‘চোটে পড়লে উঠতি ফুটবলারদের দেখার কেউ নেই’

চাহিদা কমে যাওয়ার ভয়ে হালকা চোট চেপে রাখেন অনেকে। বাড়ন্ত শরীরটাকে কষ্ট দিয়ে চালিয়ে যান ফুটবল। কিন্তু চোট একটু গভীর হলে চিকিৎসার নিশ্চয়তাও নেই! ভর করে শঙ্কার কালো মেঘ, অনিশ্চিয়তায় উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন ফুটবলাররা। তাদের পরিবারও নিম্নবিত্ত। পাইনিওয়ার লিগ, তৃতীয়-দ্বিতীয়-প্রথম বিভাগ ও চ্যাম্পিয়নশিপ লিগ (বিসিএল)-এই চার ধাপের উঠতি খেলোয়াড়দের বেড়ে ওঠার পথে এটি আরেকটি বড় বাধা  বলে মনে করেন কোচ শহীদুল ইসলাম।

মোহাম্মদ জুবায়েরমোহাম্মদ জুবায়েরবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 April 2020, 06:26 AM
Updated : 14 April 2020, 09:18 AM

পাইওনিয়ার থেকে শুরু করে বিসিএল পর্যন্ত-ফুটবলার তৈরির এই পর্যায়ে সীমাবদ্ধতার শেষ নেই। মাঠ নেই। অর্থ নেই। সময়োপযোগী পরিকল্পনা নেই। খেলোয়াড়রা চোটে পড়লে সাহায্যের হাত বাড়ানোর লোকটিও খুঁজে পাওয়া কঠিন। বরং এ পর্যায়ের ফুটবলে লেপ্টে আছে ম্যাচ গড়াপেটার কালি, ঘরোয়া ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) উদাসীনতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, স্বজনপ্রীতিও।

ঘরোয়া ফুটবলের এই পর্যায়ের নানা সমস্যা ও সমাধানের পথ নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর সঙ্গে কথা বলেছেন একাধিক কোচ। তাদের কথায় উঠে এসেছে নানা সাদা-কালো দিক। ধারাবাহিক এই আয়োজনে কোচ শহীদুল অভিযোগ-অনুযোগ জানানোর পাশাশাশি দিলেন সংকট থেকে উত্তরণের পরামর্শও।

চোটে পড়া মানেই যেন ব্রাত্য

২০১৯ সালের বিসিএলে ঢাকা সিটি এফসির হয়ে খেলার সময় হ্যামস্ট্রিংয়ের চোটে পড়েন মিরাজ মোল্লা। দ্বিতীয় বিভাগে দিলকুশা স্পোর্টিংয়ে হয়ে খেলা আহমেদ মোস্তাককে চোট ছোবল দেয় প্রতিযোগিতার মাঝামাঝি সময়ে। একই চোটে পড়েন আরিফ লালও। কিন্তু তাদের নিয়ে ক্লাবের কোনো ভাবনাই নেই!

মিরাজ ও আরিফ ২০১৭ সালে খেলেছেন এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে। অথচ দুঃসময়ে তাদের পাশে দাঁড়ায়নি বাফুফেও। হঠাৎ ঝড়ে সম্ভাবনার তিনটি প্রদ্বীপ অকালেই নিভে যাওয়ার জোগাড়!

তাদের প্রতি অবহেলায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষোভে ফুসে ওঠে ফুটবলপ্রেমীরা। তাদের অভিযোগের তির ছোটে দুঃসময়ে দূরে থাকা ক্লাব ও বাফুফের দিকে। সমর্থকদের আকুতিতে সাড়া দেয় কিছু হৃদয়বান মানুষ। অবশেষে সাহায্যের হাত খানিকটা বাড়ায় ক্লাবও। হাসপাতাল ঘুরে মিরাজ-মুস্তাকরা এখন ফুটবলের সবুজে ফেরার অপেক্ষায়।

তাদের তবু শেষ পর্যন্ত চিকিৎসা হয়েছে, কিন্তু অনেকেরই হয় না সেই সৌভাগ্য। কোচ শহিদুলের নিজের খেলোয়াড়ী জীবনও শেষ হয়েছিল চোটের কাছে হার মানতে বাধ্য হয়ে। কোচিংয়ে আসার পরও এমন অনেক ঘটনারই স্বাক্ষী তিনি।

“বিভিন্ন সময় খেলতে গিয়ে ছেলেরা চোটে পড়ে। ক্লাবের কাছে চাহিদা কমে যাওয়ার ভয়ে বলতে চায় না। তখন অনেক ক্ষেত্রেই তাদের দেখার কেউ থাকে না। ছেলেরা পিছিয়ে যায়। কেউ কেউ বিশ্রাম নিয়ে রিকোভারি করে ফেরে, কখনও অনেকের ক্যারিয়ারই শেষ হয়ে যায় চিরতরে।”

“ছোট-খাট একটা অপারেশনের জন্যও এক থেকে দেড় লাখ টাকা লাগে। যেটা নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে আসা খেলোয়াড়রা বহন করতে পারে না। এই সময়ে ফেডারেশন হোক, ক্লাব হোক বা যে কোনো জায়গা থেকে হোক, এই (আর্থিক) সাপোর্টটা এলে ওরা উৎসাহী হবে, শঙ্কা থাকবে না।”

যতটুকু খাবার, ততটুকু ট্রেনিং

বাফুফের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য মেলে যৎসামান্য। পৃষ্ঠপোষকরাও থাকেন দূরের বাসিন্দা হয়ে। তাই ক্লাবগুলোর নিত্যসখা হয়ে থাকে অর্থ সঙ্কট। সাত বছরের কোচিং ক্যারিয়ারের অভিজ্ঞতা থেকে শহীদুল জানালেন, অসহায়ত্ব পেয়ে বসে কোচদেরও।

“বেশিরভাগ সমস্যাই আর্থিক। ফেডারেশন থেকে খুব বেশি আর্থিক সুবিধা আসে না। অথচ তৃতীয় বিভাগের একটা দল চালাতে হলেও ৮-১০ লাখ টাকা লাগে। ফেডারেশন দেয় মোটে ২০-৩০ হাজার টাকা। স্পন্সররাও আসে না। তখন সামর্থ্যবানদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে এগুলো চালাতে হয়।”

“খেলোয়াড়দের পর্যাপ্ত খাবার দিতে পারি না। খারাপ লাগে আমাদেরও। খাবার দিতে পারি না বলে ওই মাপের অনুশীলনও করাতে পারি না। যতটুকু দিতে পারি, অনুশীলনও ততটুকুতেই রাখি। তা না হলে চোটে পড়ার ঝুঁকি থাকে। বেশি অনুশীলন করলে অনেক ক্ষেত্রে ওই খেলোয়াড়কে হারাতে হয়।”

তৃণমূল থেকে খেলোয়াড় বাছাই প্রক্রিয়া নিয়েও খুব বেশি সন্তুষ্ট নন শহীদুল। স্রেফ চোখের দেখায় সব সিদ্ধান্ত নিতে হয় বলে জানালেন এই কোচ।

“ ফুটবলার বাছাইয়ের সময় খেলার প্রতি কতটুকু আগ্রহ আছে, ডিসিপ্লিন কেমন এসব দেখতে চাই আমি। কোয়ালিটির চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেই মনের চাহিদা, ইচ্ছা, ত্যাগ স্বীকার করতে পারবে কিনা, এগুলোর দিকে। ফিজিক্যাল ফিটনেস চোখে দেখেই সিদ্ধান্ত নিতে হয় আমাদের। ৯০% খেলোয়াড়ই আনফিট থাকে। রানিং, মুভিং সবকিছু শেখাতে হয় একদম শুরু থেকে।”

কোচ, খেলোয়াড়দের চাওয়া দুর্ভাবনা থেকে মুক্তি

‘সি’ লাইসেন্স করা শহীদুলের হাত ধরে গত বছর পাইওনিয়ারে রানার্সআপ হয়ে তৃতীয় বিভাগে উঠেছিল উত্তরবঙ্গ এফসি। উত্তরা ফুটবল ক্লাব (তৃতীয় বিভাগ), উত্তরা আজমপুর ক্লাব (দ্বিতীয় বিভাগ), বসুন্ধরা কিংসের বয়সভিত্তিক দলেও কাজ করেছেন তিনি। ৩৫ বছর বয়সী শহীদুলের বিশ্বাস, দুঃশ্চিন্তা থেকে একটু মুক্তি মিললে মিললে কোচ, খেলোয়াড় সবার পথচলাটা মসৃণ হয়ে যায় অনেকটা।

“৯০ ভাগ খেলোয়াড় আসে অভাবী পরিবার থেকে। ওদের ন্যূনতম বেতন দিতে পারলেও হবে। তাহলে খেলোয়াড়দের তাদের পরিবার নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করতে হবে না, মন দিয়ে খেলতে পারবে। তৃণমূল থেকে অনেক খেলোয়াড়ও উঠে আসবে।”

“তৃণমুলে আমারা যারা কোচিং করাই, আমরাও কিন্তু আর্থিকভাবে লাভবান হই না। অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের পকেট থেকেও ঘাটতি ভরতে হয়। আমাদেরও নিশ্চয়তা দরকার। তাহলে ভালো কোচের সঙ্কট কেটে যাবে। আমার ধারণা, এই পর্যায়ে সব মিলিয়ে কোচ আছে হাজারখানেক কিন্তু ভালো কোচ খুবই কম। ফুটবলের উন্নয়নে এ সমস্যাগুলোর সমাধান জরুরি।”