অবশ্য গত মৌসুমেও রীতিমত দাপুটে ফুটবল খেলেছেন দুজন। নিজ নিজ দলে করেছেন রাজত্ব।
২০১৮-১৯ মৌসুমে ইউভেন্তুসে যোগ দিয়ে প্রথমবারেই রোনালদো হন দলের শীর্ষ গোলদাতা। জিতে নেন ইতালির শীর্ষ লিগ সেরি আর মৌসুম সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার।
মেসি তো ছিলেন আরও সফল। ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সে ছিলেন দ্যুতিময়। বছর জুড়ে জাদুকরি ফুটবলে গোলের পর গোল করেছেন, সতীর্থদের গোলে অবদান রেখেছেন। দলকে লা লিগা জিতিয়ে হয়েছেন ২০১৯ সালের ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলার। মৌসুমের পিচিচি ট্রফি ও ইউরোপিয়ান গোল্ডেন বুটও ওঠে তার হাতে।
গত ১০ বছরে ফুটবল বিশ্বকে শাসন করা এই জুটি মিলে করেছেন ১৩৬৯ গোল (মঙ্গলবারের ম্যাচের আগ পর্যন্ত)। জিতেছেন ৯টি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ট্রফি। মেসি ছয়বার, রোনালদো পাঁচবার জিতেছেন বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কার। পাঁচবার করে জিতেছেন ব্যালন ডি’অর।
আসলেই কি শেষের শুরু?
কোনো কিছুই চিরজীবন থাকে না। এক ছন্দেও এগিয়ে যাওয়া যায় না। একটা সময় ছন্দপতন ঘটেই। ২০০৫-০৬ মৌসুমের পর এবারই প্রথম কোনো মৌসুমে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দুজনে মিলে ৫ গোলের কম করেছেন।
১১ বছরের মধ্যে গত মৌসুমে প্রথমবার দুজনেই বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কার জিততে ব্যর্থ হন। এবারও জিততে পারেননি উয়েফা বর্ষসেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার। সেটি জিতেছেন লিভারপুলের ভার্জিল ফন ডাইক। তবে গত সপ্তাহে ‘দ্য বেস্ট ফিফা মেনস প্লেয়ার’ জিতে নিয়েছেন মেসি।
২০১০-১১ মৌসুমের শুরু থেকে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৪৭৬ ম্যাচ খেলেছেন মেসি। ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগে যে কারোর চেয়ে বেশি। ৪৫২ ম্যাচ খেলে তালিকার তিন নম্বরে রোনালদো।
মেসিকে ঘিরে এবারের চিত্র অবশ্য ভিন্ন। মৌসুমে এখন পর্যন্ত লিগের সাত ম্যাচে মাত্র ৯০ মিনিট খেলেছেন তিনি। মৌসুমের শুরুতে চোট পেয়ে এক মাসের বেশি সময় বাইরে থাকার পর সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি ফেরেন মাঠে। দুই ম্যাচে বদলি হিসেবে খেলার পর গত সপ্তাহে ভিয়ারিয়ালের বিপক্ষে শুরুর একাদশে নেমে আবার চোট পেয়ে ছিটকে যান। এরই মধ্যে অবশ্য অনুশীলনে ফিরেছেন আর্জেন্টাইন তারকা। বুধবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ইন্টার মিলানের বিপক্ষে ম্যাচে দেখা যেতে পারে তাকে।
২০১৮-১৯ মৌসুমে ৫০ ম্যাচ খেলে ৫১ গোল করেছিলেন মেসি। সেখানে এবার এখন পর্যন্ত খেলা ১২০ মিনিটে পাননি গোলের দেখা। মেসি ভক্তদের জন্য যা দুশ্চিন্তার কারণ।
এই মৌসুমে চোটের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে রোনালদোরও। ২০১৪-১৫ মৌসুম থেকে তুলনামূলক তার গোলও কমেছে বেশ।
গত মৌসুমে ৪৩ ম্যাচে ২৮ গোল করেন রোনালদো। তবে নতুন ঠিকানায় নতুন সতীর্থদের তুলনায় তা বেশ ভালো। তবে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ছাড়ার পর গোলের হিসেবে এটাই তার সবচেয়ে খারাপ মৌসুম।
আবার ২০১১-১২ মৌসুমের পর এবারই প্রথম তিনি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গোল্ডেন বুট জেতেননি বা কারো সঙ্গে ভাগাভাগি করেননি। আর সেরি আর গোলদাতার তালিকায় ছিলেন চতুর্থ স্থানে। সাম্পদোরিয়ার ৩৬ বছর বয়সী ইতালিয়ান ফরোয়ার্ড ফাবিও কুয়াইয়েরেল্লার চেয়ে পাঁচ গোল কম করেন ৩৪ বছর বয়সী রোনালদো।
তবে এখনও যে যথেষ্ট গোল করার সামর্থ্য আছে তার আছে, এর প্রমাণও চলতি মৌসুমে এরই মধ্যে দিয়েছেন পর্তুগিজ ফরোয়ার্ড। দেশ ও ক্লাব মিলে আট ম্যাচে আট গোল করেছেন তিনি। সবশেষ চোট কাটিয়ে গত শনিবার স্পালের বিপক্ষে লিগ ম্যাচে ফিরেই গোল করেন রিয়াল মাদ্রিদ ও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সাবেক তারকা।
একটা জায়গায় অবশ্য একইসঙ্গে স্বস্তি ও অনুপ্রেরণা পেতে পারেন রোনালদো। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বয়স্ক খেলোয়াড়দের মধ্যে শীর্ষ গোলদাতারা ইতালির ফুটবলে ছিলেন।
২০১০-১১ মৌসুমের পর থেকে ৩৪ বছর বা তার বেশি বয়সী ছয় জন খেলোয়াড় ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগে ৩০ বা তার বেশি গোল করেছেন। এর মধ্যে চার জনই সেরি আয়।
৩৪ বছর পূর্ণ করার পর ইতালির সাবেক ফরোয়ার্ড লুকা তনি ফিওরেন্তিনা ও ভেরোনার হয়ে সেরি আয় ৫৬ গোল করে করেছিলেন। দেশটির আরেক সাবেক ফরোয়ার্ড আন্তোনিও দি নাতালে একই বয়সে উদিনেসের হয়ে ৫৪ গোল করেছিলেন।
ফ্রান্সেসকো তত্তি রোমার হয়ে করেন ৪৩ গোল। গত মৌসুমের গোল্ডেন বুট জয়ী কুয়াইয়েরেল্লা করেন ৩০ গোল এবং এখনও গোল করে যাচ্ছেন।
মেসি ও রোনালদো-দুজনেই ক্যারিয়ার শুরু করেন অনেক অল্প বয়সে। ফলে লম্বা সময় ধরে খেলায় সম্ভাব্য শেষের আগে তাদের জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে সেটা খুব একটা অপ্রত্যাশিত হবে না।
২৩ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে ১৮৪ ম্যাচ খেলেন রোনালদো। এর আগে পর্তুগালের শীর্ষ লিগে খেলেন ২৫ ম্যাচ। ওই সময়ে মেসি লা লিগায় খেলেন ১৪৪ ম্যাচ।
তবে ৩৪ বছর বয়সের পরে যারা ৩০ গোল করে করেছিলেন তাদের একজন মাত্র ২৩ বছর বয়সের আগে ইউরোপিয়ান শীর্ষ পাঁচ লিগে ১০০ এর বেশি ম্যাচ খেলেছিলেন; রোমার হয়ে তত্তি খেলেছিলেন ১৫০ সেরি আ ম্যাচ।
মেসি ও রোনালদোর ক্যারিয়ারের শুরুর সময়ের ম্যাচ সংখ্যা ওয়েইন রুনি ও মাইকেল ওয়েনের কাছাকাছি। ২৩ বছরের আগে প্রিমিয়ার লিগে রুনি ২০১ ও ওয়েন ১৬৮ ম্যাচ খেলেছিলেন। অনেকের ধারণা, আগে ভাগে এত বেশি ম্যাচ খেলার চাপ নেওয়ার কারণেই এই দুজনের ক্যারিয়ার মেসির বয়সে আসার আগেই শেষ হয়ে গেছে।
গোলের অধিকাংশ রেকর্ডই নতুন করে গড়েছেন সময়ের সেরা এই দুই ফুটবলার। তারপরও কিছু এখনও বাকি আছে।
লা লিগার সর্বোচ্চ গোলের মালিক মেসি একই সঙ্গে বার্সেলোনা ও আর্জেন্টিনারও রেকর্ড গোলদাতা। রোনালদোর দখলে আছে রিয়াল মাদ্রিদ, পর্তুগাল ও ইউরোপিয়ান কাপ বা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গোলের রেকর্ড।
লা লিগার গোলদাতার তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে আছে রোনালদো। ক্লাব ফুটবলে ইউরোপের শীর্ষ প্রতিযোগিতায় দুই নম্বরে আছেন মেসি।
বাকি আর কি?
সেপ্টেম্বরে লিথুয়ানিয়ার বিপক্ষে সবশেষ ম্যাচে চার গোল করে আন্তর্জাতিক ফুটবলে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড নিজের করে নেওয়ার সম্ভাবনা জোরালো করেছেন রোনালদো। জাতীয় দলের হয়ে বর্তমানে তার মোট গোল ৯৩টি। আন্তর্জাতিক ফুটবলে সর্বোচ্চ গোলের তালিকায় ১০৯ গোল নিয়ে শীর্ষে আছেন ইরানের সাবেক ফরোয়ার্ড আলি দাই।
ক্লাব ফুটবলের ইউরোপের শীর্ষ প্রতিযোগিতায় একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে ছয়বার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বাদ পেয়েছেন ১৯৫০ ও ১৯৬০ এর দশকে রিয়াল মাদ্রিদে খেলা উইঙ্গার পাকো গেন্তো। রেকর্ডটিতে ভাগ বসাতে রোনালদোর এটি জিততে হবে আরেকবার। সেটা হলে দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে ডাচ ফুটবলার ক্লারেন্স সিডর্ফের পর তিনটি ভিন্ন ক্লাবের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতবেন রোনালদো।
ফুটবল বিশ্বে আধিপত্য করলেও স্বপ্নের বিশ্বকাপ শিরোপায় চুমু আঁকতে পারেননি দুজনের কেউই।
রোনালদো অবশ্য ২০১৬ ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ ও ২০১৯ সালের উয়েফা নেশন্স লিগ জিতে আন্তর্জাতিক শিরোপার স্বাদ পেয়েছেন।
মেসির সামনে ২০২০ কোপা আমেরিকা ও ২০২২ বিশ্বকাপ সেই অপূর্ণতা ঘোচানোর শেষ সুযোগ।
শনিবার স্পালের বিপক্ষে করা গোলটি ধরে রোনালদোর মোট ক্লাব গোল ৬০৪। মেসির (৬০৩) চেয়ে একটি বেশি। ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগে ৪১৯ গোল নিয়ে দুজনে যৌথভাবে আছে শীর্ষে। রোনালদোর মোট লিগ গোল ৪২২; তবে স্পোর্তিং লিসবনে করা তিনটি গোল এখানে বিবেচ্য নয়।
তাহলে এতসব রেকর্ডের পরেও আরও কি কি রেকর্ড ভাঙতে পারে তারা দুজনে। সামনে আছে কিছু।
জাতীয় দলের গোল মিলে রোনালদোর মোট গোল ৬৯৭টি। মেসির গোল ২৫টি কম। তাদের উপরে আছেন শুধু রোমারিও (৭৭২), পেলে (৭৬৭), ফ্রেঙ্ক পুসকাস (৭৪৬) ও জার্ড মুলার (৭৩৫)। দুই ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি রোমারিও ও পেলের দাবি, তারা ১ হাজারের বেশি গোল করেছেন। তবে সেই হিসাবটা প্রীতি ম্যাচ মিলে।
কিছুদিন আগে রোনালদো তার ভবিষ্যৎ ভাবনায় বলেছিলেন, তিনি ৪০ বছর বয়স পর্যন্তও খেলতে পারেন। সত্যিই সেটা যদি সম্ভব হয় তাহলে আগামী মৌসুমগুলোয় গড়ে ১৩ গোল করলেও এই রেকর্ডের মালিক বনে যাবেন তিনি।