মার্কো আসেনসিও পিএসজিতে যোগ দেওয়ার পথে। বছরের পর বছর মাঝমাঠে ছুটে চলা টনি ক্রুসের কমতে শুরু করেছে ধার।

এই জায়গাগুলোতে রিয়ালের জন্য ‘পোস্টার বয়’ হয়ে উঠছেন ভিনিসিউস, রদ্রিগো, ফেদে ভালভেরদে, এদুয়ার্দ কামাভিঙ্গাদের প্রজন্ম। বয়সে তারা বিশের কাছাকাছি কিংবা বিশ পেরুনো। আশা করা হচ্ছে, বেনজেমার শূন্যতা পূরণে যাকে দলে টানা হবে কিংবা তার সঙ্গে ইংল্যান্ডের জুড বেলিংহ্যামের মতো উঠতি তারকাকে রিয়াল দলে টানলে তাদের সঙ্গে বর্তমানদের নিয়ে কার্যকর ভারসাম্য গড়ে উঠবে।

এই ছেলেগুলোর সামর্থ্য আছে আরও অনেক বছর ধরে রিয়ালকে সেবা দিয়ে যাওয়ার। কিন্তু তারা বেনজেমার প্রভাবের কাছাকাছি আসতে এবং সেই নির্ভরতা দিতে পারবে কিনা, সেটা ভিন্ন বিষয়। প্রশ্নটাও এখানে-রিয়ালে বেনজেমার শূণ্যতা পূরণ করবে কে?