শুরু হচ্ছে মেসিবিহীন লা লিগা

দুদিন বাদে শুরু নতুন মৌসুম, নতুন চ্যালেঞ্জ। প্রাক মৌসুমে লা লিগার দলগুলো প্রস্তুতির পাশাপাশি ব্যস্ত দল গোছানোয়। সেখানে উল্টো প্রচণ্ড এক ধাক্কা খেয়েছে প্রতিযোগিতাটির দ্বিতীয় সফলতম দল বার্সেলোনা। আর্থিক দুরাবস্থা আর নিয়মের মারপ্যাচে হারিয়েছে এতদিনের কান্ডারী লিওনেল মেসিকে। তাইতো নতুন আসর শুরুর আগে ঘুরে ফিরে আসছে কিছু প্রশ্ন। মেসিবিহীন বার্সেলোনা কেমন করবে? এতবড় তারকাকে হারিয়ে লা লিগার পুরনো জৌলুসই বা থাকবে কতটা?

Md. Majharul Islamবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 August 2021, 02:01 AM
Updated : 11 August 2021, 08:49 AM

করোনাভাইরাসের কারণে দেরিতে শুরু হওয়া গত আসরের আগেও একবার মেসির ক্লাব ছাড়ার উপলক্ষ তৈরি হয়েছিল। সেবার স্বেচ্ছায় ঠিকানা বদলাতে চেয়েছিলেন, পারেননি। এবার থাকতে চেয়েছিলেন, সেটাও পারলেন না। ফুটবল বিশ্বকে চমকে দেওয়া এই দুই ঘটনার মাঝে ২০২০-২১ আসর জন্ম দিয়েছে আরও অনেক গল্পের।

নতুন লড়াই শুরুর আগে পেছন ফিরে দেখে নেওয়া যাক, নানা কারণে একটু ভিন্ন ও স্মরণীয় হয়ে থাকা স্পেনের শীর্ষ লিগের গত আসর।

লা লিগা মানেই যেন দুই ঘোড়ার দৌড়-প্রচলিত কথাটাকে ভুল প্রমাণিত করে গতবার আতলেতিকো মাদ্রিদ যে শিরোপা উৎসব করেছিল, সেটিই আসন্ন আসরকে দিয়েছে নতুন মাত্রা। বার্সেলোনা ও রিয়াল মাদ্রিদের সামনে তাই এবার শিরোপা পুনরুদ্ধারের মিশন আর গতবার নতুনভাবে নিজেদের মেলে ধরা আতলেতিকোর সামনে মুকুট ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ।

মেসির বার্সেলোনা ছাড়ার ঘোষণা, ১০ দিনের টানাপোড়েনের পর ইচ্ছের বিরুদ্ধে তার থেকে যাওয়া, বার্সেলোনা থেকে বিতাড়িত হয়ে লুইস সুয়ারেসের আতলেতিকোয় স্মরণীয় অভিষেক, ঠাসা সূচির ফুটবলে বড় দুই দলের অধারাবাহিকতা, শেষ রাউন্ডের শেষ মিনিট পর্যন্ত শিরোপা লড়াই এবং দুই জায়ান্টকে টপকে দিয়েগো সিমেওনের দলের শেষ হাসি-কী ছিল না গত মৌসুমে!

করোনাভাইরাসের কারণে ২০১৯-২০ মৌসুম দেরিতে শেষ হওয়ায় গত আসর শুরুও হয় দেরিতে। তবে মাঝের বিরতি ছিল কম। তারই মাঝে বিশ্বকে নাড়িয়ে দেয় মেসির ‘বার্সেলোনায় আর থাকব না’ ঘোষণা। অনেক নাটকীয়তার পর তৎকালীন ক্লাব প্রেসিডেন্ট জোসেপ মারিয়া বার্তামেউ মেসিকে ক্লাবে থাকতে একরকম বাধ্য করেন চুক্তির বিশেষ শর্তে উল্লেখিত সময়ের বেড়াজালে।

তবে মেসিকে ক্লাবে ধরে রাখলেও ক্লাব ছাড়তে বাধ্য করা হয় অভিজ্ঞ অভিজ্ঞ ফরোয়ার্ড সুয়ারেসকে। বন্ধুর প্রতি ক্লাবের এমন আচরণে নাখোশ ছিলেন মেসি নিজেও।

সুযোগটা কাজে লাগিয়ে তাকে দলে টেনে নেয় আতলেতিকো। সিমেওনে তখন বলেছিলেন, সুয়ারেসের মতো একজন ফরোয়ার্ডকে বার্সেলোনা ছেড়ে দেবে, তার নাকি বিশ্বাসই হচ্ছিল না। “দেখ লুইস, আমাদের এটা (লা লিগা) জিততে হবে, আর তুমিও সেটাই চাও।” সুয়ারেসকে ক্লাবে ভেড়াতে এভাবেই উজ্জীবিত করেছিলেন সিমিওনে।

সেবারের দলবদলের বাজারে বলা যায় নীরবই ছিল রিয়াল; তারকা কোনো খেলোয়াড়কেই দলে ভেড়ায়নি দলটি। পুরনোদের ওপর ভরসা রাখেন কোচ জিনেদিন জিদান।

আসরের শুরু থেকেই স্পেনের সফলতম দুই দলকে পেছনে ফেলে দেয় আতলেতিকো। রক্ষণাত্মক ফুটবলের জন্য পরিচিত সিমেওনের দল খেলতে শুরু করে আক্রমনের পসরা সাজিয়ে। তাতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন সুয়ারেস। দুইয়ের মিশেলে মৌসুমের প্রথম ভাগে ১৯ ম্যাচে শেষে ৫০ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষে ছিল মাদ্রিদের দলটি।

সেই পর্যায়ে তাদের চেয়ে একটি করে ম্যাচ বেশি খেলে ১০ পয়েন্ট পেছনে ছিল রিয়াল ও বার্সা।

রিয়াল লিগের শুরুটা ভালো করলেও ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেনি। বছরের শুরুতে পাঁচ ম্যাচের মাত্র দুটিতে জয় নগর প্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে শিরোপার লড়াইয়ে তাদের পেছনে ফেলে দেয়।

অন্যদিকে, শুরু থেকেই ছন্দে ছিল না বার্সেলোনা। ক্লাব ছাড়তে চাওয়া সেই মেসিই দলের কান্ডারীর ভূমিকা নেন। তাকে যোগ্য সমর্থন দিচ্ছিলেন উঠতি তারকা আনসু ফাতিকিন্তু চোটের কারণে ফাতি ছিটকে যাওয়ার পর ম্রিয়মাণ আক্রমণভাগ ভোগাতে শুরু করে দলটিকে, যা মেসির একার পক্ষে সামলানো সম্ভব হয়নি।

মৌসুমে প্রথম ভাগে আতলেতিকোর দাপট, অন্য দুই দলের অধারাবাহিকতায় মনে হচ্ছিল খুব সহজেই লিগ জিততে যাচ্ছে সিমেওনের শিষ্যরা। কিন্তু মাঝপথে বদলে যায় চিত্র; একদিকে আতলেতিকো পয়েন্ট খোয়াতে থাকে আর আরেকদিকে রিয়াল ও বার্সেলোনার সঙ্গে শিরোপার লড়াইয়ে যুক্ত হয় সেভিয়াও।

এক নজরে লা লিগা ২০২০-২১: 

চ্যাম্পিয়ন: আতলেতিকো মাদ্রিদ 

রানার্সআপ: রিয়াল মাদ্রিদ 

‘পিচিচি’ ট্রফি (সর্বোচ্চ গোল): লিওনেল মেসি 

জারা ট্রফি (স্প্যানিশ সর্বোচ্চ গোলদাতা): জেরার্ড মরেনো

জামোরা ট্রফি (সেরা গোলরক্ষক): ইয়ান ওবলাক 

পাঁচ রাউন্ড বাকি থাকতে পয়েন্ট টেবিলের চিত্রটা ছিল এমন: আতলেতিকো মাদ্রিদ ৭৩ পয়েন্ট, রিয়াল মাদ্রিদ ৭১ পয়েন্ট, বার্সেলোনা ৭১ পয়েন্ট, সেভিয়া ৭০ পয়েন্ট।

তবে শেষ দুই রাউন্ডে মূলত মাদ্রিদের দুই ক্লাবের মধ্যে লড়াইটা জমে ওঠে। শেষ রাউন্ডের আগে সমীকরণটা ছিল এমন-আতলেতিকো জয় পেলে লিগের শ্রেষ্ঠত্ব তাদের। আর তারা হেরে গেলে এবং রিয়াল নিজেদের ম্যাচে জয় পেলে জিদানের দল উঁচিয়ে ধরবে শিরোপা।

শেষ পর্যন্ত আর কোনো নাটক হয়নি। দুই দলই নিজ নিজ ম্যাচে জয় তুলে নেওয়ায় প্রত্যাশিতভাবেই চ্যাম্পিয়ন হয় আতলেতিকো মাদ্রিদ। চোখের জলে শিরোপা উদযাপন করেন সুয়ারেস, যে অশ্রুতে মিশে ছিল আবারও নিজেকে সেরা পর্যায়ে প্রমাণের স্বস্তি ও আনন্দ।

লিগে ২১ গোল করে দলকে জেতানোর পাশাপাশি বার্সেলোনাকে জানিয়ে দেন, এখনও ফুরিয়ে যাননি তিনি।

মৌসুম দেরিতে শুরু হওয়ায় গড়ে প্রায় তিন দিন অন্তর অন্তত ম্যাচ খেলতে হয়েছিল প্রতিটি দলকে। অতিরিক্ত চাপ প্রভাব ফেলেছিল খেলোয়াড়দের ফিটনেসে; স্বাভাবিকের তুলনায় চোটের ঘটনা ছিল  অনেক বেশি।

এতে সবচেয়ে বেশি ভুগেছে রিয়াল। এরপরও উভয় ক্লাসিকোতেই বার্সেলোনাকে হারানো এবং তাদের পেছনে ফেলে দুইয়ে থেকে মৌসুম শেষ করাটা কিছুটা হলেও স্বান্তনা দিয়েছে সমর্থকদের।

টানা দ্বিতীয় মৌসুম লিগ জিততে ব্যর্থ বার্সেলোনার একমাত্র আশার আলো হয়ে ছিলেন মেসি। ৩০ গোল ও ১১ টি অ্যাসিস্ট করেন তিনি। জিতে নেন রেকর্ড অষ্টমবারের মতো লা লিগার সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার, পিচিচি ট্রফি।

শীর্ষ তিন দলের বাইরে সেভিয়া ছাড়া অন্য কোনো দল তেমন চমক জাগাতে পারেনি। ৭৭ পয়েন্ট নিয়ে চারে থেকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে জায়গা করে নেয় দলটি।

তুমুল প্রতিদ্বন্দিতার পর যথাক্রমে পাঁচ ও ছয়ে থেকে ইউরোপা লিগে সরাসরি সুযোগ পায় রিয়াল সোসিয়েদাদ ও রিয়াল বেতিস।

পয়েন্ট টেবিলের শেষ তিনে থেকে অবনমন হয় ওয়েস্কা, রিয়াল ভাইয়াদলিদ ও এইবারের। তাদের জায়গায় উঠে এসেছে এসপানিওল, রিয়াল মায়োর্কা ও রায়ো ভায়েকানো।

আগামী শুক্রবার মাঠে গড়াবে ২০২১-২২ লা লিগা। উদ্বোধনী ম্যাচে গেতাফের বিপক্ষে ঘরের মাঠে খেলবে ভালেন্সিয়া।

পরদিন আলাভেসের মাঠে খেলবে রিয়াল মাদ্রিদ। এরপর দিন মাঠে নামবে আতলেতিকো ও বার্সেলোনা। সেল্তা ভিগোর বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে অভিযান শুরু করবে চ্যাম্পিয়নরা আর বার্সেলোনা খেলবে ঘরের মাঠে রিয়াল সোসিয়েদাদের বিপক্ষে।

আসছে আসরে শুধু বার্সেলোনাই শক্তি হারায়নি, তারকা খেলোয়াড় হারিয়েছে রিয়ালও। তাদের গত পাঁচ বছরের অধিনায়ক এবং রক্ষণের বড় ভরসা সের্হিও রামোস চুক্তি শেষে ফ্রি ট্রান্সফারে চলে গেছেন। দুজনই যোগ দিয়েছেন ফ্রান্সের পিএসজিতে।

তবে লা লিগা শুরুর আগে ঘুরে ফিরে আসছে মেসির দলবদলের খবর। প্রতিযোগিতাটির ইতিহাসের রেকর্ড গোলদাতাকে ছাড়া স্পেনের শীর্ষ এই লিগ অনেকটাই তার রং হারাবে বলে অভিমত অনেকের। বড় ক্ষতি বার্সেলোনার জন্যও; গত মৌসুমের অনেকটা সময় ভোগা দলটি যে ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছিল এই তারকার কাঁধে ভর করেই।