পরিবেশবান্ধব ইট তৈরির কথা বলে কারখানটিতে গাড়ির টায়ার পোড়ানো হচ্ছিল বলে জানা গেছে।
Published : 06 Jul 2024, 09:00 PM
নরসিংদীর বেলাবতে অনুমোদন ছাড়াই চালু করা একটি কারখানার বয়লার বিস্ফোরণে ছয় শ্রমিক দগ্ধ হয়েছেন।
শুক্রবার বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে বেলাব উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের দুলালকান্দি গ্রামে ‘চায়না ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেড’ নামক একটি প্রতিষ্ঠানে এ ঘটনা ঘটে বলে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. নাজমুল হাসান জানান।
বিস্ফোরণে দগ্ধ শ্রমিকরা হলেন- ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের আকাশ (১৯), সুকান্ত (২৬), লিংকন (১৯), স্টুডেন্ট (২৬), বালচিং (২০) ও বরিশালের মাসুদ (২৪)।
আহতদের ঢাকা শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
বিস্ফোরণের ঘটনার পর অনুমোদনহীন কারখানাটি নজরে আসে স্থানীয় প্রশাসনের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চায়না ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেড নামে কারখানাটিতে পরিবেশবান্ধব ইট তৈরির কথা বলে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছ থেকে ট্রেড লাইসেন্স নেন মালিকপক্ষ। কিন্তু তারা তা না করে বিভিন্ন এলাকা থেকে গাড়ির টায়ার সংগ্রহ করে সেগুলো পুড়িয়ে সড়কে ব্যবহৃত বিটুমিন উৎপাদনের প্রস্তুতি নেয়। যদিও এ বিষয়ে প্রশাসন বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো অনুমোদন কারখানাটির ছিল না।
নারায়ণপুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মো. কাউসার কাজল বলেন, “মাস দুয়েক আগে তারা পরিষদ থেকে পরিবেশবান্ধব ইট তৈরির কথা বলে একটি ট্রেড লাইসেন্স নেয়। এ সময় তারা জানান, ইট তৈরির অন্য কাগজপত্র করতে গেলে প্রথমে নাকি ট্রেড লাইসেন্স দিতে হয়। এ কারণে আমি লাইসেন্স দিই। কিন্তু এটার ভিতরে কী হত তা জানতাম না।”
জেলা পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসনের কাছেও কারখানটির বিষয়ে কোনো প্রকার তথ্য নেই।
কোনো কাগজপত্র না থাকার পরও কারখানাটি কীভাবে উৎপাদনে যায় এ প্রশ্ন এলাকাবাসীর।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের দুলালকান্দি গ্রামের একটি অ্যাগ্রো ফার্মের পরিত্যক্ত জায়গা নিয়ে গড়ে তোলা হয় চায়না ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেড।
চীনের নাগরিকদের মালিকানাধীন এই কারখানায় কাজ দেওয়া হয়নি স্থানীয় কোনো শ্রমিককে। এমন কী, এলাকার কাউকেই ওই কারখানায় ঢুকতেও দেওয়া হত না।
ঈদুল আজহার পর থেকে যাত্রা শুরু করা এই কোম্পানির ভেতরে কী করা হয় তা ছিল এলাকাবাসীর অজানা।
তবে কারখানার কর্মকর্তারা জানান, শুক্রবার ছিল তাদের পরীক্ষামূলক টায়ার পোড়ানোর প্রথম ধাপ। বিকালে বিটুমিন তৈরির বয়লারের পাশে একটি ক্রেন বসানোর কাজ চলছিল।
এ সময় ওয়েল্ডিং মেশিনে জ্বালাইয়ের আগুনের ফুলকি বয়লারের ছাইয়ে গিয়ে পড়ে। এতে বিকট শব্দে বয়লারটি বিস্ফোরিত হয়ে ছয় শ্রমিক দগ্ধ হন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শুনে তারা দৌড়ে যান ওই চায়না কোম্পানির সামনে। কিছু বুঝে উঠার আগেই আহতদের নিজস্ব গাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় হাসপাতালে।
এসময় কাউকে কোম্পানির ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। মূল গেইট তালাবদ্ধ করে দিয়ে স্থানীয়দের জানানো হয়, তেমন কিছু হয়নি, শুধু মেশিনের শব্দ হয়েছে।
তবে অগ্নিদগ্ধ হওয়ার খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে টনক নড়ে স্থানীয় প্রশাসনের।
খবর পেয়ে রাত সাড়ে ১০টার দিকে নরসিংদীর সহকারী পুলিশ সুপার (রায়পুরা সার্কেল) আফসান আল আলম, বেলাব উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্ম্দ নাজমুল হাসান, বেলাব থানার ওসি আজিজুর রহমান, কলকারখানা অধিদপ্তরের দুজন কর্মকর্তা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
পরিদর্শনকালে কারখানায় চীনের ছয়জন নাগরিকসহ প্রায় ৩০ জন শ্রমিককে পাওয়া যায়।
এ সময় তাদের কারখানার অনুমতিপত্রসহ বিভিন্ন কাগজপত্র দেখাতে বললে তারা কিছুই দেখাতে পারেননি।
এদিকে, শনিবার সকালে গিয়ে কারখানাটির গেইট তালাবদ্ধ পাওয়া যায়।
তখন সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে ভেতরে যেতে চাইলে মিটিং চলছে বলে কারখানার নিরাপত্তারক্ষীরা ভেতরে যেতে বাঁধা দেন।
প্রায় দুই ঘণ্টা পর কারখানাটির ভেতরে যাওয়ার অনুমতি মিলে স্থানীয় সাংবাদিকদের।
গিয়ে দেখা যায়, কারখানাটির অফিস কক্ষের সামনে চীনের দুজন নাগরিক বসে আছেন। তারাই মূলত কারখানাটির মালিক।
কথা হয় কারখানার দায়িত্বপ্রাপ্ত সাজ্জাদ হোসেন ও চীনাদের বাঙালি বন্ধু পরিচয় দেওয়া ঢাকা উত্তরার এসএম সিরাজের সঙ্গে।
সাজ্জাদ হোসেন বলেন, “কারখানাটিতে পরীক্ষামূলক উৎপাদনের প্রথম ধাপ ছিল শুক্রবার। অসাবধানতাবশত বয়লারের মুখ বন্ধ করেনি শ্রমিকরা। পাশেই ওয়েল্ডিংয়ের কাজ করার সময় আগুনের ফুলকি এসে পড়ে বয়লারের ছাইয়ের মধ্যে। তখনই বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ছয় শ্রমিক আহত হন।”
আহতদের কোম্পানির খরচে শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে বলে জানান সাজ্জাদ।
তিনি আরো বলেন, “মাসুদসহ দুজন শ্রমিকের অবস্থা একটু খারাপ বাকি চারজন মোটামুটি সুস্থ আছেন।”
কারখানাটির কোনো বৈধ কাগজপত্র বা অনুমোদন আছে কী না জানতে চাইলে তিনি কথা এড়িয়ে বলেন, ‘এটা একটা দুঘর্টনা।’
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা বেলাব উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. নাজমুল হাসান বলেন, “রাতেই খবর শুনে আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। এসময় কারখানার লোকজন তাদের কাগজপত্র আছে জানালেও সেসময় কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেননি।
“তারা বলেছেন, রোববার কাগজপত্র নিয়ে অফিসে আসবেন। প্রাথমিকভাবে আমার মনে হয়েছে, তাদের কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই।”
নরসিংদী জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক সমর কৃষ্ণ দাস বলেন, “চায়না ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং কোম্পানি নামে কোনো কোম্পানির অনুমোদন নেই। তারা পরিবেশ অধিদপ্তরের থেকে কোনো ছাড়পত্রও নেয়নি, কোম্পানিটি অবৈধ।”
বেলাব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আব্দুল করিম বলেন, “ওই কারখানার বিষয়ে কোনো তথ্য আমার জানা নেই।”