অনূর্ধ্ব-১৭ বছর বয়সী বালিকা বিভাগের ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইলে রেকর্ড গড়া দিয়ে শুরু জুনাইনার। রোববারই রেকর্ড গড়ে জিতেছেন ২০০ মিটার ইনডিভিজুয়াল মেডলি ও ৪০০ মিটার ফ্রিস্টাইলের স্বর্ণপদক। সোমবার দ্বিতীয় দিনে ১০০ মিটার ব্যাকস্ট্রোকেও সোনা জিতে শুরু। পরে ৪০০ মিটার ইনডিভিজুয়াল মেডলি, ২০০ মিটার ফ্রিস্টাইল ও বাটারফ্লাই এবং ৫০ মিটার ফ্রিস্টাইলে সেরা হতে রেকর্ড গড়েছেন।
‘রেকর্ড নিয়ে ভাবি না’
জুনাইনা এই সাফল্যে একটুও বিস্মিত নন। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানালেন, শুধু নিজের সেরাটা দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে সুইমিং পুলে নেমেছিলেন। দিতে পেরেছেন এবং রেকর্ড হয়ে গেছে!
“আসলে আমি রেকর্ড বা সেরা হওয়ার চিন্তা করে পুলে নামি না। আমি শুধু আমার সর্বোচ্চটা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আমাকে অবশ্যই আরও ভালো টাইমিং করার জন্য চেষ্টা করতে হবে। যদি সুযোগ পাই, তাহলে বাংলাদেশের হয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেব। বাবা এটা খুব করে চান।”
“আমি সারা বছরই অনুশীলন করি। কোনো বিরতি দেই না। দিনে অন্তত চার ঘণ্টা অনুশীলন করি। সপ্তাহে সাতদিনই। এখানে এসে অল্পসল্প যা দেখেছি-আমার মনে হয়, আমি এখানকার সাঁতারুদের চেয়ে দশগুণ বেশি অনুশীলন করি।”
মেয়েকে ঘিরে বাবার স্বপ্ন
২০০১ সালে বিয়ে করে সুনামগঞ্জ ছেড়ে লন্ডনে পাড়ি জমান জুবায়ের আহমেদ। তিন মেয়ে এক ছেলে নিয়ে সেখানেই গুছিয়ে নিয়েছেন সংসার। কিন্তু নাড়ির টান ভোলেননি। দেশের জন্য নিজে কিছু করতে পারেননি বলে মেয়েকে দিয়ে স্বপ্ন পূরণের স্বাদ পেতে চাইছেন। লন্ডন থেকে মিরপুরের সুইমিংপুল পর্যন্ত আসতে পার হওয়া ঝক্কি ঝামেলা তাই আর মনে রাখতে চাইছেন না তিনি। আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানালেন সাঁতারু মুস্তাফিজুর রহমান সাগরকেও। তার মাধ্যমে সাঁতার ফেডারেশনের সঙ্গে হয়েছে যোগাযোগটা।
“মেয়ে সাঁতারু হবে, ওইভাবে আসলে কখনও চিন্তা করিনি। ও দৌড়েও ভালো। আসলে খেলাধুলায় মেয়েকে উৎসাহী করে তোলা…যাতে সে ফিট থাকে। ওর বয়স যখন সাত বা আট তখন দেখা গেল, ও দ্রুত সাঁতার শিখছে এবং ভালো করছে। নিজে তো দেশের জন্য কিছু করতে পারিনি কিন্তু যখন মেয়ে ভালো করতে লাগল, তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ওকে দেশের হয়ে খেলানোর।”
“সিলেটে, বিকেএসপিতে অনেকের মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। তবে এখানকার সাঁতারের খোঁজ রাখতাম। লন্ডন অলিম্পিকে যখন সাগর ভাই অংশ নিতে গেলেন, তখন ফেইসবুকে তার সঙ্গে যোগাযোগ করি। উনি খুব ইতিবাচক ছিলেন এবং অনুপ্রাণিত করেছিলেন। এভাবেই যোগসূত্রটা তৈরি হয়।”
“এখান পরিবেশ, সংস্কৃতি, সংস্কার এবং অনান্য বিষয় সম্পর্কে ওকে ভালোভাবে জানিয়েছি, বুঝিয়েছি। এখানে লন্ডনের সুবিধা পাওয়া যাবে না, সেটাও বলেছি। তাকে সেভাবেই তৈরি করেছি। এখন চারপাশের কোনো আচরণে যদি সে আপসেট হয়ে যায়, তাহলে অন্য কথা। কিন্তু ওর দিক থেকে আশা করি কোনো সমস্যা হবে না।”
আশাবাদী শীলা, সতর্ক বাংলাদেশ কোচ
লন্ডনের আলো বাতাসে বেড়ে ওঠা জুনাইনার সাঁতারের প্রতি নিষ্ঠা দেখে মুগ্ধ মাহফুজা খাতুন শীলা। গত এসএ গেমসে দুটি সোনা জেতা এই সাঁতারুর বিশ্বাস আগামী এসএ গেমসে জুনাইনা হতে পারে বাংলাদেশের সোনার মেয়ে।
“ও এখনও ছোট কিন্তু ওর সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে, কোনো সময় বিশ্রামে থাকে না। যতটুকু শুনেছি-ছুটির সময়ও সে অনুশীলন করে। কেউ যদি এভাবে টানা অনুশীলনের মধ্যে থাকে, তার দ্বারা অবশ্যই ভালো কিছু সম্ভব।”
“ওর কাছ থেকে আমাদের সাঁতারুদের অনেক কিছু শেখার আছে। যেমন ধরুন, ওর খাদ্যাভাস, ওর অনুশীলনের নিয়ম কিংবা আমরা যখন কোনো প্রতিযোগিতা বা ক্যাম্প করার পর ছুটি পাই, তখন আমরা হয়ত পুরোই বিশ্রামে কাটিয়ে দেয় কিন্তু সে তা দেয় না-এগুলো শেখাটাও আমাদের সাঁতারুদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।”
“ও এখন যে টাইমিং করছে-সেটা সিনিয়র লেভেলের কাছাকাছি। আমার বিশ্বাস ও সিনিয়র হলে অনেক ভালো করবে। অবশ্যই ও যেভাবে এগুচ্ছে-এভাবে চলতে থাকলে ও আমার মতোই দেশকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পদক এনে দেবে।”
“আমাদের তো অনেক কঠিন বাস্তবতার মধ্যে চলতে হয়। ওর এসব সমস্যা নেই। সচ্ছল পরিবার থেকে এসেছে-লন্ডনে ভালো সুযোগ সুবিধাও পাচ্ছে। পুষ্টিকর খাবার-ভালো যত্ন পাচ্ছে। ফলে ও বাইরের বিষয়ে চিন্তামুক্ত থেকে নিজের কাজে পুরোপুরি মনোযোগ দিতে পারছে। আমি মনে করি, এসএ গেমস টার্গেট করে ওকে এখনই প্রস্তুত হতে হবে।
বাংলাদেশের সুইমিং কোচ পার্ক তায়ে গুন অবশ্য কিছুটা সতর্ক। আরেকটু পরখ করে নিয়ে সিদ্ধান্তে আসতে চাইছেন এই দক্ষিণ কোরিয়ান কোচ।
“সে সুইমিংপুলে ঝড় তুলেছে, ভালো কথা। কিন্তু জাতীয় দলে জায়গা পেতে হলে তাকে আরও অনেক পরিশ্রম করতে হবে। সারা দেশ থেকে বাছাই করা ৫৯ জন সাঁতারু বাছাই করে আমাদের কার্যক্রম চলছে। তাদের সঙ্গে লড়াই করে তাকে টিকে থাকতে হবে। তবে তার আসাটা বাংলাদেশের সাঁতারের জন্য ইতিবাচক বিষয়।”