সরকারি চাকরি ছেড়ে দেশ স্বাধীনের ডাকে ছোটেন আজাদ

যুদ্ধে যেতে তিনি ওই সময়ের ১১০ টাকা বেতনের সরকারি চাকরিকে বিদায় জানান।

আবদুর রহমানকুমিল্লা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 March 2023, 01:10 PM
Updated : 25 March 2023, 01:10 PM

সরকারি চাকরি ছেড়ে দেশ স্বাধীনের ডাকে ছোটেন কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার মো. আবুল কালাম আজাদ।

এই যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা জানান, এইচএসসি পাসের পর পাকিস্তানের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে তিনি অফিস সহকারী হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। কর্মস্থল ছিল তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের ইসলামাবাদে। ১৯৬৮ সালে চাকরিতে যোগদানের পর তাকে থাকতে হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে।

মনোহরগঞ্জ উপজেলার দিশাবন্দ গ্রামের পূর্বপাড়ার প্রয়াত লাল মিয়া-বদরের নেছার ছেলে ৭৫ বছর বয়সী আবুল কালাম আজাদ তিন ছেলের জনক।

তার বাড়িতে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে কথা হয় এ প্রতিবেদকের।

তিনি জানান, ইসলামাবাদের সেই চাকরিতে কখনই মন বসেনি তার। কারণ পশ্চিম পাকিস্তানিরা তাকে ভালো চোখে দেখেনি। সব সময় উর্দুতে গালমন্দ শুনতে হত।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ঐতিহাসিক ভাষণ রেডিওতে শোনেন আবুল কালাম। সেই ভাষণ শুনে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেননি ওই সময়ে ২২ বছর বয়সী অবিবাহিত এ তরুণ।

২২ মার্চ ছুটির কথা বলে বাড়ি ফেরেন তিনি। এর তিনদিন পরই ঘটে ২৫ মার্চ কালরাতের গণহত্যা।

২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ডাক দেওয়ার কথা শোনের তিনি। এরপর আজাদ সিদ্ধান্ত নেন, পশ্চিম পাকিস্তানে আর ফিরবেন না।

তিনি বলেন, “চাকরি থেকে ছুটিতে আসার পর আমাকে কয়েকবার চিঠি দিয়েছে, চাকরিতে যোগদানের জন্য। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, শোষকের অধীনে চাকরি করব না। চোখে শুধু স্বপ্ন ছিল একটাই- দেশ স্বাধীন করা।”

সেই স্বপ্ন-নেশায় তিনি ওই সময়ের ১১০ টাকা বেতনের সরকারি চাকরিকে বিদায় জানান। প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন যুদ্ধে যাওয়ার।

মুজিব বাহিনী বা বিএলএফের গেরিলা যোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ প্রশিক্ষণ নেন ভারতে গিয়ে।

“একাত্তরের এপ্রিলে আমি তৎকালীন নোয়াখালীর চোত্তাখোলা সীমান্ত দিয়ে ভারতের আগরতলা চলে যাই। সেখানে যাওয়ার পর শিক্ষিত জেনে আমিসহ কয়েকজনকে বিশেষভাবে রাখা হয়। তখন আমি আ স ম আবদুর রব এবং আমাদের তৎকালীন লাকসামের এমপি জালাল সাহেবের মাধ্যমে স্পেশাল প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ পাই।  

পরে আমাদের দমদম বিমানবন্দর থেকে কার্গো বিমানে করে নেওয়া হয় ভারতের দেরাদুন প্রদেশে। সেখান থেকে আমাকে ট্রাকে করে নেওয়া হয় তানদুয়া নামক স্থানে। সেখানে ২ মাস ১৫ দিন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ভারতের আর্মি আমাদের প্রশিক্ষণ দেয়। সেখানে আমাদের পলিটিক্যালি মোটিভেট করা হয়।”

আজাদ আরও বলেন, “বৃহত্তর লাকসাম অঞ্চলে আমাদের বিএলএফ বা মুজিব বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন ছায়েদুল ইসলাম। কুমিল্লার কমান্ডার ছিলেন নাজমুল হাসান পাখি ভাই। ভারত থেকে ফিরে তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব পাই। একদিন প্রশিক্ষণে গ্রেনেড বিস্ফোরণে হাতে গুরুতর আঘাতে বেঁকে যায় হাতের আঙুল। এখনও হাতে রয়েছে অসংখ্য স্প্লিন্টারের আঘাতের দাগ।”

সেই আঘাতের যন্ত্রণা নিয়ে আজও বেঁচে আছেন এ বীর মুক্তিযোদ্ধা।

আবুল কালাম বলেন, “আমি বিশেষ প্রশিক্ষণ নেওয়ায় আমার দায়িত্ব ছিল যুদ্ধের জন্য সদস্য সংগ্রহ করা। জুলাইয়ের শেষের দিকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেই মুজিব বাহিনীর সদস্য সংগ্রহ ও তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করি। আমি প্রায় ৫০ জনকে সংগ্রহ করে বর্তমান মনোহরগঞ্জ উপজেলার উত্তর হাওলা এলাকায় ক্যাম্প করে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। তখনই গ্রেনেড প্রশিক্ষণ দেওয়ার সময় একটি বিস্ফোরণে আহত হই।”

স্মৃতিচারণে পরিবারের দু’টি বিষয় বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

আজাদ জানান, ওই সময় পাঁচ ভাই-তিন বোন ও তার মা পক্ষে থাকলেও তার বাবা-চাচারা ছিলেন স্বাধীনতা বিরোধী।

এ জন্যই বাবা পরিবারের সবাইকে ত্যাগ করে অন্যত্র বিয়ে করেন। দেশ স্বাধীন হলেও লাল মিয়া আর ফেরেননি তাদের কাছে।

আরেকটি বিষয় আবুল কালাম আজাদের মনকে এখনও পীড়িত করে।

ওই সময় ভারত থেকে ফিরে প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালনের পর থেকেই হানাদার বাহিনীর সদস্যরা তার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।

তিনি জানান, তাকে ধরতে প্রায় দিনই বাড়িতে হানা দিত পাকিস্তানি সেনারা।

“তেমনি একদিন মায়ের দিকে বন্দুক তাক করে উর্দুতে বার বার হুমকি নিয়ে আমার সন্ধান চান পাকিস্তানিরা। কিন্তু মুখ না খুললেও এক পর্যায়ে হানাদারদের আতঙ্কে মা স্ট্রোক করে মারা যান। মাকে দাফনের সময়ও হানাদাররা আমাদের বাড়িটি ঘিরে রেখেছিল। এ জন্য মায়ের জানাজা ও দাফনে অংশ নিতে পারিনি। দূর থেকে চোখের পানিতে শুধু বুক ভাসিয়েছি।”

আবুল কালামের ভাষ্য, “স্বাধীনতার পর আমি অস্ত্র নিয়ে ঢাকা চলে যাই। সেখানে গিয়ে জগন্নাথ হলে ছিলাম। ৭২ এর ১৩ মার্চ আমি ঢাকা স্টেডিয়ামে বঙ্গবন্ধুর কাছে অস্ত্র জমা দিই। তখন আমাদের একটি সনদ দেওয়া হয়। বাবা ত্যাজ্য করে দেওয়ার কারণে আমরা চরম দুর্ভোগে পড়ি। অবশেষে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে আগের পদেই চাকরি ফিরে পাই। আমাদের তখন ভাতাও দেওয়া হয়।

“১৯৭৬ সালে লাকসামে প্রথম বিয়ে করি। কয়েক বছর চাকরির পর সৌদি আরব চলে যাই। এরই মধ্যে আমার প্রথম স্ত্রী মারা যান। এরপর দেশে এসে ১৯৮৮ সালে বরুড়ায় শাহীদা বেগমকে বিয়ে করি। এর মধ্যে বিভিন্ন কাজ করেছি। হোটেলের ম্যানেজার হিসেবেও কাজ করেছি।”

সরেজমিনে আবুল কালাম আজাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে তার বাড়িতে পাকা ভবন নির্মাণ করে দেওয়া হচ্ছে। সেই কাজ এগিয়েছে অনেক দূর।

বর্তমানে পাশের একটি টিনের ঘরে স্ত্রী শাহীদা বেগমকে নিয়ে থাকেন তিনি। বড় ছেলে চাকরি করছেন র‌্যাবে। আর ছোট দুই ছেলে পড়াশোনা করছে।  

তিনি বলেন, “আমার সরকারের কাছে আর চাওয়ার কিছু নেই। সরকার আমাকে ভাতা দিয়েছে, রেশন দিয়েছে। এখন আমার বাড়িতে বিল্ডিংও করে দিয়েছে। আমাকে একটি স্মার্ট কার্ড দিয়েছে। সেখানে অনেক সুবিধা রয়েছে। আমার বাড়ির বিদ্যুৎ বিলও দিতে হয় না।”

“আর কী চাইব সরকারের কাছে,” বলেন আজাদ।

“দেশ স্বাধীনের নেশায় যখন সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলাম; তখন তো ভাবিনি জীবনে এতো কিছু পাব। সুখি-সমৃদ্ধ একটি সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। আমি তেমন একটি বাংলাদেশ দেখে যেতে চাই। এটাই আমার শেষ চাওয়া।”

মনোহরগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল আজিজ বলেন, “যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আবুল কালাম আজাদ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অনেক অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন দেশের জন্য। আমাদের উপজেলায় দুজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে তিনি বর্তমানে বেঁচে আছেন। আমাদের সব মুক্তিযোদ্ধারা তাকে সম্মান করেন, ভালোবাসেন। তিনি স্বাধীনতার সময় এ অঞ্চলের অনেক তরুণ ও যুবককে প্রশিক্ষণ দিয়ে এবং পলিটিক্যালি মোটিভেট করে যুদ্ধে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।”