বিদেশিরাও যোগ দিয়েছিল আলফাজদের উদযাপনে

আসরের হিসেবে ৭টি, আর সময়ের হিসেবে প্রায় দেড় দশক। দীর্ঘ সেই অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে এসএ গেমসের ফুটবলের অধরা সোনার পদকের স্বাদ পেয়েছিল বাংলাদেশ। নেপালের দশরথ রঙ্গশালা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের উচ্ছ্বাস তাই ছিল বাঁধভাঙা। এরপর উদযাপনের ঢেউ আছড়ে পড়ল টিম হোটেলে। এবার বাংলাদেশের উৎসবে সামিল বিদেশিরাও! ১৯৯৯ এসএ গেমস ফুটবলের সোনা জয়ের নায়ক আলফাজ আহমেদ স্মৃতির সাগরে ডুব দিয়ে তুলে আনলেন আরও মণি-মুক্তা।

মোহাম্মদ জুবায়েরমোহাম্মদ জুবায়েরবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 May 2020, 06:37 AM
Updated : 13 May 2020, 06:37 AM

করোনাভাইরাস প্রকোপের এই অস্থির সময়ে দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে (এসএ গেমস) সোনা জয়ী অ্যাথলেটরা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে শোনাচ্ছেন তাদের স্মৃতিময় দিনগুলোর গল্প। আলফাজ ফিরে তাকালেন ২১ বছর আগে নেপালের কাঠমান্ডুর সেই আলো ঝলমল দিন আর উচ্ছ্বাস-উৎসবে ভরা রাতে।

সেবারও ফুটবলের শুরুটা হয়েছিল একরাশ শঙ্কা নিয়ে। মালদ্বীপের কাছে প্রথম ম্যাচের প্রাপ্তি ছিল ২-১ গোলে হার। এরপর অধিনায়ক জুয়েল রানার একমাত্র গোলে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে সেমি-ফাইনাল এবং শাহাজউদ্দিন টিপুর গোলে ‘ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন’ ভারত বধ করে ফাইনালের মঞ্চে উঠেছিল দল। স্মৃতির পাতা ওল্টাতে গিয়ে আলফাজের মনে পড়ে মালদ্বীপ ম্যাচের হারের জন্য ক্যাসিনোতে যাওয়ার অভিযোগের কথা।

“মালদ্বীপের কাছে হারের পর বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখি হয়েছিল অনেক। অভিযোগ উঠেছিল, আমরা নাকি ওই ম্যাচের আগে ক্যাসিনোতে গিয়েছিলাম! বিষয়টা জেনেছিলাম বাড়িতে ফোন করার পর। কিন্তু আমি তো জানতামই না ক্যাসিনো কী!”

“এরপর জুয়েল-জনি ভাইদের জিজ্ঞেস করি, ক্যাসিনো আসলে কি? তারাও বলেন, ‘আমরাও তো কোনো দিন যাইনি, কিন্তু শুনেছি এটা নাকি টাকা দিয়ে জুয়া খেলার মতো কিছু একটা।’ আমি ভাবি, ক্যাসিনোর নামই শুনলাম কাল, কোনোদিন সেখানে যাইনি; অথচ লেখা হয়ে গেলো সেখানে গিয়েছিলাম! সারারাত এটা নিয়ে অনেক হাসাহাসিও হয়েছিল।”

সেমি-ফাইনাল পর্যন্ত বাংলাদেশের করা তিন গোলের মধ্যে দুটি ডিফেন্ডার জুয়েলের। একটি ‘সুপার সাব’ তকমা পেয়ে যাওয়া স্ট্রাইকার টিপুর। দলের মূল স্ট্রাইকার আলফাজ ও মিজানুর রহমান ডন তখনও গোলহীন। ক্লাব পর্যায়ে মোহামেডান স্পোর্টিং, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র, ব্রাদার্স ইউনিয়নে খেলা আলফাজ ফিরে যান স্নায়ুর চাপে থাকা দিনগুলিতে।

“দলে আমি আর ডন ছিলাম মূল স্ট্রাইকার। কিন্তু সেমি-ফাইনাল পর্যন্ত আমাদের দুজনের কারো গোল নিয়ে। তিন ম্যাচ হয়ে গেলো কিন্তু স্ট্রাইকার কেন গোল নেই….আলোচনা, সমালোচনা শুরু হলো। অনেকের অনেক কথা। আমিও খুব টেনশন অনুভব করতে লাগলাম।”

এলো ৪ অক্টোবর। স্বাগতিক নেপালের সমর্থকদের ঢল নেমেছিল দশরথের গ্যালারিতে। কিন্তু ৪৪তম মিনিটে তাদের স্তব্ধ করে দিলেন আলফাজ। মতিউর মুন্নার কর্নার থেকে চোখের পলকে জাল খুঁজে নিয়ে। ওই এক গোলেই লেখা হয়ে গেলো বাংলাদেশের প্রথম সোনা জয়ের গল্প। আলফাজও পেয়ে যান সমালোচনার জবাব দেওয়ার সুযোগ।

“মুন্না কর্নার করল। ওর কর্নারের পর এদিক-ওদিক হয়ে জটলার মধ্যে আমার সামনেই এসে পড়ল বল। আমি জালে জড়িয়ে দিলাম। ওই গোলেই শেষ পর্যন্ত জিতলাম। সবাইকে মজা করে পরে বলেছিলাম, ‘সব ম্যাচে তো আর গোল করতে হবে এমন তো কথা নেই! একটা গোলে যদি জয় পাওয়া যায়, সেটাই তো মূল্যবান, তাই না (হাসি)!”

ওই টুর্নামেন্টে ঘটেছিল আরও অনেক ঘটনা। মালদ্বীপের কাছে জাতীয় দলের প্রথমবারের মতো হারার পর টিম ম্যানেজমেন্টের এক কর্মকর্তার সঙ্গে খেলোয়াড়দের হয়েছিল প্রচণ্ড বাদানুবাদ। রাগ করে টিম মিটিং ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন কোচ সামির শাকির। পরিস্থিতি ঠাণ্ডা করতে দেশ থেকে নেপালে উড়ে গিয়েছিলেন সাবেক তারকা ও বাফুফের কর্মকর্তা বাদল রায়।

এসব ঘটনার সঙ্গে বর্ণিল ক্যারিয়ারে অনেক অর্জনের কথা মনে আছে আলফাজের। ২০০৩ সালে পরেছিলেন সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের মুকুট। ১৯৯৬ সালে এশিয়ান কাপ উইনার্স কাপে লাওস ইলেকট্রিসিটির বিপক্ষে মোহামেডানের ৮-০ ব্যবধানের জয়ে ৪ গোল করে নির্বাচিত হয়েছিলেন এএফসির ওই মাসের ‘সেরা খেলোয়াড়’। এমন অনেক স্মৃতির ভিড়ে একটা এখনও খুব বেশি দোলা দেয় ৪৯ বছর বয়সী আলফাজকে। এবং সেটা ১৯৯৯ সালে এসএ গেমসের সোনা জয়ের সেই রাতের স্মৃতি।

“কতদিন আগের কথা। কত স্মৃতি! সব স্মৃতি কী মনে থাকে! তারপরও একটা ঘটনা বিশেষ আনন্দ দিয়েছিল আমাদেরকে। দশরথ স্টেডিয়ামে উৎসব সেরে আমরা হোটেলে ফেরার পর সব অফিসিয়ালরা এলেন। নতুন করে শুরু হলো আরেকদফা উদযাপন।”

“ওই হোটেলে তখন অনেক বিদেশি পর্যটক ছিলেন…নিউ জিল্যান্ড, সুইজারল্যান্ডের। আমাদের হৈ-হুল্লোড় দেখে ওরা জানতে চাইলেন, ‘কিসের উৎসব?’ বললাম, ‘আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছি।’ তখন ওরাও আমাদের সঙ্গে উৎসবে যোগ দিল। এটা ছিল একেবারেই অন্যরকম মজার স্মৃতি।”