স্বজনপ্রীতির ‘বলি’ অনেক উঠতি ফুটবলার

বেশ চেনা গল্প। একটু পরিচিত মুখ হলে কিংবা ‘রেফারেন্স’ থাকলে কত সুবিধাই না মেলে! ফুটবলারের বাছাইয়ে সময় গড়পড়তা অনেকের নামের পাশে ‘সিলেক্টেড’ সিল পড়ে যায় দুম করে। আত্মঘাতী এই পদক্ষেপের ঝাঁকুনিতে ফুটবলারদের উঠে আসার প্রথম সিঁড়ি, পাইওনিয়ার লিগ থেকেই ঝরে পড়ে সম্ভাবনাময়দের অনেকে। কারও কারও মতে ঝরে যাওয়া স্বপ্নের সংখ্যা ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ! বাছাই সংশ্লিষ্টরা তো বটেই, এর পেছনে কোচ-ক্লাবেরও দায় কম নয় বলে মনে করেন তৃণমূল ফুটবল নিয়ে কাজ করা ইমদাদুল হক খোকন।

মোহাম্মদ জুবায়েরমোহাম্মদ জুবায়েরবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 April 2020, 07:02 AM
Updated : 15 April 2020, 07:44 AM

পাইওনিয়ার, তৃতীয়-দ্বিতীয়-প্রথম বিভাগ এবং চ্যাম্পিয়নশিপ লিগ-ফুটবলার তৈরির এই পর্যায়গুলোতে সীমাবদ্ধতা অনেক। মাঠ নেই। অর্থ নেই। সময়োপযোগী পরিকল্পনা নেই।  লেপ্টে আছে ম্যাচ গড়াপেটার কালি। আছে ঘরোয়া ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) উদাসীনতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। স্বজনপ্রীতির বিষেও নীল হয়ে যায় অনেকের স্বপ্ন।

ঘরোয়া ফুটবলের এই পর্যায়ের নানা সমস্যা ও সমাধানের পথ নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর সঙ্গে কথা বলেছেন একাধিক কোচ। তাদের কথায় উঠে এসেছে নানা সাদা-কালো দিক। ধারাবাহিক এই আয়োজনে কোচ খোকন নানা অভিযোগ তোলার পাশাপাশি বাতলে দিলেন সংকট থেকে উত্তরণের পরামর্শও।

আত্মীয়করণের বিষে নীল অনেক স্বপ্ন

একটি ভুল খুলে দেয় হাজারও ভুলের দুয়ার। তাই স্বজনপ্রীতির ভুল ছড়ায় বয়স আড়ালের লুকোচুরি খেলায়; পাইওনিয়ারে নির্ধারিত ১৫ বছরের সীমা পেরুনো তখন দায়িত্বশীলদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। ‘গলাকাটা পাসপোর্টের’ মতোই এক খেলোয়াড় রেজিস্ট্রেশন করিয়ে ছবি বদলে আরেক খেলোয়াড় খেলোনোর ঘটনাও ঘটে যায় দিনের আলোয়!

ফুটবলার বাছাইয়ের ‍গুরুত্বপূর্ণ এই ধাপে আত্মীয়করণের দায় অনেকের বলে অকপটে জানালেন পাইওনিয়ারের দল আক্কেলপুর ফুটবল একাডেমির কোচ খোকন।

“বাছাইয়ে স্বচ্ছতা থাকতে হবে। এখানে অনেক সময় আত্মীয়করণের ব্যাপার থাকে। কখনও ডাক্তার বলেন খেলোয়াড়ের বয়স-উচ্চতা ঠিক আছে, কিন্তু যারা কোচ থাকে, তারা হয়তো বলেন-ঠিক নাই। আবার কোচ বলল-সব ঠিক আছে, ডাক্তার বলেন-ঠিক নাই। এই টানাটানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় খেলোয়াড়রা।”

“বয়স লুকানো বা অস্বচ্ছতার দায় কেবল ম্যানেজমেন্টের নয়, বা বাছাই প্রক্রিয়ায় যে কোচ-ডাক্তাররা সরাসরি যুক্ত থাকেন, শুধু তাদেরও নয়। এখানে দায় আছে ক্লাব-কোচ সবারই। কেননা, একেবারে তাদের অজান্তে এগুলো সম্ভব বলে আমি মনে করি না।”

পাইওনিয়ারের গত আসরে অংশ নেয় ৭০টি দল। প্রতিটি দল গড়ে ২০ জন খেলোয়াড় নিবন্ধন করালেও মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার চারশতে। নিবন্ধন প্রক্রিয়ার জটিলতায়ও বিরক্ত ‘সি’ লাইসেন্স করা এই কোচ।

“ঢাকায় গিয়ে খেলোয়াড়দের রেজিস্ট্রেশন করানো একটা এটা বড় একটা সমস্যা। রেজিস্ট্রেশনের দিন-তারিখও বদলায় হুট করে। রেজিস্ট্রেশনের দিন ছেলেগুলো সকাল থেকে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকে সন্ধ্যা পর্যন্ত, কেউ খেয়ে-কেউ না খেয়ে। আবার ঢাকার বাইরে থেকে কোনো দল খেলতে গেলে থাকার জায়গাও দিতে চায় না কর্তৃপক্ষ।”

উঠতি ফুটবলারদের খেপ খেলার লোভ

খেলোয়াড় ও কোচ হিসেবে নজরকাড়া সাফল্য এখনও মেলেনি খোকনের। খেলেছেন প্রথম বিভাগ ফুটবল পর্যন্ত। জন্ডিস-টাইফয়েডে থেমে যায় পথচলা। কোচ হিসেবে তার প্রতিষ্ঠিত আক্কেলপুর একাডেমি গত পাইওনিয়ারের সুপার লিগে ওঠার পর বিদায় নেয় কোয়ার্টার-ফাইনালের আগে।

জয়পুরহাটে ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত একাডেমি চালাতে গিয়ে উঠতিদের খুব কাছ থেকে দেখছেন ৪৫ বছর বয়সী এই কোচ। মিষ্টি ও তিক্ত, দুইরকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি। অর্থকষ্টসহ হাজারও সীমাবদ্ধতা মেনে নিরলস ঘাম ঝরানোদের গল্প খোকন শোনালেন তৃপ্তির সুরে। আবার, অর্থের লোভে খেপ খেলায় মজে হারিয়ে যাওয়াদের নিয়ে বলতে গিয়ে ভারী হয়ে ওঠে তার কণ্ঠ।

“২০১৬ সালে আবাসিক করার পর এখন ২০ জন খেলোয়াড় নিয়ে একাডেমিটা চালাচ্ছি। ছেলেদের থাকা, খাওয়া এবং অল্প-স্বল্প বেতনও দেয়। সত্যি বলতে আপত্তি নেই…মাত্র ৩ হাজার টাকা বেতন দেই; এর মধ্যে অর্ধেক পরিশোধ করি; বাকিটা আটকে রাখি আর্থিক সমস্যার কারণে। কিন্তু যখন দেখি সব মেনে নিয়ে ছেলেরা কষ্ট করছে, চেষ্টা করছে, সত্যিই ভালো লাগে।”

“উল্টো ঘটনাও আছে। ওয়ালী নামে বগুড়ার একটা ছেলেকে বাছাই করে নিয়ে এলাম। তিন দিন অনুশীলন করল। হঠাৎ বলল দাদী অসুস্থ; মরণাপন্ন। চলে গেল, আর ফিরে এলো না। পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম, সে খেপ খেলে বেড়ায়। খেপ খেলা নিয়ে পাগল হয়ে গেলো ছেলেটা। এখন কিছু ছেলেপেলে আসে, যারা দ্রুত টাকা আয় করতে চায়। এভাবে অনেক মেধা হারিয়ে যায় টাকার লোভ সামলাতে না পেরে।”

‘৬৪ জেলাতে চাই ফুটবলের চাষাবাদ’

গত চারটি সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ ছিটকে পড়ে গ্রুপ পর্ব থেকে। যেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে বাংলাদেশের অবস্থান কতটা নিম্নমুখী। এএফসির ক্লাব পর্যায়ের টুর্নামেন্টেও নেই উল্লেখযোগ্য সাফল্য।

কোচ খোকনের বিশ্বাস, ৬৪টি জেলায় ফুটবলের চাষাবাদ হলে বদলে যেত অনেক কিছু। অন্ধকার তাড়িয়ে আগের আলোয় ফেরার পথ পেত দেশের ফুটবল।

“প্রতিটি জেলায় যদি একটা করে একাডেমি থাকত, তাহলে ফুটবলের আজ এই অবস্থা হত না। ৬৪টি জেলায় যদি ৬৪টি একাডেমিতে যথাযথভাবে ফুটবল চাষ হত, সামর্থ্যবানরা একটু এগিয়ে আসত, তখন জেলা পর্যায় থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে প্রতিযোগিতা বেড়ে যেত, ফুটবলের উন্নতি তর তর করে হতো।”