খেপ খেলার দুষ্ট চক্রে বিলীন স্বপ্ন

অভাব মেটানোর তাড়নায় শুরু। এক পর্যায়ে জন্মে যায় কাঁচা পয়সার প্রতি দুর্নিবার মোহ। যোগ হয় ক্লাব-কোচদের উদাসীনতাও। ক্রমে তৈরি হয়ে যায় খেপ খেলার দুষ্টুচক্র। সেই চক্রে পড়ে ফুটবলারদের বেড়ে ওঠার পর্যায় থেকেই নিভে যায় সম্ভাবনার অনেক প্রদীপ। বাংলাদেশ পুলিশ এফসির সহকারী কোচ ও ট্রেনার মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলামের হিসাব বলছে, এই পথে হারিয়ে যাওয়া কুঁড়ির সংখ্যা ১৫ থেকে ২০ শতাংশ!

মোহাম্মদ জুবায়েরমোহাম্মদ জুবায়েরবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 April 2020, 07:17 AM
Updated : 18 April 2020, 07:36 AM

পাইওনিয়ার, তৃতীয়-দ্বিতীয়-প্রথম বিভাগ এবং চ্যাম্পিয়নশিপ লিগ-ফুটবলার তৈরির এই পর্যায়গুলোতে সীমাবদ্ধতা অনেক। মাঠ নেই। অর্থ নেই। সময়োপযোগী পরিকল্পনা নেই। লেপ্টে আছে ম্যাচ গড়াপেটার কালি। আছে ঘরোয়া ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) উদাসীনতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। স্বজনপ্রীতি ও ম্যাচ পাতানোর অভিযোগ তো নিত্য সঙ্গী।

ঘরোয়া ফুটবলের এই পর্যায়ের নানা সমস্যা ও সমাধানের পথ নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর সঙ্গে কথা বলেছেন একাধিক কোচ। তাদের কথায় উঠে এসেছে নানা সাদা-কালো দিক। ধারাবাহিক এই আয়োজনে কোচ আশরাফুল জানালেন খেপ খেলার খপ্পরে পড়ে হারিয়ে যাওয়াদের কথা। বাতলে দিলেন এই রোগ থেকে মুক্তির পরামর্শও।

নিজেকে প্রমাণের মঞ্চও খেপ-খেলা!

‘খেপ খেলেছেন?’ সরাসরি এই প্রশ্নের সোজাসাপ্টা উত্তর দিলেন ১৭ বছর ধরে পুলিশ এফসির রক্ষণ সামলানো আশরাফুল, “লিগের বিরতিতে ছুটি থাকার সময় কম-বেশি খেলেছি।” এরপর তিনি খুলে দিলেন মনের আগল। এই ধাপের ফুটবলারদের রুঢ় আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা, পারিশ্রমিকের স্বল্পতা, সিস্টেমের দুর্বলতা, সবই তুলে ধরলেন সবকিছুই।

“এই পর্যায়ের খেলোয়াড়দের আর্থিক সমস্যা আছে সবারই। আমি চাকরি করি, আমার মাসিক বেতন আছে। যে চাকরি করে না, তার তো কিছু নেই। শীর্ষ পর্যায়ে না গেলে কিন্তু টাকা নেই। এই পর্যায়ে দেওয়া হয় ডাল-ভাতের টাকা। এ কারণে অনেকে খেপ খেলে।ক্লাব  থেকে ৫ বা ১০ হাজার টাকার যে বেতন পায়, সেটা হয়ত পরিবারকে দেয়। আর খেপ খেলে নিজের খরচ, শরীর ঠিক রাখার জন্য একটু ভালো খাবার, ফলমূল এসব কিনে খায়।”

“এই পর্যায়ের লিগগুলো অনিয়মিত। কিন্তু খেলোয়াড়কে তো খেতে হবে। ফিট থাকতে হবে। আবার টানতে হবে পরিবারকেও। সে কী করবে? নিরুপায় হয়ে খেপ খেলে এই চাহিদাগুলো মেটায় তারা।”

মজার ব্যাপার হলো, খেপ খেলার অন্যরকম একটি ইতিবাচক দিকও দেখালেন এই কোচ।

“আরেকটি বাস্তব দিকও আছে-এটা খেলোয়াড় বাছাইয়েরও একটা উপায়। খেপের ম্যাচের দিকে স্থানীয় কোচরা চোখ রাখে। সেখানে কেউ ভালো করলেও উপরের ধাপের কোচের কাছে খবর যায়-অমুক ভালো করেছে; রানিং, মুভিং ভালো। তখন ভালো দল থেকে ডাক আসে।”

খেপ নিয়ে খেলোয়াড়-কোচ-ক্লাব চক্র

পয়সার মোহ পেয়ে বসলে শুরু হয় বিভ্রাট। নানা বাহানায় খেপ খেলার জন্য ‘ছুটি’ নেন খেলোয়াড়রা। ইচ্ছা-অনিচ্ছায় অনেক কোচ ছুটি দেন। এই ‘বিশেষ ছুটি’ অনুমোদনে হাত থাকে কিছু কোচিং স্টাফেরও। পর্যাপ্ত পারিশ্রমিক দিতে না পারা অনেক ক্লাবও অন্যভাবে এর সুযোগ নেয় বলে জানালেন আশরাফুল।

“ধরুন, একজন খেলোয়াড় দলে নতুন, তখন কিছু কিছু দলের অফিসিয়াল কিংবা ক্লাব চায়, বাইরে হলেও সে আরও বেশি বেশি ম্যাচ খেলে অভিজ্ঞতা বাড়াক। সেটা তারা নিজেদের ম্যাচে কাজে লাগাবে। তখন ছাড় দেয়। আসলে খেলোয়াড়রা কোনো না কোনো উপায়ে ক্লাব, কোচ বা কোচিং স্টাফদের ম্যানেজ করে খেপ খেলার জন্য ছুটি বের করে নেয়।”

ট্রেনার বলেই খেলোয়াড়দের শরীরটাকে অন্যদের চেয়ে ভালো বুঝেন আশরাফুল। জানালেন, খেপ খেলতে গিয়ে নিয়মের তোয়াক্কা না করে অনেকে নিজেদের শেষ করে দেয়।

“ম্যাচের আগে কমপক্ষে ১৫ মিনিট ওয়ার্ম-আপ করার নিয়ম। কিন্তু খেপ খেলতে গেলে টাকা-পয়সার দেন-দরবার, দর্শক-আয়োজকদের চাপে অনেক সময় ওয়ার্ম-আপ না করেই মাঠে নেমে যেতে হয় ছেলেদের। ৫০ শতাংশ চোট হয় এভাবেই। ঝরে যায় ১৫-২০ শতাংশ খেলোয়াড়ও।”

সতর্ক হতে হবে খেলোয়াড়ই

১৭ বছর ধরে পুলিশ এফসির হয়ে ফুটবল খেলার তৃপ্তি নিয়ে গত বছর খেলোয়াড়ী জীবনের পাট চুকিয়েছেন আশরাফুল। পুলিশের চাকরি করে যাওয়ার পাশাপাশি দলের সহকারী কোচ ও ট্রেনারের ভূমিকায় নতুন শুরু করেছেন এ বছর। ২০১৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ডাকলেও যাননি। কখনও ডাক পাননি জাতীয় দলে। তবে নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে তৃপ্ত সাবেক এই লেফট-ব্যাকের চাওয়া, উত্তরসূরিরা যেন অর্থ-বিত্তের মোহে আত্মঘাতী না হয়।

“অভাব থাকলেও ফুটবল, দেশ এবং নিজের স্বার্থে খেপ খেলা ছেড়ে দেওয়া উচিত। কেননা এটা করতে গিয়ে চোটে পেলে ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যেতে পারে। খেলোয়াড়দেরই সতর্ক হতে হবে বেশি। শৃঙ্খলা মানতে হবে। আমাদের পুলিশ দলে এটা কাড়কড়িভাবে মানা হয়। চুরি করে খেপ খেলার দরকার নেই। চুরি যদি করতেই হয়, তাহলে তরুণদের বলব, সিনিয়রদের যে কাজ, দক্ষতা, সেসব চুরি করতে।”

এই পর্যায়ের ফুটবলে কোচদের পছন্দের খেলোয়াড়কে প্রাধান্য দেওয়ার অভিযোগ আছে। আশরাফুলের চাওয়া, স্বজনপ্রীতির উর্ধ্বে থেকে দায়িত্বশীলরা যেন তরুণদের মনটাও একটু বুঝতে চেষ্টা করেন।

“তিন বেলা শুধু ফুটবল নিয়ে কড়া-কড়া কথা নয়, এই তরুণ খেলোয়াড়দের মনটাও বুঝতে হবে। কেমন আছে, কী অবস্থা, কোনো সমস্যা আছে কিনা, এসব নিয়েও ওদের সঙ্গে মন খুলে একটু কথা বলা উচিত। তাহলে অনেক অভাব-অভিযোগ থাকলেও ওরা বিপথগামী হবে না বলে বিশ্বাস আমার।”