প্রশাসন থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, বেড়া উপজেলায় সরকার অনুমোদিত কোনো বালু মহাল নেই।
Published : 01 Nov 2024, 11:05 AM
পাবনার বেড়া উপজেলায় যমুনা ও হুরাসাগর নদীর বিভিন্ন স্থানে গত ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় থাকা প্রভাবশালীরা বালু তুলছিল। সরকারের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বালুর বাণিজ্য চলে গেছে বিএনপির প্রভাবশালীদের হাতে।
৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে ক্ষতিগ্রস্তরা এই ভেবে আশাবাদী হয়েছিলেন যে, দীর্ঘদিন ধরে চলা বালু-দস্যুতা এবার হয়ত বন্ধ হবে। কিন্তু এলাকাবাসীর অনুরোধ উপেক্ষা করে, সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে অবৈধভাবে বালু তুলছে প্রভাবশালী মহলটি।
যদিও উপজেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, বেড়া উপজেলায় সরকার অনুমোদিত কোনো বালুমহাল নেই।
নিজেকে বিএনপির সমর্থক পরিচয় দেওয়া উপজেলার কাজিরহাট এলাকার মো. সামাদ ফকির বলেন, “এখানে এসিল্যান্ড স্যার এসেছিলেন; তিনি সব জানেন।”
বেড়া উপজেলার ইউএনও মো. মোরশেদুল ইসলাম বলেন, “এখানে বৈধভাবে বালু তোলার কোনো সুযোগ নেই। আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি। অবৈধ হলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
বেড়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাদিয়া সুলতানা বলেন, “আমি কাজীরহাটের বালুর ওখানে গিয়েছিলাম, তারা বালুর ক্রয়ের ১৫-২০টা স্লিপ দেখিয়েছেন।”
স্লিপগুলোর বৈধতা আছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমি আরও যাচাই-বাছাই করে দেখব।”
সম্প্রতি উপজেলার কাজিরহাট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, যমুনা নদীর পাড়ে লোহার ব্রিজের পাশেই কয়েকটি খননযন্ত্র দিয়ে বালু তোলা চলছে।
বালু কাজিরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে ফাঁকা জায়গায় স্তূপ করে রাখা হয়েছে। সেখান থেকে বালু বিক্রি করে ড্রাম ট্রাকে পাঠানো হচ্ছে বিভিন্ন স্থানে।
এ কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইঞ্জিনচালিত বাল্কহেড চার থেকে ১০ হাজার ঘনফুট বালু ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন।
খনন যন্ত্রে বালু তুলে এসব বাল্কহেডে পরিবহন করে কাজিরহাট এলাকায় আনছেন তারা।
তাদের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, কয়েকটি স্তূপেই মজুত রয়েছে কয়েক লাখ ঘনফুট বালু।
সংবাদকর্মীরা বালুর স্তূপের ছবি তুলতে গেলে হঠাৎ সেখানে তেড়ে আসেন মো. সামাদ ফকির।
ক্ষিপ্ত হয়ে রাগত স্বরে তিনি বলেন, “এই ভাই, আপনি কিসের সাংবাদিক? বালুর ছবি তুললেন কেন? ছবি ডিলিট করেন তাড়াতাড়ি!”
তিনি নিজেকে সাংবাদিক ও বিএনপির সমথর্থক পরিচয় দিয়ে বলেন, “টাকা-পয়সা খরচ করে ব্যবসা করছি। গত ১৫ বছর প্রশাসন অনেক জ্বালাইছে। বাড়িতে থাকতে পারি নাই।”
এখন ‘এসব নিয়ে ঝামেলা করা যাবে না’ বলে নানাভাবে ভয়ভীতিও দেখান তিনি।
কাজীরহাট এলাকার বালু তোলার ব্যাপারে আব্দুল বাতেন ফকিরের কথা জানতে পেরে মোবাইলে কল করা হলে তিনি বালু তোলার কথা অস্বীকার করেন।
বাতেন বলেন, “আমরা আরিচা থেকে বালু কিনে এনে আনলোড করে রেখে বিক্রি করছি।”
পাশেই নদীতে খনন যন্ত্রের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ড্রেজারগুলো আমার, তবে আমরা এখান থেকে বালু কাটি না।”
এসব জানতে চাওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করে তিনি বলেন, “আপনি কি নিউজ করবেন? আমি কিন্তু বেড়া উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক। নিউজ করার দরকার নেই, আপনি আসেন চা খাই আর কথা বলি।”
দলীয় পরিচয়ে অবৈধ ব্যবসার সুযোগ নেই জানিয়ে পাবনা জেলা যুবদলের আহ্বায়ক ইলিয়াস আহম্মেদ হিমেল রানা বলেন, “বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যেকোনো অবৈধ কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান ঘোষণা করেছেন। দলীয় প্রভাব খাটিয়ে দস্যুতা করার সুযোগ নেই। অবৈধ কাজের তথ্য-প্রমাণ থাকলে দ্বিধাহীন চিত্তে সংবাদ প্রকাশ করুন। প্রশাসন ব্যবস্থা নিক।”
স্থানীয়দের অভিযোগ, নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বালু তোলায় প্রতিবছরই নদী ভাঙনে তীরবর্তী এলাকার মানুষ ভিটেমাটি হারালেও নির্বিকার ভূমিকায় ছিল প্রশাসন।
রাতের অন্ধকারে উপজেলার কাজীরহাট, ঢালারচর, বেড়া পৌর এলাকার মোহনগঞ্জ পায়না মহল্লায় যমুনা নদী থেকে বালু তুলে চক্রটি।
হাটুরিয়া-নাকালিয়া ইউনিয়নের চর নাগদাহ, হাটাইল আড়ালিয়া, চরসাড়াশিয়া গ্রাম ও নতুন ভারেঙ্গা ইউনিয়নের লেওলাই পাড়াসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে সক্রিয় বালুদস্যুরা।
অপ্রতিরোধ্য বালু তোলার ফলে এসব এলাকায় বর্ষার শুরু থেকেই দেখা দিয়েছে তীব্র নদী ভাঙন।
এরই মধ্যে লেওলাইপাড়া গ্রামে শত বিঘা ফসলি জমি ও চরসাড়াশিয়া গ্রামে ৪০-৫০টি বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বসবাসের শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন অনেকে।
এলাকাবাসী জানান, এ বছরই ভাঙনে নদী তীরবর্তী শত শত বিঘা কৃষিজমি নদীগর্ভে চলে গেছে।
এসব জমিতে টমেটো, বেগুন, পেঁয়াজসহ বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি ছিল। নদী ভাঙনের ফলে ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মধ্যে পড়েছেন এ অঞ্চলে কৃষকেরা।
অবিলম্বে ‘বালু খেকোদের’ দমন করতে না পারলে নদীভাঙন আরও প্রকট আকার ধারণ করবে।
কাজীরহাট বাজারের কয়েকজন দোকানি বলেন, বালুর গাড়ির ধূলায় চোখ-মুখ বন্ধ করে থাকতে হয়। দোকান করাই মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, আরিচা থেকে তারা সামান্য কিছু মোটা বালু আনেন। প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ করে’ নিজেদের খনন যন্ত্র দিয়ে বালু তুলে বৈধতা দেখাতে বিভিন্ন জায়গার ভুয়া স্লিপ দেখায়।