যে ‘চ্যাম্পিয়নরা’ জেতেনি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ

দারুণ ফুটবল খেলে হয়ে উঠেছিলেন নিজের সময়ের সেরাদের একজন। হৃদয় জেতার সঙ্গে ক্যারিয়ারে জিতেছেন কত শিরোপা। ব্যক্তিগত আর দলীয় অর্জনে সমৃদ্ধ ভাণ্ডার। তবুও রয়ে গেছে আক্ষেপ। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতা হয়নি।

আব্দুল মোমিনআব্দুল মোমিনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 May 2020, 02:27 AM
Updated : 1 May 2020, 09:23 AM

এখনও খেলার মধ্যে আছেন বলে আশা বেঁচে আছে জানলুইজি বুফ্ফন, জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ, রবের্ত লেভানদোভস্কির। অনেক ফুটবল গ্রেটই ক্যারিয়ারের ইতি টেনেছেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগ না ছুঁয়েই। ইউরোপ সেরার মুকুট যারা পরতে পারেননি এই লেখা তাদের গল্প নিয়ে।

রবের্তো বাজ্জিও

অনেকের মতে, ১৯৯০ দশকের শুরুর দিকের সবচেয়ে প্রতিভাবান ফুটবলার। কোকড়ানো লম্বা চুল বেঁধে মাঠে নামতেন। ‘দা ডিভাইন পনিটেইল’ নামেও পরিচিত সাবেক ইতালিয়ান এই স্ট্রাইকার।

বাজ্জিওকে কিছুটা দুর্ভাগাও কী বলা যায়? কারিয়ারের সবচেয়ে ভালো সময়টা কাটান ইউভেন্তুসে (১৯৯০-১৯৯৫)। তিনি দল ছাড়ার পর ওই মৌসুমেই দ্বিতীয়বারের মতো ইউরোপ সেরা হয় তুরিনের ক্লাবটি।

প্রতিভার কোনো কমতি তো ছিলই না, সঙ্গে পেয়েছিলেন সঠিক মঞ্চ, সতীর্থ হিসেবে পেয়েছিলেন সেই সময়ের বিশ্ব সেরাদের কয়েকজনকে। তারপরও চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতা হয়নি। তার এসি মিলান সতীর্থ পাওলো মালদিনি ও ফ্রাঙ্কো বারেসি ট্রফিটি জিতেছেন তিনবার করে (১৯৯০, ১৯৯০ ও ১৯৯৪)। ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত ইতালিয়ান ক্লাবটিতে খেলে একবার সেরি আ জয়ের স্বাদ পেয়েছিলেন বাজ্জিও।

১৯৯৩ সালের বর্ষসেরা এই ফুটবলারের বড় হতাশা নিশ্চিত করেই বিশ্বকাপ ঘিরে। ১৯৯৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে ব্রাজিলের বিপক্ষে টাইব্রেকারে পেনাল্টি কিক উড়িয়ে না মারলে তার ক্যারিয়ার হতে পারত সমৃদ্ধ।

ডেনিস বার্গকাম্প

বিমানে ওঠায় বড্ড ভয় ছিল। এ কারণে ডাকনাম হয়ে গিয়েছিল ‘নন-ফ্লাইয়িং ডাচম্যান।’ ওড়ার ভীতির কারণে ক্যারিয়ার জুড়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অ্যাওয়ে ম্যাচ খেলতে পারেননি তিনি। নিজের জাত চেনাতে অবশ্য কোনো ভুল হয়নি তার; নিজের প্রজন্মের অন্যতম সেরা ফুটবলার হিসেবেই সবাই জানতো তাকে।

মিডফিল্ডে ক্যারিয়ার শুরু করা বার্গকাম্প খেলেছেন মূল স্ট্রাইকার ও দ্বিতীয় স্ট্রাইকার হিসেবেও। দ্বিতীয় স্ট্রাইকার হিসেবে মানিয়ে নেওয়ার পর ২০ বছরের ক্যারিয়ারের অধিকাংশ সময় এই পজিশনেই খেলেন।

আয়াক্স ও ইন্টার মিলান হয়ে ১৯৯৫ সালে পাড়ি জমান আর্সেনালে। গানারদের হয়ে তিনটি প্রিমিয়ার লিগসহ জেতেন মোট ১০টি শিরোপা। এখন পর্যন্ত একমাত্র ডাচ খেলোয়াড় হিসেবে জায়গা পেয়েছেন ইংলিশ ফুটবল হল অব ফেমে।  

আর্সেনালের হয়েই চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের খুব কাছে গিয়েছিলেন ক্যারিয়ারের একেবারে শেষ ম্যাচে। কিন্তু স্বপ্ন অপূর্ণই রয়ে যায়। ২০০৫-০৬ আসরের ফাইনালে বেঞ্চে বসে দেখতে হয় বার্সেলোনার বিপক্ষে দলের ২-১ গোলের হার।

ম্যাচের শুরুর দিকে গোলরক্ষক ইয়েন্স লেমান লাল কার্ড দেখলে আর্সেনাল কোচ আর্সেন ভেঙ্গারের হাতে রয়ে যায় দুজন খেলোয়াড় বদলানোর সুযোগ। সেদিন যদি মাঠে নামার সুযোগ পেতেন বার্গকাম্প, তাহলে গল্পটা অন্যরকমও হতে পারতো!

ইউরোপ সেরার মঞ্চে এখনও সাফল্যের দেখা পায়নি ক্লাব আর্সেনালও।

পাভেল নেদভেদ

নিজের প্রজন্মের অন্যতম সৃজনশীল ফুটবলার। অনেকের মতে চেক রিপাবলিকের ফুটবল ইতিহাসের সফলতম খেলোয়াড়। ক্লাব ক্যারিয়ারে জিতেছেন অসংখ্য শিরোপা। ছিলেন ১৯৯৬ ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের রানার্সআপ ও ২০০৪ আসরের সেমি-ফাইনালিস্ট চেক দলে।

তার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ভাগ্য? গল্পটা আরও হতাশাময়। একটি সেরি আ সহ লাৎসিওর হয়ে মোট সাতটি শিরোপা জিতে ২০০১ সালে পা রাখেন ইউভেন্তুসে। হয়ে ওঠেন দলের আক্রমণের প্রাণ।

চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ২০০২-০৩ আসরে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে দলকে নিয়ে যান ফাইনালে।

কিন্তু সেমি-ফাইনালের ফিরতি লেগে রিয়াল মাদ্রিদের স্টিভ ম্যাকমানামানকে ফাউল করে দেখেন হলুদ কার্ড। কার্ডের খাড়ায় পড়ে ফাইনালে খেলার সুযোগ হারান নেদভেদ। দলের সেরা খেলোয়াড়কে ছাড়া ইউভেন্তুসও পারেনি ফাইনালে অসম্ভবকে সম্ভব করতে। এসি মিলানের কাছে হেরে যায় টাইব্রেকারে।

রোনালদো

“সব ডিফেন্ডারকে ছাড়িয়ে গোলরক্ষককেও কাটিয়ে গোল করতে আমি ভীষণ ভালোবাসি। এটা আমার বিশেষত্ব নয়, আমার অভ্যাস।”- শুধু মুখে নয়, মাঠেও ঠিক এমনই ছিলেন রোনালদো নাজারিও। অসাধারণ ড্রিবলিং ও গতির মিশেলে বিধ্বংসী এক ফরোয়ার্ড।

বল পায়ে অসাধারণ সব কারুকাজ আর গোলমুখের দারুণ ক্ষিপ্রতায় হয়ে উঠেছিলেন ‘দা ফেনোমেনন।’ দুবার ভেঙেছেন ট্রান্সফার ফির বিশ্ব রেকর্ড। যেখানেই গেছেন, পেয়েছেন সাফল্য। ব্রাজিলের ২০০২ বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক। ছিলেন ১৯৯৪ বিশ্বকাপ জয়ী দলেও, সেবার অবশ্য কোনো ম্যাচ খেলার সুযোগ হয়নি। তিনবারের ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলার, দুবারের ব্যালন ডি’অর জয়ী।

ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই ফুটবলারের প্রাপ্তির যেন শেষ নেই। তারপরও একটা আফসোস রয়েই গেছে, জেতা হয়নি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ।

তার মত একজনের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ না জেতাটা অবিশ্বাস্য লাগে আরেক ব্রাজিলিয়ান তারকা রোনালদিনিয়োর কাছে।

“সে ছিল আমার আদর্শ। পরে তো তার সঙ্গে খেলেছি এবং বিশ্বকাপ জিতেছি। সে ইতিহাসের সবচেয়ে পরিপূর্ণ স্ট্রাইকার, ভবিষ্যতেও সেই সবচেয়ে পরিপূর্ণ স্ট্রাইকার থাকবে। এটা ভাবা অবিশ্বাস্য যে সে কখনও চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতেনি।”

১৯৯৯ সালে পাওয়া হাঁটুর গুরুতর চোট কাটিয়ে আবার পুরনো রূপে ফেরেন রোনালদো। আট গোল করে ২০০২ বিশ্বকাপে জেতেন গোল্ডেন শু। এরপর যোগ দেন রিয়াল মাদ্রিদে। ২০০৩ সালে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ কোয়ার্টার-ফাইনালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মাঠে তার অসাধারণ সেই হ্যাটট্রিক বহুদিন ফুটবলপ্রেমীদের মনে গেঁথে থাকবে। কিন্তু তার সেই পথচলা থেমে গিয়েছিল পরের ধাপেই। নেদভেদের ইউভেন্তুসের কাছে হেরে যায় রিয়াল।

রুড ফন নিস্টলরয়

লিওনেল মেসি ও ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর দাপটে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতার স্থানটি চলে গেছে অন্যদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে একসময় রেকর্ডটি ছিল রাউল গনসালেস ও রুড ফন নিস্টলরয়ের। পিএসভি আইন্দহোভেন, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে এই ডাচ স্ট্রাইকার ছিলেন দারুণ কার্যকর। বিশেষ করে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের ইউনাইটেডে।

ইউরোপ সেরার মঞ্চে ৭৩ ম্যাচে ৫৬ গোল করা নিস্টলরয় ২০০১-০২, ২০০২-০৩ ও ২০০৪-০৫ আসরে ছিলেন প্রতিযোগিতাটির সর্বোচ্চ গোলদাতা। কিন্তু তার ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে থাকার সময়ে কখনোই এর ফাইনালে উঠতে পারেনি ইউনাইটেড।

চ্যাম্পিয়ন্স লিগ প্রশ্নে তার রিয়াল মাদ্রিদ অধ্যায়ও একইরকম হতাশায় মোড়া। অবশেষে ২০১২ সালে প্রায় দুই দশকের ক্যারিয়ারের ইতি টানেন আইন্দহোভেনের হয়ে দুটি, ইউনাইটেডের হয়ে একটি ও রিয়ালের হয়ে দুটি লিগ শিরোপা জেতা নিস্টলরয়।

ফাবিও কানাভারো

ইতালির ২০০৬ বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক সত্যিকার অর্থে ছিলেন একজন অসাধারণ ডিফেন্ডার। দেশকে বিশ্বসেরার মুকুট জেতানোর বছরে জিতেছিলেন ফিফা বর্ষসেরার পুরস্কার ও ব্যালন ডি’অর।

ক্যারিয়ারে খেলেছেন ইন্টার মিলান, ইউভেন্তুস (দুই মেয়াদে) ও রিয়াল মাদ্রিদের মত জায়ান্ট ক্লাবে। তারপরও পূর্ণ হয়নি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের স্বপ্ন।

ম্যাচ পাতানোর কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে ইউভেন্তুস সেরি বি লিগে নেমে গেলে রিয়ালে যোগ দেন কানাভারো। মাদ্রিদের ক্লাবটির হয়ে দুবার জিতেছিলেন লা লিগা। কিন্তু দলটির হয়ে কখনও চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শেষ ষোলোও পার করতে পারেননি তিনি।

পাত্রিক ভিয়েইরা

ইউভেন্তুসের ম্যাচ ফিক্সিং দুর্নীতি ও তাদের বি লিগে অবনমনের ঘটনার প্রভাব পড়েছিল ভিয়েইরার ক্যারিয়ারেও। তার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের স্বপ্নে সেটা অবশ্য শাপেবরও হতে পারতো; কিন্তু একটুর জন্য হাতছাড়া হয়ে যায়।

২০১০ সালের জানুয়ারিতে ফরাসি এই মিডফিল্ডারকে ছেড়ে দেন ওই সময়ের ইন্টার কোচ জোসে মরিনিয়ো। ভিয়েইরা যোগ দেন অর্থের ঝনঝানিতে বড় ক্লাব হয়ে ওঠার ঘোষণা দেওয়া ম্যানচেস্টার সিটিতে। সেই মৌসুমেই মাদ্রিদের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল জিতে ট্রেবল পূর্ণ করে ইন্টার।

১৯৯৬ সালে মিলান ছেড়ে আর্সেনালে যোগ দেওয় ভিয়েইরা হয়ে ওঠেন ইউরোপের সেসময়ের অন্যতম সেরা ফুটবলার। দেশের হয়ে জেতেন ১৯৯৮ বিশ্বকাপ, ২০০১ ফিফা কনফেডারেশন্স কাপ ও ২০০২ সালের ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ।

আর্সেনালের হয়ে তিনবারের প্রিমিয়ার লিগ চ্যাম্পিয়ন ও ইন্টারের হয়ে চারবার সেরি আ জয়ী ভিয়েইরা ২০০১ সালে হয়েছিলেন ফ্রান্সের বর্ষসেরা ফুটবলার। অনেক অনেক সাফল্যে ভরা তার প্রাপ্তির ভাণ্ডার একটুর জন্য যেন পূর্ণতা পায়নি, জেতা হয়নি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ।

ফ্রান্সেসকো তত্তি

মাঝমাঠের সেনানী, আক্রমণের উৎস, উইঙ্গার, সবশেষে সেন্টার ফরোয়ার্ড-যেকোনো পজিশনে খেলতে অভ্যস্ত অসাধারণ দক্ষ ছিলেন তত্তি। ৪০ বছরে এসেও মাঠ মাতিয়েছেন।

দেশের হয়ে জিতেছেন ২০০৬ বিশ্বকাপ। কিন্তু ক্লাব ফুটবলে তার সাফল্য খুব বেশি নয়। কারণটাও বোধগম্য, ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় যে খেলে গেছেন তুলনামূলক কম শক্তির রোমায়।

২৬ বছর বয়সে বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদের মত দুই জায়ান্ট ক্লাবে যাওয়ার প্রস্তাব পেয়েছিলেন তিনি; কিন্তু রোমার প্রতি ভালোবাসায় থেকে গেছেন সেখানেই। ২০০০-০১ সেরি আ সহ দলটির হয়ে মোটে তিনটি শিরোপা জিতেছিলেন তিনি। শিরোপার ভান্ডার অনেকের তুলনায় খালি থাকলেও তাতে যেন কোনো আফসোস নেই তার।

“রোমায় একটি লিগ শিরোপা জেতা আমার কাছে ইউভেন্তুস কিংবা রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে ১০টি জয়ের সমান।”

ইউরোপ সেরা প্রতিযোগিতায় রোমা কখনোই বড় দল হয়ে উঠতে পারেনি। তত্তির মত সময়ের সেরা প্লেমেকারকে নিয়েও চ্যাম্পিয়ন্স লিগে তাদের সেরা পারফরম্যান্স ২০০৬-০৭ ও ২০০৭-০৮ মৌসুমে কোয়ার্টার-ফাইনালে ওঠা।