সাফল্যের রাজা কাফুর পঞ্চাশ

ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে। পরে হয়ে যান ডিফেন্ডার। অনেকের মতে, সর্বকালের সেরা রাইট-ব্যাক তিনি। ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের অন্যতম সফল তারকা কাফুর অর্জনের ভাণ্ডারে কমতি নেই। কী জেতেননি তিনি; দুটি করে বিশ্বকাপ ও কোপা আমেরিকা, একবার উঁচিয়ে ধরেছেন ফিফা কনফেডারেশন্স কাপ। ক্লাব ফুটবলেও তার সাফল্য আকাশছোঁয়া; সাও পাওলোয় সব জয়ের পর রোমাকে জেতান ইতালিয়ান সেরি আ। এসি মিলানের হয়ে পেয়েছেন লিগের পাশাপাশি উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের স্বাদ।

স্পোর্টস ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 June 2020, 09:58 AM
Updated : 7 June 2020, 12:31 PM

ইতিহাসের একমাত্র ফুটবলার হিসেবে খেলেছেন তিনটি বিশ্বকাপের ফাইনাল। দিয়েছেন ২০০২ কোরিয়া-জাপান বিশ্বকাপ জয়ে দেশকে নেতৃত্ব, ব্রাজিলের সবচেয়ে বেশি ১৪২টি ম্যাচ খেলার রেকর্ডধারী কাফু রোববার পূর্ণ করলেন জীবনের ইনিংসের হাফ-সেঞ্চুরি। বিশেষ দিনে ফিফাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। তার উল্লেখযোগ্য কিছু অংশ তুলে ধরা হলো বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পাঠকদের জন্য।

১৯৯৪ সালের যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপে ফাইনালের আগে মাত্র দুটি ম্যাচে কিছুক্ষণের জন্য বদলি নামার সুযোগ পেয়েছিলেন। সেখানে শিরোপা লড়াইয়ের মঞ্চে রবের্তো দোনাদোনিকে মার্কিংয়ে রাখার দায়িত্ব দেওয়া হয় আপনাকে। কোচ কার্লোস আলবের্তো পেরেইরা যখন আপনাকে বেঞ্চ থেকে মাঠে নামতে বললেন, তখন আপনার মাথার মধ্যে কি ভাবনা খেলা করছিল?

কাফু: জর্জিনিয়োর জন্য আমার খারাপ লাগছিল। একই সময়ে বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলার সুযোগ পেয়ে খুব ভালোও লাগছিল। ভীষণ রোমাঞ্চকর একটা মুহূর্ত ছিল। আমি প্রস্তুত ছিলাম। যদি তেমন কোনো পরিস্থিতি আসে, সেক্ষেত্রে মানসিক ও শারীরিকভাবে আমি বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলতে প্রস্তুত ছিলাম।

(ইতালির বিপক্ষে ফাইনালে নির্ধারিত ও অতিরিক্ত সময় গোলশূন্য ড্রয়ের পর টাইব্রেকারে ৩-২ গোলে জিতেছিল ব্রাজিল। সেটি ছিল তাদের চতুর্থ বিশ্বকাপ শিরোপা।)

ছবি: ফিফা

বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার অনুভূতি কেমন ছিল?

কাফু: খুশির সীমা ছিল না। মিশন সফল হওয়ার অনুভূতি, চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আনন্দ। আমরা হোটেলে ফিরেও সবাই উদযাপন করেছিলাম। কেউ তার পরিবারের সঙ্গে, কেউ তাদের বন্ধুদের সঙ্গে। কয়েকজন গিয়েছিল নৈশভোজে, কেউ-বা পানশালায়। আমরা সবাই উচ্ছ্বসিত ছিলাম। অভাবনীয় রোমাঞ্চকর এক অনুভূতি।

সেই বিশ্বকাপে আপনার মতে ব্রাজিলের সেরা খেলোয়াড় কে ছিল?

কাফু: ব্রাজিল দারুণ খেলেছিল। আমার মতে, দল হিসেবে খেলতে পারাটাই আমাদের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন করেছিল। তবে তাফারেল (গোলরক্ষক) ছিল অসাধারণ, সত্যিই অসাধারণ। টুর্নামেন্টে জুড়ে সে দুর্দান্ত খেলেছিল, এবং ফাইনালে সে একটা পেনাল্টি ঠেকিয়েছিল। তাই আমার কাছে সে ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আলদাইর ও মার্সিও সান্তোসও ভালো খেলেছিল, রোমারিও ও বেবেতো গোল করেছিল; কিন্তু আমার কাছে তাফারেল ছিল অবিশ্বাস্য।

১৯৯৭ সালে রোমারিও ও রোনালদো মিলে ব্রাজিলের হয়ে ৩৪ গোল করেছিল। দেশের কোপা আমেরিকা ও ফিফা কনফেডারেশন্স কাপ জয়ে রেখেছিল গুরুত্বপূর্ণ অবদান। তাদের জুটিটি কেমন ছিল?

কাফু: (এক মুহূর্তের বিরতি নিয়ে) ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা জুটি। কোনো সন্দেহ নেই। অসাধারণ দুই ফুটবলার, যারা একসঙ্গে দুর্দান্ত মানিয়ে নিয়েছিল।

ছবি: ফিফা

১৯৯৮ বিশ্বকাপ ফাইনালে ব্রাজিলকে হারিয়ে দিয়েছিল ফ্রান্স। দল দুটি যদি ১০ বার মুখোমুখি হতো, তাহলে ফলাফল কি হতো বলে মনে হয়?

কাফু: আমার মনে হয়, ফ্রান্স পাঁচবার জিতত আর আমরা পাঁচবার। ওই বিশ্বকাপে আমরা দুই দলই দারুণ ফর্মে ছিলাম। অসাধারণ দুটি দল ছিল। সব দিক বিবেচনাতেই আমরা শক্তিশালী ছিলাম এবং দুদলেরই খেলা পাল্টে দেওয়ার মতো খেলোয়াড় ছিল। আমার মনে হয়, উভয় দলই পাঁচটি করে জয় পেত।

ফ্রান্সের সেই দলে একজন ছিল জিনেদিন জিদান, যে ফ্রান্স ১৯৯৮ ও জার্মানি ২০০৬ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের স্বপ্ন ভেঙেছিল। তার ফুটবল সামর্থ্য নিয়ে আপনার অভিমত কি?

কাফু: আমার দেখা অন্যতম সেরা ফুটবলার, কৌশলগত ও শারীরিকভাবে। ফুটবলে তার দূরদর্শিতা ছিল অসাধারণ। তার চিন্তা করার সামর্থ্য, পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রতিক্রিয়া দেখানো ও তা কার্যকর করার দক্ষতা চমৎকার। দারুণ বুদ্ধিমত্তায় সে মাঠে পজিশন নেয়। সে এককথায় দুর্দান্ত।

২০০২ কোরিয়া-জাপান বিশ্বকাপ ফাইনালের আগে চেঞ্জিং রুমে থাকার সময় কি ফ্রান্স ১৯৯৮ ফাইনালের কথা মাথায় এসেছিল? বিষয়টি না ভাবার চেষ্টা করছিলেন?

কাফু: সত্যি বলতে, ৯৮-এর কথা ভাবিনি আমরা। আমাদের পেশাদারিত্ব আগের ওই বিষয় নিয়ে না ভাবতে সাহায্য করেছিল। আমরা অভিজ্ঞ খেলোয়াড় ছিলাম এবং আমাদের মনোযোগ ছিল জার্মানির ওপর।

ট্রফি উঁচিয়ে ধরার অনুভূতি কেমন ছিল?

কাফু: অভাবনীয়। কি একটা মুহূর্ত ছিল! মিশন সফল করতে পারাটা ছিল চমৎকার। পুরো বিশ্ব আমার ট্রফি উঁচিয়ে ধরা দেখছে, অনুভূতিটা ছিল বর্ণনাতীত। আমি আমার পরিবার-আত্মীয়দের খুশি করতে পেরেছি, এটার ভালোলাগা ছিল অবিশ্বাস্য। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়াটা খুব বিশেষ কিছু, অসাধারণ।

২০০২ বিশ্বকাপের আগের দুই বছরে রোনালদো খুব কম ম্যাচ খেলেছিল। তারপরও বিশ্বকাপের মঞ্চে তিনি যেমন খেলেছিলের, আপনার কি সত্যিই বিশ্বাস ছিল যে তিনি অমনটা পারবেন?

কাফু: চোট কাটিয়ে ওঠার ক্ষমতায় রোনালদোর জুড়ি ছিল না। তার সামর্থ্য নিয়ে আমাদের মনে কোনো সন্দেহ ছিল না। সে ইতিহাসের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়, একজন ফেনোমেনন। তার এই ডাকনামই সব বলে দেয়।

ছবি: ফিফা

ক্যারিয়ারের শুরুতে আপনি অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে খেলতেন। ওই পজিশনে থাকলে ক্যারিয়ারটা কেমন হতো বলে মনে হয়?

কাফু: (হাসি) জানাটা অসম্ভব। তবে জানতে পারলে বেশ হতো। হয়তো বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় হতাম। তবে ডিফেন্ডার হিসেবে যতটা ভালো করেছি, ততটা হয়তো হতো না। কিন্তু মাঝমাঠে খেলতে আমার ভালো লাগতো। মাঝমাঠে সবসময় বলে চোখ থাকে, পুরো ম্যাচেই অংশগ্রহণ করা যায়।

ট্রেন্ট অ্যালেকজান্ডার-আর্নল্ডকে আপনার সঙ্গে তুলনা করা হয়। তার বিষয়ে আপনার কি মনে হয়?

কাফু: (লিভারপুলের ইংলিশ ডিফেন্ডার) সে দারুণ খেলোয়াড়, বিরল প্রতিভা। যেভাবে সে খেলছে, এভাবেই খেলতে থাকলে বিশ্বের অন্যতম সেরা হিসেবে বিবেচিত হবে। ফিফা বর্ষসেরা খেলোয়াড় হওয়ার যোগ্যতা তার আছে। কৌশলগত দিক থেকে সে দারুণ মেধাবী। তার অনেক গুণ আছে। তার খেলার ধরণ চমৎকার। তার খেলা দেখতে আমার ভালো লাগে। আর অমন দারুণ এক দলে খেলাটা তার বেড়ে ওঠায় সাহায্য করবে।

ইতালিতে আপনাকে ‘ইল পেনদোলিনো’ (দা এক্সপ্রেস ট্রেন) নামে ডাকা হতো। এত শক্তি ও মনোবল কোথায় পেতেন?

কাফু: প্রথমত, ফুটবল খেলাটাই দারুণ আনন্দের। আমি ফুটবল ভালোবাসি। আমি যা করি, তাই ভালোবাসি। মাঠে নামায় যদি ভালোলাগা থাকে, তাহলে দৌঁড়ানো সহজ হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, আমি সবসময় আমার ফিটনেসের উন্নতি করতে চাইতাম। যতটা সম্ভব সেরা ফুটবলার হতে এবং সর্বোচ্চ ফিট থাকতে চাইতাম।    

ক্যারিয়ার জুড়ে কোন খেলোয়াড়কে মার্ক করা সবচেয়ে কঠিন মনে হয়েছে?

কাফু: রোনালদিনিয়ো। সে খুব আনপ্রেডিক্টেবল ছিল। সে এমন কিছু করতে পারতো, যা আপনি কল্পনাই করবেন না। তাকে মার্ক করা ছিল প্রায় অসম্ভব।

ছবি: ফিফা

এক দশকের বেশি সময় ধরে ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কার দখল করে আছে লিওনেল মেসি ও ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো। তাদের মধ্যে আপনি কাকে সেরা ভাবেন?

কাফু: আমরা বিশ্ব ফুটবলের দুই শক্তি নিয়ে কথা বলছি। ১৫ বছর ধরে তারা শীর্ষে অবস্থান করছে। একজন জিতেছে ছয়বার, অন্যজন পাঁচবার। তাদের মধ্যে থেকে একজন বেছে নেওয়াটা কঠিন। দুজনই চমৎকার ফুটবলার।

আগামীতে বর্ষসেরা ফুটবলার হওয়ার সামর্থ্য কার আছে?

কাফু: নেইমার। আমার মতে, বিশ্ব সেরা হওয়ার জন্য সবকিছুই তার আছে।

আপনি কি মনে করেন, ব্রাজিল ২০২২ কাতার বিশ্বকাপে বিশ্বসেরার মুকুট পুনরুদ্ধার করবে?

কাফু: আমি তাই মনে করি। সেলেকাওয়ের কথা এলেই আমি ভীষণ আশাবাদী হয়ে উঠি। আমি নিশ্চিত, ব্রাজিলের দারুণ বিশ্বকাপ কাটবে। আমাদের নেইমার আছে। আরও অনেক ভালো, অভিজ্ঞ খেলোয়াড় আছে। বেশ কিছু তরুণ সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়ও আসছে।

সবশেষে, কোচ হওয়ার ভাবনা আছে?

কাফু: হয়তো, ২০২২ সালের পর। কাতার ২০২২ এর শুভেচ্ছাদূত আমি। তাই, এর আগে তো সম্ভব নয়। তবে, এরপর কোচ হওয়ার বিষয়ে আমি ভাবতে পারি। নিশ্চিত নয়। ফুটবলে অনেক বছর ধরে পাওয়া শিক্ষা অন্যের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়াটা দারুণ হবে।