ঘরোয়া ফুটবলের এই পর্যায়ের নানা সমস্যা ও সমাধানের পথ নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর সঙ্গে কথা বলেছেন একাধিক কোচ। তাদের কথায় উঠে এসেছে ফুটবলার তৈরির এই ধাপগুলোর নানা সাদা-কালো দিক। ধারাবাহিক এই আয়োজনে কোচ মনোয়ার জানিয়েছেন তার ভাবনা।
পারিশ্রমিকের দীনতা, ফুটবলারদের অসহায়ত্ব
‘অনেকেই আমাকে পছন্দ করে না’, বলে হাসেন মনোয়ার। সেই হাসিতে নেই ‘খুশি।’ বরং ফুটে ওঠে বিষন্নতার রেশ। মিশে থাকে ক্ষোভও। খেলোয়াড়দের সুযোগ-সুবিধার কথা একটু বেশি ভাবেন বলে যে প্রায়ই ক্লাব কর্মকর্তাদের বাঁকা নজরে পড়তে হয় এই কোচকে!
তারপরও নিজের ভাবনার সঙ্গে আপোস করেননি ৫১ বছর বয়সী এই কোচ। নিজের খেলোয়াড়ী জীবনে ‘মোটা অঙ্কের’ পারিশ্রমিক পেয়েছেন। এত বছর পরে নিজের শিষ্যদের অর্ধেকেরও কম পেতে দেখলে তার ভালো লাগবে কেন! সেই উদাহরণ টেনেই বললেন আক্ষেপের কথা।
“আমি যখন দ্বিতীয় বিভাগে খেলেছি, এক মৌসুমে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে খেলেছি। এটা ১৯৮৫-৮৬ সালের কথা। তিন যুগ পর এসে সেই একই পর্যায়ে কোনো খেলোয়াড়কে যদি ২০ হাজার টাকায় খেলতে বলা হয়, তাহলে চলবে কীভাবে!”
তার পরও অনেকে খেলছেন ওই পারিশ্রমিকেই। মনোয়ারের জানালেন, কেউ খেলছেন ফুটবল প্রেমের টানে, কেউ খেলতে বাধ্য হচ্ছেন অসহায়ত্ব থেকে।
“খেলোয়াড়দের কিছু করার নেই। ওদের অনেকে আসে নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে। ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে আসে। নিরুপায় হয়ে শেষ পর্যন্ত এই প্রস্তাব মেনে নিয়েই খেলে ছেলেগুলো।”
“এক মৌসুমে খেলতে হলে অন্তত দুই জোড়া বুট লাগে। এই বাজারে দুই জোড়া সিনথেটিক বুট কিনতে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা লাগে। এখন বলুন, এই টাকা কি ওরা বাড়ি থেকে নিয়ে আসবে? তবে হ্যাঁ, যারা একটু ভালো মানের দল গড়তে চায়, তারা একটু বেশি টাকা দেয়। কিন্তু সেটাও যথেষ্ট নয়।”
১৯৯৪ সালে কোচিং ক্যারিয়ার শুরু মনোয়ারের। চ্যাম্পিয়নশিপ লিগের (বিসিএল) গত আসরে তার হাত ধরে চতুর্থ হয়েছিল ফরাশগঞ্জ স্পোর্টিং ক্লাব। আসন্ন বিসিএলে তার হাল ধরার কথা গত আসরে সপ্তম হওয়া ইয়াংমেন্স ফকিরেরপুলের। ‘বি’ লাইসেন্সধারী এই কোচ পথচলার বাঁকে বাঁকে দেখেছেন ঘরোয়া ফুটবলের নানা দিক। সেই অভিজ্ঞতা থেকে খেলোয়াড় ও ক্লাব, দুই পক্ষকে বিধঁলেন সমালোচনার তিরে।
ফুটবলারদের কথাই বললেন শুরুতে। একনিষ্ঠভাবে স্বপ্নকে তাড়া করার মতো নিবেদন উঠতি ফুটবলারদের মতো কমই দেখতে পান এই কোচ।
“প্রথমে বলি খেলোয়াড়দের কথা। এখনকার তরুণদের মধ্যে আগের খেলোয়াড়দের মতো ডেডিকেশন নেই। ক্যাম্পে ৩০ জন খেলোয়াড় থাকলে, খুব বেশি হলেও পাঁচজন নিষ্ঠাবান খেলোয়াড় পাওয়া যায়। মাঝ পথে এসে ডিসিপ্লিনের কারণেও অনেককে ছাঁটাই করতে হয়। অথচ আমাদের সময় খেলোয়াড়রা ছিল ফুটবল পাগল।”
ক্লাবের মানসিকতা নিয়েও তার অভিযোগের কথা অকপটে বললেন মনোয়ার। সাফল্যের তৃষ্ণা যতটা, ক্লাবগুলির তার চেয়ে বেশি থাকে খরচের ভয়। অবশ্য ক্লাবগুলির বাস্তবতাও বোঝেন তিনি।
“তৃতীয়, দ্বিতীয় বা প্রথম বিভাগ ফুটবলে অতটা নয়, যতটা বিসিএল থেকে প্রিমিয়ার লিগে ওঠার সময় দেখা যায়। লিগে দল চালানোর খরচ বেশি হওয়ার ভয়ে অনেক ক্লাবই বিসিএলে সাফল্য পেতে চায় না। নিঃসন্দেহে এটা খেলোয়াড়, কোচদের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।”
“অবশ্য ক্লাব কর্মকর্তাদেরও যে একেবারে কষ্ট হয় না, তা নয়। অনেক ক্ষেত্রে পরিস্থিতির কারণে, বিশেষ করে আর্থিক অভাবের কারণেও সাফল্য পেতে চান না তারা। কিন্তু যে কারণেই হোক না কেন, এতে করে শেষ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্থ হয় ফুটবলই।”
কোচ মনোয়ার বেশ কড়া। ক্যাম্পেই কাটান দিন-রাত। ক্যাম্প চলাকালীন খেলোয়াড়দের মোবাইল ‘সিজ’ করে রাখেন। সারাদিনে এক ঘণ্টার জন্য অনুমতি দেন মোবাইল ব্যবহারের। শৃঙ্খলার প্রশ্নে আপোসহীন এই কোচ খিলগাঁও ফুটবল একাডেমি, ঢাকা জুনিয়র এফসি, নবাবপুর স্পোর্টিং ক্লাবকে তৃতীয় থেকে দ্বিতীয় বিভাগে তুলেছেন। তার হাত ধরে বাংলাদেশ বয়েজ প্রথমবারের মতো খেলেছে প্রথম বিভাগ ফুটবলে।
খেলোয়াড় মনোয়ার পারেননি জাতীয় দলের চৌকাঠ পেরুতে। থেমে যান অনূর্ধ্ব-২৩ দল পর্যন্ত গিয়ে। খেলোয়াড়ী জীবনের আক্ষেপই হয়তো কোচ হিসেবে তার নিরন্তর ছুটে চলার প্রেরণা। শিষ্যদের জয়ী হিসেবে দেখার তাড়না তার বেশি। এজন্যই ফুটবলারদের তিনি শোনান লড়াই জয়ের গান।
বঞ্চনা সয়ে, খেয়ে-না খেয়ে, সস্তা দরের বুট পরে খেলে হলেও উত্তরসূরিরা উঠুক চূড়ায়-এটিই তার চাওয়া।
“পাইওনিয়ার থেকে বিসিএল পর্যন্ত প্রতিবন্ধকতা অনেক। এগুলো থাকবে এবং আমাদের তা মেনে নিয়ে চলতে হবে। খেলোয়াড়দের মানসিকতা থাকতে হবে, কীভাবে খেলে জায়গা করে নেবে, কীভাবে ভালো করে পরের ধাপে যাবে, সেদিকে।”
“মানসম্পন্ন খেলোয়াড় তৈরি করতে হলে ক্লাব বা যারা সংগঠক, তাদেরও খেলোয়াড়দের প্রতি আরও যত্নবান হতে হবে। আর্থিক দিকটা দেখতে হবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। ছেলেদের খাবার ও পুষ্টির দিকে নজর দিতে হবে শতভাগ।”