আবেগ-ভালোবাসায় কান্নাভেজা চোখে সান্তোসে ফিরলেন নেইমার, বৃষ্টি উপেক্ষা করে ২০ হাজার সমর্থকের উপস্থিতিতে তিন ঘণ্টার জমকালো আয়োজনে ঘরের ছেলেকে বরণ করে নিল তার শৈশবের ক্লাব।
Published : 01 Feb 2025, 11:48 AM
অনুষ্ঠান শুরুর বেশ আগেই শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি। কিন্তু ভক্ত-সমর্থকদের ওসব পাত্তা দিলে চলবে কেন! বৃষ্টি উপেক্ষা করেই স্টেডিয়ামে জায়গা করে নিলেন হাজার বিশেক দর্শক। অনেক দর্শকের হাতেই ব্যানার, ‘দা প্রিন্স ইজ ব্যাক।’ স্টেডিয়ামের বাইরে এআই দিয়ে তৈরি করা বিশাল এক গ্রাফিতি, সেখানে নেইমারের মাথায় মুকুট। গ্যালারিতে জায়গা না পেয়ে মাঠের বাইরেও হাজার হাজার মানুষ। নাচ, গান, আতশবাজি আর ফুটবল মিলিয়ে তিন ঘণ্টার মূল আয়োজনটাও হলো দারুণ জাঁকালো।
নেইমার এলেন। কখনও হাসলেন, হাসালেন সবাইকে। কখনও কাঁদলেন, আবেগের স্রোতে সঙ্গী করে নিলেন অনেককে। কখনও ডুব দিলেন স্মৃতিতে, কখনও স্বপ্নাতুর চোখে তাকালেন সামনে। সব মিলিয়ে আবেগ, রোমাঞ্চ আর ভালোবাসার মাখামাখি ঘরের ছেলেকে বরণ করে নিল সান্তোস।
সৌদি আরব থেকে বৃহস্পতিবার সকালে ব্যক্তিগত বিমানে করে সাও পাওলোতে উড়ে যান নেইমার। কয়েক ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে সান্তোসে যান তিনি হেলিকপ্টারে করে।
চুক্তি সইয়ের আনুষ্ঠানিকতা সেরে মূল আয়োজন শুরুর আগে অনুশীলন মাঠে গিয়ে নতুন সতীর্থ ও ক্লাব কর্তাদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করে আসেন নেইমার।
‘দা প্রিন্স ইজ ব্যাক’ শিরোনামে একটি ভিডিও পোস্ট করা হয় সান্তোসের ফেইসবুক পাতায়। শৈশবে এই ক্লাবে পা রাখা থেকে তার বেড়ে ওঠা ও নায়ক হয়ে ওঠার পথচলা তুলে ধরা হয় সেখানে।
১৮ নম্বর জার্সি দিয়ে শুরু করে সান্তোসে ১১ নম্বর জার্সি গায়ে চাপিয়েছেন নেইমার। এবার পাচ্ছেন ক্লাবের ‘আইকনিক’ ১০ নম্বর জার্সি। যে জার্সি গায়ে এই ক্লাবে রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়েছেন পেলে, যে জার্সি এই ক্লাবে খেলে তিনি হয়ে উঠেছেন সর্বকালের সেরাদের একজন, যে জার্সি গায়ে এই ক্লাবকে তিনি পরিচিত করেছেন ফুটবল বিশ্বে। সান্তোস মানেই পেলে। সান্তোসের ১০ নম্বর জার্সি মানেও পেলে।
সেই ভিডিওতে পেলেকে সবটুকু সম্মান জানিয়েই তার জার্সির উত্তরাধিকার হলেন নেইমার। পেলে যে তাকে বলেছিলেন সান্তোসে ফিরতে, সেটিও মনে করিয়ে দিলেন তিনি।
“কিং পেলে, আপনার ইচ্ছা আমার কাছে আদেশের মতো। সিংহাসন ও মুকুট এখনও আপনার, কারণ আপনি চিরন্তন। তবে এই ১০ নম্বর… যে পবিত্র জার্সি প্রতিনিধিত্ব করে সান্তোস ও গোটা বিশ্বের অনেক কিছু, সেই জার্সি গায়ে চাপানো আমার জন্য সম্মানের। আপনার উত্তরাধিকারের সম্মান রাখতে সম্ভাব্য সবকিছু করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।”
তুমুল আতশবাজির শব্দে আর আলোর ঝলকানির মধ্যে মাঠে প্রবেশ করেন নেইমার। সমর্থকদের অভিনন্দনের জবাব দেন দীর্ঘ সময় ধরে। এক পর্যায়ে সবার উদ্দেশে বলেন, ‘ফিরতে পেরে আমি খুবই খুশি। একসঙ্গে দারুণ সময় আমরা কাটিয়েছি এখানে। আরও অনেক কিছু দেখানোর ও করার বাকি আছে…।”
সমর্থকেরা এক পর্যায়ে চিৎকার করে ড্রিবলিং দেখতে চান। ড্রিবল দেখিয়ে নেইমার বলেন, “নান্দনিক খেলার সাহস দেখাতে ঘাটতি থাকবে না আমার…।”
পরে সংবাদ সম্মেলনে নেইমার শোনান সান্তোসে ফেরার সিদ্ধান্তের পেছনের প্রেক্ষাপট।
“কিছু সিদ্ধান্ত আছে, যা ফুটবল বা যুক্তির সীমানার বাইরে। কিছু আছে প্রভাববিস্তারি। স্বীকার করছি, জানুয়ারির শুরুতেও আমি কল্পনা করতে পারিনি যে সান্তোসে ফিরব বা আল-হিলাল ছাড়ব। আমি সেখানে খুশি ছিলাম, আমার পরিবার খুশি ছিল। মানিয়ে নিয়েছিলাম সবকিছুতে এবং খেলার প্রবল তাড়না ছিল।”
“এরপর কিছু ব্যাপার ঘটল এবং আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হতো। প্রতি দিনের অনুশীলনে আমি ভালো অনুভব করছিলাম না এবং সবকিছু খুব ভালোভাবে হচ্ছিল না আমার জন্য। এর মধ্যেই এখানে ফেরার সুযোগ এলো, আমি দ্বিতীয়বার ভাবিনি।”
সান্তোসে ফিরে আবার তিনি শৈশবে ফিরে গেছেন বলেও অনুভব করছেন।
“ফেরার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর প্রথম দিনই বাবাকে বলেছি সবকিছু চূড়ান্ত করে ফেলতে। সবাই খুব খুশি। নতুন প্রাণশক্তি নিয়ে ফিরেছি আমি। এখানে পা রাখার পরই মনে হচ্ছে যেন, বয়স আবার ১৭ হয়ে গেছে। আমি খুবই খুশি, রোমাঞ্চিত ও খেলার জন্য মুখিয়ে আছি।”
১১ বছর বয়সে সান্তোসে পা রেখেছিলেন নেইমার। ১৭ বছর বয়সে এই ক্লাবে হয়েই যাত্রা শুরু করেন পেশাদার ফুটবলে। চার বছরে এই ক্লাবের হয়ে ২২৫টি ম্যাচ খেলে ১৩৬ গোল করেন তিনি, সহায়তা করেন ৬৪ গোলে। ২০১১ সালে কোপা লিবের্তাদোরেস জয়ে রাখেন বড় অবদান, যা ছিল ৫০ বছরের মধ্যে এই টুর্নামেন্টে সান্তোসের প্রথম শিরোপা।
এরপর তিনি সাফল্যময় সময় কাটান বার্সেলোনায়। সেখান থেকে পিএসজি হয়ে ২০২৩ সালে নাম লেখান আল-হিলালে। তবে গুরুতর চোটের কারণে সৌদি ক্লাবটির হয়ে দেড় বছরে স্রেফ সাতটি ম্যাচ খেলতে পারেন তিনি, গোল করেন একটি।
অবশেষে পারস্পরিক সমঝোতায় ৩২ বছর বয়সী তারকা ফিরলেন সান্তোসে। আপাতত চুক্তি ছয় মাসের, পরে যা এক বছর বাড়ানোর সুযোগ আছে। আল হিলালে তার চুক্তির পারিশ্রমিকের সাড়ে ৬ কোটি ডলার বাকি ছিল। সংবাদমাধ্যমের খবর, পারিশ্রমিক আড়াই থেকে তিন কোটি ডলার কমিয়ে সান্তোসে ফিরেছেন তিনি।