করোনাভাইরাসে কতটা বদলাবে ফুটবলের দলবদলের বাজার?

১৩ মে, ২০১৭- আমি বার্সেলোনাতেই থাকতে চাই: নেইমার; ২০ জুলাই, ২০১৭-নেইমারের বাই আউট ক্লজের বিশাল অঙ্ক দেওয়া অসম্ভব: বার্সেলোনা সভাপতি। তিন মাসেরও কম সময়ে ব্রাজিলিয়ান তারকার সেই চাওয়া পাল্টে যায়, উবে যায় জোজেপ মারিয়া বার্তোমেউয়ের আত্মবিশ্বাস। কারণ? ইউরো-পাউন্ডের ঝনঝনানি। অর্থের দাপটে ফুটবল বিশ্বকে প্রচণ্ড এক নাড়া দেয় পিএসজি। দলবদলের বাজার হয়ে পড়ে আরও অস্থির। বাড়ে চোখ কপালে তোলা অঙ্কের ট্রান্সফার ফির দলবদল। এবার বুঝি সময় হয়েছে পাল্টা ধাক্কার; কোভিড-১৯ মহামারীতে মন্দার মুখে পড়তে যাচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতি, যার বিরূপ প্রভাব হয়তো পড়বে ফুটবলেও।

আব্দুল মোমিনআব্দুল মোমিনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 May 2020, 03:12 AM
Updated : 6 May 2020, 09:19 AM

২০১৭ সালের অগাস্টে ফুটবল দুনিয়াকে নাড়িয়ে দেওয়া সেই ঘটনায় ২২ কোটি ২০ লাখ ইউরো রেকর্ড ট্রান্সফার ফিতে নেইমারকে দলে টেনেছিল পিএসজি। ঠিক এক বছর আগে ইউভেন্তুস থেকে সাড়ে ১০ কোটি ইউরোয় পল পগবার ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে যোগ দেওয়া ছিল ট্রান্সফার ফির আগের বিশ্বরেকর্ড।

এক লাফে আগের রেকর্ডের দ্বিগুণের বেশি অর্থে কোনো খেলোয়াড়কে দলে টানার ঘটনাটা শুধু বিস্ময়করই ছিল না, অনেকের কাছে তা ছিল ‘পাগলামি’। বায়ার্ন মিউনিখের সভাপতি উলি হুয়েনেস যেমন সরাসরি তখন বলেছিলেন, নেইমার অত ভালো খেলোয়াড় নয়। ফুটবল বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করেন, কোনো খেলোয়াড়ের দাম এত বেশি হওয়া উচিত নয়। কোনোভাবে তা যৌক্তিকও নয়।

তবে দলবদলের বাজারের উর্ধ্বগতি থেমে থাকেনি। নেইমার পিএসজিতে যোগ দেওয়ার কিছুদিন পরেই তরুণ ফুটবলার কিলিয়ান এমবাপেকে মোনাকো থেকে ধারে দলে টানে পিএসজি। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, পরের মৌসুমে ফরাসি ফরোয়ার্ডকে স্থায়ীভাবে কিনে নেওয়ার সুযোগ ছিল প্যারিসের দলটির। তবে ট্রান্সফার ফি হতে হবে প্রায় ১৮ কোটি ইউরো। ওই সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর।

উয়েফার ফিন্যান্সিয়াল ফেয়ার প্লের নিয়মের বাধ্যবাধকতার কারণেই যে এমবাপেকে প্রথমে ধারে এনে পরের মৌসুমে কিনেছিল পিএসজি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নেইমারকে দিয়ে আকাশছোঁয়া ট্রান্সফার ফির সেই যে শুরু, আর থেমে থাকেনি। পরের ১২ মাসে আরও চারটি ১০ কোটি ইউরোর বেশি ট্রান্সফার ফি দেখে ফুটবল বিশ্ব।

আজ থেকে ৪১ বছর আগে, ১৯৭৯ সালে-প্রথম ব্রিটিশ ফুটবলার হিসেবে ট্রেভর ফ্রান্সিসের ট্রান্সফার ফি ১০ লাখ পাউন্ড ছুঁয়েছিল। বাজার দ্রুত ঘুরতে থাকে এরপর; ১০ বছরের মাথায় একজন খেলোয়াড়ের জন্য এক কোটি পাউন্ড খরচ করতে দেখা যায় কোনো ক্লাবকে।

একবিংশ শতাব্দীর শুরতে আসে রিয়াল মাদ্রিদের সেই ‘গ্যালাকটিকো’ যুগ। তারকা সব ফুটবলারকে একই ড্রেসিং রুমে আনতে যেন অর্থের বস্তা নিয়ে নেমেছিল দলটি; ফুটবল দুনিয়াকে যা হতবাক করে দেয়। আর গত কয়েক বছরে যা হচ্ছে? রীতিমত পাগলামি।

এই পর্বের শুরুটা হয়েছিল ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোকে দিয়ে। ২০০৯ সালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে ৯ কোটি ৪০ লাখ ইউরোয় পর্তুগিজ ফরোয়ার্ডকে কিনেছিল রিয়াল। চার বছর পর ওয়েলসের ফরোয়ার্ড গ্যারেথ বেলকে ১০ কোটি ইউরোয় দলে টানে মাদ্রিদের ক্লাবটি। এরপর পগবাকে কিনতে নতুন রেকর্ড গড়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। তারপরও নেইমার-পিএসজির অবিশ্বাস্য কাণ্ডের তুলনায় আগেরগুলো অনেকটা সহনীয়ই ছিল।

বার্তোমেউকে ভুল প্রমাণ করে পিএসজি যেন দেখিয়ে দেয়, কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। তাই পরের কয়েক বছরে দলটি তাদের খেলোয়াড়দের সঙ্গে নতুন চুক্তিতে বাই আউট ক্লজ বাড়িয়ে দিতে থাকে। তিন মাস পরেই যেমন মেসির বাই আউট ক্লজ করা হয় ৭০ কোটি ইউরো! ২১ বছর বয়সী ব্রাজিলের মাথেউস ফের্নান্দেসের বাই আউট ক্লজ ৩০ কোটি ইউরো। ফরাসি ডিফেন্ডার ক্লেমোঁ লংলেরও তাই। অন্য কয়েকটি ক্লাবকেও দেখা গেছে এই পথে হাঁটতে। কারণ? কেউ যেন তাদের খেলোয়াড়কে ছিনিয়ে নিতে না পারে।

কিন্তু, এর শেষ কোথায়?

বছর দেড়েক আগে, সার্বিয়ার টিভি চ্যানেল আরটিএসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এমবাপে বলেছিলেন, ফুটবলে অর্থের ঝনঝনানি তার কাছে ‘অশোভন’ লাগে।

“এটা সত্য যে বিষয়টা অশোভন, কিন্তু বাজারটাই এরকম। বিশ্ব ফুটবল এভাবেই কাজ করে…আমি একটা সিস্টেমের মধ্যে আছি।”

২০১৮ সালের লভেম্বরে ফুটবল লিকসের তথ্য-উপাত্তের উপর ভিত্তি করে কয়েকটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, পিএসজিতে পাঁচ বছরের চুক্তিতে যোগ দেওয়ার জন্য এমবাপে নাকি করের বাইরে সাড়ে ৫ কোটি ইউরোর কাছাকাছি পারিশ্রমিকসহ বিভিন্ন পারফরম্যান্স বোনাস চেয়েছিলেন। সেটাও হয়তো ওই সিস্টেমের কারণেই!

তবে করোনাভাইরাসের প্রকোপে এই সিস্টেম বাধার মুখে পড়েছে। স্থবির হয়ে গেছে বিশ্ব। থমকে আছে ফুটবলসহ বিশ্বের সব খেলাধুলা। মাঠে ফুটবল না থাকায় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছে ক্লাবগুলো।

ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস ও আর্জেন্টিনা যেমন তাদের ঘরোয়া ফুটবল মৌসুম বাতিল করে দিয়েছে। ইউরোপের চার পরাশক্তি স্পেন, জার্মানি, ইতালি ও ইংল্যান্ড অবশ্য তাদের ঘরোয়া লিগ মাঠে ফেরানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এরই মধ্যে তারা বিভিন্ন ধাপে ক্লাবগুলোকে অনুশীলনের অনুমতিও দিয়েছে। তাতে অতি সংক্রামক করোনাভাইরাসের আরও ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা বাড়ছে। ধারালো হচ্ছে সমালোচনার তীরও। ফলে শেষ পর্যন্ত যদি লিগগুলো মাঠে ফেরানো সম্ভব না হয়, তাহলে কি হবে?

নিশ্চিতভাবে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বে ক্লাবগুলো। টিভি স্বত্ব থেকে যে বিশাল অঙ্কের রাজস্ব আসে, তা বন্ধ হয়ে যাবে। উল্টো চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, দলগুলোকে নাকি বড় অঙ্কের অর্থ চ্যানেলগুলোকে দিতে হবে।

ইতালিয়ান ফুটবল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট গাব্রিয়েলে গ্রাভিনা সম্ভাব্য ক্ষতির একটা চিত্র তুলে ধরেছেন।

“মৌসুম বাতিল হলে আমরা ৭০ থেকে ৮০ কোটি ইউরো হারাব। দর্শকশূন্য স্টেডিয়ামে খেলা হলে ক্ষতি হবে ৩০ কোটি ইউরো।”

ইতোমধ্যে এর প্রভাব পড়তেও শুরু করেছে। বার্সেলোনা, আতলেতিকো মাদ্রিদ, ইউভেন্তুস, বায়ার্ন মিউনিখ, আর্সেনালসহ ইউরোপের বড় বড় কয়েকটি ক্লাব তাদের খেলোয়াড় ও স্টাফদের বেতন কাটার পথে হেঁটেছে।

এখানেই শেষ নয়, শুরু মাত্র। মহামারীর কারণে সৃষ্ট মন্দায় ফুটবলে বড় কোপটা পড়তে যাচ্ছে আসছে দলবদলের বাজারে। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সদস্য দানিয়েল কোহেন-বেনদিতের মতে, খেলোয়াড়দের দাম অনেক কমে যাবে। যেমন, হালের ‘সবচেয়ে মূল্যবান’ ফুটবলার এমবাপের ট্রান্সফার ফি নাকি নেমে আসতে পারে সাড়ে তিন থেকে চার কোটি ইউরোয়।

স্প্যানিশ ক্রীড়া দৈনিক মার্কার সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতি মৌসুমে পিএসজি নেইমারকে দিয়েছে তিন কোটি ৭০ লাখ ইউরো। অর্থাৎ এ পর্যন্ত প্যারিসের ক্লাবটি থেকে তার আয় ১১ কোটি ১০ লাখ ইউরো! শুধু নেইমার নয়, বেতন-বোনাস ও বিভিন্ন ইমেজ স্বত্ব মিলিয়ে অনেক ফুটবলারের বাৎসরিক আয়ের অঙ্কটা অবিশ্বাস্য। গত বছরের জুনে ফোর্বস সাময়িকীর তথ্যমতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের সবচেয়ে বেশি আয় করা ফুটবলার ছিলেন আর্জেন্টাইন তারকা মেসি, ১২ কোটি ৭০ লাখ ডলার। দুইয়ে থাকা ইউভেন্তুস ফরোয়ার্ড রোনালদোর আয় ছিল সাড়ে ১০ কোটি ইউরো।

কোহেন-বেনদিতের চোখে, খেলোয়াড়দের এমন আকাশছোঁয়া বেতন-বোনাসও অযৌক্তিক। করোনাভাইরাস পরবর্তী যুগে এর অনেক কিছুই আগের মত থাকবে না।

“এই সঙ্কটে পেশাদার খেলাধুলার অযৌক্তিক বিষয়গুলো মুছে যাবে...দরকার হলে বেতনের সীমা নির্ধারণ করে দিতে হবে। বিষয়টি এমন যেন নিউক্লিয়ার হামলা হয়েছে এবং সবকিছু এরপর নতুন করে শুরু করতে হবে। কেবল খেলোয়াড়দের বেতন নয়, ইমেজ স্বত্ব ও বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে।”

একইরকম ভবিষ্যদ্বানী করেছেন রিয়াল মাদ্রিদ, ইউভেন্তুস, এসি মিলানের সাবেক কোচ ফাবিও কাপেলো। তার মতে, ফুটবলে অর্থের দৌরাত্ম্য আর থাকবে না।

“দলবদলের বাজারে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। এতদিন অদ্ভুত সব সংখ্যা দেখা গেছে, সেসব এখন যৌক্তিক পর্যায়ে নেমে আসবে।”

এমন সম্ভাব্য আমূল পরিবর্তন কি শুধুই এই মহামারীর কারণে হতে যাচ্ছে? নাকি পেছনে আছে অন্য গল্প।

এই যেমন লা লিগার অন্যতম সফল ক্লাব বার্সেলোনা স্পেনের অন্যতম ধনী ক্লাবও। নেইমার চলে যাওয়ার পর অনেক নতুন খেলোয়াড় দলে টেনেছে তারা। এর মাঝে আছে ফিলিপে কৌতিনিয়ো, উসমান দেম্বেলে, অঁতোয়ান গ্রিজমানের মত দামি ফুটবলার। তাদের ট্রান্সফার ফি যথাক্রমে প্রায় ১৫ কোটি ইউরো, প্রাথমিকভাবে সাড়ে ১০ কোটি ইউরো ও ১২ কোটি ইউরো।

এত এত খেলোয়াড় কেনা, তাদের বেতন-ভাতা এবং ক্লাবের আনুষঙ্গিক খরচ চালাতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে কাতালান ক্লাবটি। দা সানের গত বছরের জুনের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী সংখ্যাটা ৯১ কোটি ইউরোর বেশি। বর্তমানে চলা মহামারীতে তাদের অবস্থা নিশ্চিতভাবে আরও নাজুক হবে। বার্সেলোনার মত এত বড় ক্লাবের যদি এই হাল হয়, তাহলে তুলনামূলক ছোট দলগুলোর অবস্থা কি দাঁড়াবে?

আগের মহামারীগুলো নিয়ে হওয়া গবেষণার ওপর ভিত্তি করে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ইনফেকশাস ডিজিজ অ্যান্ড রিসার্চ পলিসি (সিআইডিআরআইপি) গত বৃহস্পতিবার নতুন করোনাভাইরাসের স্থায়ীত্বকাল নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যেখানে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে চলা মহামারী আরও অন্তত দেড় থেকে দুই বছর সক্রিয় থাকতে পারে।

এই ধারণা সত্যি হলে বিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দা হবে আরও ভয়াবহ। ফুটবল বাণিজ্যও নিশ্চয় তার বাইরে নয়।

ইংল্যান্ডের ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের (এফএ) চেয়ারম্যান গ্রেগ ক্লার্কের ভবিষ্যদ্বাণীও দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে। চলতি মৌসুম ফিরলেও তা হবে দর্শকশূন্য মাঠে। ২০২০-২১ মৌসুমও নাকি একইভাবে আয়োজনের বিষয়ে ভাবছে কর্তৃপক্ষ। সেক্ষেত্রে ক্লাবগুলোর আয় উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাবে।

ইএসপিএনের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে কোভিড-১৯ মহামারীকে ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সংকট বলা হয়েছে। বিভিন্ন গবেষণার বরাত দিয়ে গণমাধ্যমটি শঙ্কা প্রকাশ করেছে যে শালকে ও বার্নলির মত অনেক পুরনো ক্লাব দেউলিয়া হয়ে যাবে।

আর এর প্রাথমিক ইঙ্গিত মিলতে পারে আসছে কয়েকটি দলবদলের বাজারে। অর্থের যোগান ঠিক রাখতে অনেক ক্লাবকে তাদের মূল্যবান খেলোয়াড় ছেড়ে দিতে হতে পারে এবং তা তুলনামূলক কম মূল্যে।

ফুটবল অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ কিরান ম্যাগুইরের মন্তব্যের সুত্র ধরে ভয়ানক এক চিত্র তুলে ধরেছে স্পেনের ক্রীড়া দৈনিক এএস। তুলনামূলক ছোট ক্লাবগুলো অর্থের প্রয়োজনে তাদের বড় খেলোয়াড় ছেড়ে দিতে চাইবে। আর তাদের নাজুক পরিস্থিতির সুযোগ নেবে ধনী ক্লাবগুলো। দর-কষাকষি করে কম মূল্যে তাদেরকে দলে টানবে তারা। এর ফলে ইউরোপিয়ান ক্লাবগুলোর মধ্যে শক্তির পার্থক্য আরও বড় হয়ে দেখা দিবে।

শিকাগো-ভিত্তিক স্পোর্টস ডাটা ও অ্যানালিটিক্স কোম্পানি ‘স্ট্যাটস পারফর্ম’-কে ম্যাগুইরে বলেন, “১২ মাস আগে ক্রেতা-বিক্রেতা দলের মধ্যে মূল্য নিয়ে যে আলোচনা হয়েছিল, এবার সেটির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কম হবে। উভয় পক্ষই তুলনামূলক কম মূল্য নিয়ে দর-কষাকষি করবে।”

“ইউরোপের অনেক ক্লাব অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়বে এবং তারা তাদের সম্পদ বিক্রির চেষ্টা করবে। এবারের দলবদলে যেসব খেলোয়াড়কে বিক্রি করে দলগুলো কোটি কোটি ইউরো কামানোর পরিকল্পনা করেছিল, তাদেরকে অনেক কম দামে ছেড়ে দিতে রাজি হবে তারা।”

“একইভাবে ক্রেতা ক্লাবটি বলবে, ‘আমাদের এই পরিমাণ বাজেট আছে এবং আমরা এই অর্ধেক খরচ করতে পারব।”

ক্রীড়া গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিআইইএস ফুটবল অবজারভেটরির একটি গবেষণামূলক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আসছে দলবদলে ট্রান্সফার ফি ৩০ শতাংশ কমে যেতে পারে।

বার্সেলোনা সভাপতি বার্তোমেউ মনে করেন, আসছে দলবদলে খেলোয়াড় কিনতে অর্থের পরিবর্তে ক্রেতা ক্লাব তাদের এক বা একাধিক খেলোয়াড় দেওয়ার প্রস্তাব করতে পারে। অনেকটা প্রাচীন যুগের বিনিময় প্রথার মত। কারণ, ক্লাবগুলোর হাতে যথেষ্ট অর্থ থাকবে না।

এই বিনিময় সিস্টেমে লা লিগা চ্যাম্পিয়নদেরও দেখা যেতে পারে। গত মৌসুমে তারা নেইমারকে কেনার জন্য তিনবার প্রস্তাব দিয়েও পারেনি। পিএসজির দাবি ছিল কমপক্ষে ২০ কোটি ইউরো। এবারও বার্সেলোনা নেইমারকে কেনার চেষ্টা করবে বলে গণমাধ্যমের খবর। সেক্ষেত্রে বিনিময়ে তাদের একাধিক তারকা খেলোয়াড়কে ছেড়ে দিতে হতে পারে।

নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে আরেকটি-অবিশ্বাস্য সব অঙ্কের ট্রান্সফার ফি দিয়ে দলে ভেড়ানো তারকারা কতটুকু করতে পারছেন? আসছে দলবদলের বাজারে এই বিষয়ও প্রভাব পড়তে পারে বেশ শক্তভাবে।

মৌসুমের শুরুতে ১০ কোটি ইউরোয় চেলসি থেকে এদেন আজারকে দলে টানে রিয়াল। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিশাল অঙ্কের ওই ট্রান্সফার ফির প্রতি সুবিচার করতে পারেননি বেলজিয়ান তারকা। বের্নাবেউয়ে চোটজর্জর অভিষেক মৌসুমে করেছেন মাত্র একটি গোল। ১২ কোটি ৬০ লাখ ইউরোয় আতলেতিকো মাদ্রিদে যোগ দেওয়া জোয়াও ফেলিক্সও তেমন কিছু করতে পারেননি নিজের অভিষেক মৌসুমে। বার্সেলোনায় গ্রিজমানের অভিষেক মৌসুমের চিত্রও একইরকম, পারেননি খুশি করতে। ব্রাজিলিয়ান মিডফিল্ডার কৌতিনিয়োকে তো আগেই ধারে বায়ার্ন মিউনিখে পাঠিয়ে দিয়েছে বার্সেলোনা।

পিএসজিতে নেইমারের চিত্রটা তো আরও হতাশার। প্যারিসে যাওয়ার পর থেকে বারবার চোটে পড়ায় দলের ১৫৫ ম্যাচের মধ্যে তিনি খেলতে পেরেছেন মাত্র ৮০টি, যা শতকরা হিসাবে ৫১ শতাংশ। প্রতি মৌসুমে গড়ে ২৬ ম্যাচ। এই হিসাবে ম্যাচ প্রতি নেইমারকে দেওয়া হয়েছে ১৪ লাখ ইউরো!

এসব চিত্র থেকে ম্যাগুইরের অভিমত, কাজে আসছে না বড় ট্রান্সফার।

“গত দুই-তিন বছরে আমরা যেমন দেখেছি, বড় ট্রান্সফারগুলো সাফল্যের মুখ দেখেনি। উসমান দেম্বেলে, কৌতিনিয়ো কিংবা গ্রিজমানের দিকে যদি লক্ষ্য করেন, সবাই বড় অঙ্কের চুক্তি-একমাত্র পার্থক্য যদি থাকে, সেটা ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর ইউভেন্তুসে যোগ দেওয়া।”

এই সব ব্যর্থতার গল্পে অন্তত একটা ধারণা মিলেছে, আধুনিক ফুটবলে সাফল্য কেনা যায় না। অথবা এভাবে নয়; শুধু আক্রমণভাগের শক্তি বাড়িয়ে। সাফল্য পেতে গড়তে হবে ভারসাম্যপূর্ণ দল।

লিভারপুলের দিকে তাকালে এর পক্ষে যুক্তিও মেলে। ২০১৭ সালে চার কোটি ২০ লাখ ইউরোয় তারা কেনে মোহামেদ সালাহকে। এরপর মাঝের সময়ে দলটির বড় তিন চুক্তি সবগুলোর মূল্য সাড়ে চার কোটি থেকে সাড়ে আট কোটি ইউরোর মধ্যে; গোলরক্ষক আলিসন, ডিফেন্ডার ভার্জিল ফন ডাইক ও ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার ফাবিনিয়ো।

পরিশেষে, অর্থনৈতিক মন্দা বা তারকার পেছনে না ছোটার পক্ষে যুক্তি খুঁজে পাওয়া, কিংবা দুটির যোগফল-আলোচিত বিষয়টি অনেকটা পরিষ্কার হয়ে উঠেছে যে আগামী দলবদলে থাকছে না অর্থের দাপট।