দেশে তাদের পরিবারের সব কোম্পানির সব ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করেছে এনবিআরের গোয়েন্দা বিভাগ সিআইসি।
Published : 28 Mar 2025, 10:50 PM
দুবাই থেকে পাথর ও কয়লা আমদানিতে ’রাজস্ব ফাঁকির’ পাশাপাশি বসুন্ধরা আবাসিকে স্পোর্টস কমপ্লেক্সের আয় আর গুলশানে দামি ফ্ল্যাট-গাড়ি কেনার ‘আসল তথ্য’ গোপন করেছেন তারা। এবার দুবাইয়ে ৩৩তলা টাওয়ারে ব্যবসায়ী নেতা বাবা ও ছেলের ‘অবৈধ’ বিনিয়োগের খোঁজ পেয়েছে এনবিআর।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক পরিচালক ফখরুস সালেহীন নাহিয়ান ও তার বাবা চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সাবেক সভাপতি ফখর উদ্দিন আলী আহমেদের কর ও বিনিয়োগ বিষয়ক ‘অনিয়মের’ এসব তথ্য পাওয়ার দাবি রাজস্ব আহরণকারী সংস্থাটির।
ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, দেশে তাদের পরিবারের সব কোম্পানির সব ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করেছে এনবিআরের গোয়েন্দা বিভাগ সিআইসি।
’কর ফাঁকির’ অনুসন্ধানে নেমে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল-সিআইসি দেশে ও বিদেশে বাবা ও ছেলের ব্যবসা, সম্পদ ও বিদেশে বিনিয়োগের বিষয়ে এসব তথ্য জানতে পারে।
দুবাইয়ে ২২৪টি অ্যাপার্টমেন্টের ৩৩তলা সুউচ্চ টাওয়ারে তাদের ’বিনিয়োগ’ থাকার তথ্যপ্রমাণ পাওয়ার কথাও সিআইসি তাদের প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে।
তাদের একদল গোয়েন্দা সম্প্রতি আরব আমিরাতের এ নগরীতে বাংলাদেশিদের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানে নেমে তাদের ’বিনিয়োগের’ বিষয়েও খোঁজ পায়।
পিতা ফখর উদ্দিন ও ছেলে নাহিয়ান তাদের পারিবারিক ব্যবসা পাথর ও কয়লা আমদানির তথ্য গোপন করে এবং দেশে থাকা সম্পদে বিনিয়োগ করে প্রায় ৬০ কোটি টাকা আয়কর ফাঁকি দিয়েছেন বলেও এনবিআরের তদন্তে উঠে এসেছে।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক পরিচালক নাহিয়ান বলেছেন, কোনো ধরনের অনিয়ম তারা ‘করেননি’।
দেশের পর্যটন খাত, পুঁজিবাজার, জনশক্তি রপ্তানিসহ কয়লা ও পাথর আমদানির ব্যবসা রয়েছে সিলেটের এ ব্যবসায়ী পরিবারের। তাদের মালিকানায় রয়েছে হোটেল স্টার প্যাসিফিক, ক্যাসাব্লাঙ্কা হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট, সিলেট কমিউনিকেশন্স সিস্টেমস লিমিটেড ও ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটিজ লিমিটেড।
সিআইসির প্রতিবেদন বলছে, দুবাইয়ের আল বারশা এলাকায় ‘স্যাফায়ার ৩২’ নামের আধুনিক সুবিধা সম্বলিত একটি টাওয়ার ব্লকে ওই পরিবারের মালিকানা পাওয়া গেছে।
চলমান এ প্রকল্পে ২২৪টি অ্যাপার্টমেন্ট হওয়ার কথা। এর মধ্যে রয়েছে স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট; এক, দুই ও তিন বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্ট। সঙ্গে কমন স্পেস, জিম, সুইমিং পুলের মত নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা।
সিআইসির দাবি, এ প্রকল্পে ফখরুস সালেহীন নাহিয়ান ও ফখর উদ্দিন আলী আহমেদের ১৩ শতাংশ মালিকানা থাকার প্রমাণ তারা অনুসন্ধানে পেয়েছে।
নাহিয়ান ২০২৪ সালের ২ জুলাই চুক্তি হওয়ার কথা বললেও এ প্রকল্পের জমকালো উদ্বোধন হয় ৬ জুলাই এবং টাওয়ারটির নির্মাণ শুরু হয় ২০২৩ সালের অক্টোবরে।
নাহিয়ান ও তার বাবা ছাড়াও আবদেননাসের মোহাম্মদ সাদেক নামের এক ব্যক্তি আছেন এ টাওয়ারের মালিকানায়।টাওয়ারটি নির্মাণ করছে দার আল কারামা রিয়েল এস্টেট।
সিআইসির একজন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে এ বিনিয়োগের অনুমতি নেননি নাহিয়ান বা তার বাবা।
“দুবাইতে সে টাকা পাচার করে থাকতে পারে পাথর আমদানির আড়ালে, সেটা এখনও প্রমাণিত না। তাই কিছু বলতে চাই না। তদন্ত চলমান। কিন্তু দুবাইতে তাদের ইনভেস্টমেন্ট পাওয়া গেছে, এটাও সত্যি।”
সিআইসির কোনো কর্মকর্তার বক্তব্য দেওয়ার এখতিয়ার না থাকায় তিনি নাম প্রকাশ করতে চাননি।
দুবাইয়ের ওই আবাসন প্রকল্পে মালিকানা থাকার কথা স্বীকার করলেও ফখরুস সালেহীন নাহিয়ান দাবি করেছেন, বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার করে নয়, বরং ’সিরিয়ান এক বন্ধুর পরিবার থেকে সেলস এজেন্ট’ হিসেবে পাওয়া কমিশনের টাকা থেকে তারা ওই বিনিয়োগ করেছেন।
তার ভাষ্য, “আমি যেখানে থাকি না, ওখানে কেন বিনিয়োগ করব। এই জিনিসটা উনারা (এনবিআর) এভাবে করেছে, খুবই অন্যায় হয়েছে আমার সাথে।”
দেশে বিদ্যমান আয়কর আইনে কোনো বাংলাদেশি করদাতার বিদেশে সম্পদ থাকলে তা আয়কর নথিতে প্রদর্শন করা বাধ্যতামূলক।
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বিদেশে অর্থ পাচার নিয়ে ব্যাপক আলোচনার মধ্যে যেসব করদাতার বিদেশে সম্পদ রয়েছে কিন্তু তারা রিটার্নে তা প্রদর্শন করেনি, তাদের খোঁজে করস্বর্গ হিসেবে পরিচিত দেশগুলোতে যাচ্ছে এনবিআরের গোয়েন্দা দল। দুবাইয়ে পাচার করা অর্থের অন্যতম উৎস দেশের তালিকায় বাংলাদেশও রয়েছে।
আয়কর আইন অনুযায়ী, এ ধরনের কোনো সম্পদের তথ্য পাওয়া গেলে তা নিয়ে দেশে-বিদেশে অনুসন্ধান চালানো এবং সমপরিমাণ অর্থ জরিমানা হিসেবে আদায় করা যাবে।
আইনে বিধানটি যুক্ত হওয়ার পর সময় পেরিয়েছে প্রায় আড়াই বছর। তবে অগাস্টে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ নিয়ে সিআইসিসহ অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কাজ শুরু করেছে।
অনুসন্ধানে যা পেয়েছে এনবিআর
সিআইসির প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রথমে কর ফাঁকির অনুসন্ধানে নেমে ফখর উদ্দিন আলী আহমেদ, তার তিন ভাই ফালাহ উদ্দিন আলী আহমদ, সালাহ উদ্দিন আহমেদ ও ফয়েজ হাসান ফেরদৌস এবং ছেলে ফখরুস সালেহীন নাহিয়ানের সারচার্জ ফাঁকি ও প্রকৃত বিনিয়োগের খোঁজ পান তদন্তকারীরা।
দেখা যায়, তারা নিজ নামে পাথর ও কয়লা আমদানি করে তা তাদের অংশীদার কোম্পানির (মেসার্স ফকর উদ্দিন আলী আহমেদ) আয়কর নথিতে ২০১৭-১৮ করবর্ষ থেকে প্রদর্শনের মাধ্যমে শুধু সারচার্জ এবং এ সংক্রান্ত জরিমানা বাবদ (সরল সুদ ব্যতিত) ৫০ কোটি ৮৩ লাখ ৩৩ হাজার ৩৮৬ টাকার আয়কর ফাঁকি দিয়েছেন।
এছাড়া নিজ নামে ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় জমি কেনা এবং সেখানে স্পোর্টস কমপ্লেক্স থেকে ভাড়া বাবদ আয় গোপনের মাধ্যমে এবং গুলশানে ফ্ল্যাট ও দামি গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে প্রকৃত বিনিয়োগ গোপনের মাধ্যমে তারা আয়কর ফাঁকি দিয়েছেন বলে পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।
গুলশানে কমার্শিয়াল স্পেস কেনার ক্ষেত্রে তাদের পারিবারিক কোম্পানি ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটিজ লিমিটেড ‘প্রকৃত বিনিয়োগ গোপনের মাধ্যমে’ আয়কর ফাঁকি দিয়েছে বলেও সিআইসি দাবি করেছে। এর মাধ্যমে বাড়তি আরও আয়কর এবং জরিমানা বাবদ (সরল সুদ ব্যতিত) ৮ কোটি ২৬ লাখ ৪৭ হাজার ৬৭৩ টাকার আয়কর ফাঁকির তথ্য মিলেছে।
এরপর দুবাইয়ে গিয়ে বাবা ও ছেলের বিদেশে বিনিয়োগ গোপনেরও খোঁজ পান তদন্তকারীরা।
সিআইসির ভাষ্য, নাহিয়ান ও ফখর উদ্দিন দুবাইয়ের ওই ৩৩ তলা টাওয়ার প্রকল্পে বিনিয়োগ করলেও তাদের আয়কর নথিতে তা প্রদর্শন করা হয়নি।
সেখানে তারা কত টাকা বিনিয়োগ করেছেন তা তদন্ত করে দেখছেন কর্মকর্তারা। বিনিয়োগের সমপরিমাণ অর্থ জরিমানা হিসেবে আদায়ের জন্য তাদের ব্যাংক হিসাবগুলো অবরুদ্ধ করা হয়েছে।
সিআইসির একজন কর্মকর্তা বলেন, “নিজেদের নামে (পাথর ও কয়লা) আমদানি করে এগুলোতে এ টাকা খেয়ে দিছে। পাথর আবার সে দুবাই থেকেও আনছে। মানে ইউএই থেকে আনছে। দুবাই ঠিক না। ইউএই থেকে আনছে।”
কর ফাঁকি শুধু দুবাই থেকে আমদানি করার সময় করেছে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “কর ফাঁকি দুবাইয়ের সাথে না, পুরো ব্যবসার ক্ষেত্রে। সারচার্জ ফাঁকি দিছে এটা।”
অর্থপাচার হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “মানিলন্ডারিং এর বিষয়টা এখানে আনিনি, খতিয়ে দেখছি। তিনি বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকম বক্তব্য দিচ্ছেন যে, পাথর আমদানি করতে গিয়ে বিভিন্ন নেটওয়ার্ক হয়েছে, অন্য একজন তাকে সেখানে স্টেক দিয়েছে গুড উইল হিসেবে, গোল্ডেন ভিসা দিয়েছে।
“যদিও আমরা দেখছি, উনারা দুবাই থেকে পাথর আমদানি করেছে, এগুলোর ডকুমেন্টেশন আছে। তার মালিকানারও তথ্য পাওয়া গেছে।”
এসব অভিযোগের বিষয়ে ফখরুস সালেহীন নাহিয়ান বলেন, “এটা সত্য না, এটা মিথ্যা কথা। উনাদের (সিআইসি) তো প্রমাণ করতে হবে যে বাংলাদেশ থেকে আমি বিনিয়োগ করেছি।”
তার দাবি, “দুবাই রেসিডেন্সি ভিসা আছে আমার। ব্যবসা করি, বন্ধুবান্ধব আছে বিভিন্ন জায়গায়। আমি ইন্ডিয়ায় পড়ালেখা করেছি। তো বিভিন্ন জায়গায় কিন্তু আমার বন্ধুবান্ধব আছে।
“আর আমি জুনিয়র চেম্বারের সাথেও ছিলাম। তো বিভিন্ন এন্ডে আমার বন্ধুবান্ধব হইছে। তো ওই বন্ধুর সাথে আমি এত ক্লোজ হইছি, ফ্যামিলির সাথে ক্লোজ হইছি। ওই বন্ধু অবশ্য সিরিয়ান। ওর ফ্যামিলির সাথে আমি ক্লোজ হয়ে গেছি। তো হওয়ার পরে ওর বাবা আমাকে ছেলে হিসেবে ডাকে।”
টাওয়ারের মালিকানায় কীভাবে এলেন সেটির ব্যাখ্যা করে তিনি দাবি করেন, “উনি (সিরিয়ান বন্ধুর বাবা) একদিন বলতেছে, ‘বাবা তুমি তো অনেক সময় অনেক কিছু করে দিছ’। অনেক কিছু আমি করে দিছি উনাকে। বাট আই হ্যাভ নেভার আস্কড এনিথিং।
“উনি আমাকে বলেছেন, ‘আমি একটা কোম্পানি খুলতেছি, আমার কোম্পানিতে তোমাকে একটা ছোট অংশে রাখতে চাই। আমি বলছি, আমি অংশতে থাকতে পারব না। দেশের বাইরে আমার কোথাও কোনো ইনভেস্টমেন্ট নাই।
“তো উনি আমাকে বললেন, তোমার টাকা দিতে হবে না। তুমি আমার অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি কর। বিক্রি করে সেলস এজেন্ট হিসেবে তোমার ইনভেস্টমেন্টটা হবে। তো এই এগ্রিমেন্টটা উনাদের সাথে হইছে ২০২৪ সালের জুলাই ২ তারিখ। ওই এগ্রিমেন্টের কপি সব আছে আমার কাছে।”
সে হিসেবে এখনও তার রিটার্নে এ সম্পদ দেখানোর সময় হয়নি দাবি করে নাহিয়ান বলেন, “ওই এগ্রিমেন্ট অনুযায়ী আমার একবছর সময় আছে রিটার্নে দেখানোর যদি আমি ইনভেস্টমেন্ট করে থাকি। বাট আই হ্যাভ নট ইনভেস্টেড এনি পেনি ফ্রম বাংলাদেশ।
“সরকার যেভাবে আমাকে চাপাচ্ছে, সেভাবে মনগড়া হিসাব করে একটা রিপোর্ট দিয়েছে সিআইসি।”
পাথর ব্যবসার আড়ালে বিদেশে সম্পদ গড়েননি দাবি করে তিনি বলেন, “আমাদের পাথর বা কয়লা বলেন, এটা কাস্টমসে একটা ইয়েলো বুক ভ্যালু থাকে, যেটাকে আমরা কাস্টমসের ভাষায় বলি অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু। ধরেন কয়লা যদি প্রতি টন ইমপোর্ট করি বাংলাদেশে, ১০ টাকায় কিনি আর ২০০ টাকায় কিনি, ১১৫ ডলারের উপরে ডিউটি দিতে হচ্ছে সরকারকে। সব জায়গায় অ্যাসেসমেন্ট সমান।
“আমি ৯০ ডলারেও আনছি, ১০০ ডলারেও আনছি, ৮৫ ডলারেও আনছি যখন যেটা রেট ছিল বাজারে ইনডেক্সে। তো এখন সরকার তো ১১৫ ডলারে ডিউটি নির্ধারণ করেছে আমার ওপরে। এখন আমি যদি ৯০ ডলার করে আনি, আমি কী প্রতি টনে ২৫ ডলার লিগ্যালি ট্রান্সফার করতে পারতাম না বাইরে? আমার সুযোগ কি সরকারই করে দেয় নাই? সরকারই তো করে দিছে।”
তবে সেই ‘সুযোগও’ কাজে লাগাননি বলে দাবি করেন নাহিয়ান।
সিআইসির অনুসন্ধান ও অভিযোগের বিষয়ে জানতে ফখর উদ্দিন আলী আহমেদকে ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।