চায়ের ন্যায্য দাম ‘না পেয়ে’ ক্ষোভ ও হতাশার কথা জানিয়ে পঞ্চগড়ে জাতীয় চা দিবস পালন করেছেন চাষিরা।
চা পাতার ন্যায্য মূল্যের দাবিতে রোববার জেলার চা বাগান মালিক সমিতির ব্যানারে শহরের চৌরঙ্গী মোড়ে মচা চাষিরা ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধন করেছেন।
এ সময় তারা কাঁচা চা পাতার দাম সর্বনিম্ন ৪০ টাকা নির্ধারণসহ নানা দাবি জানান।
চায়ের ন্যায্য দাম না পেয়ে ক্ষোভে ও হতাশায় কিছু চাষি তাদের বাগান কেটে ফেলছেন বলেও মানববন্ধনে বক্তারা জানান।
পঞ্চগড় চা বাগান মালিক সমিতির সভাপতি দিদারুল আলম বলেন, “সময়ের সাথে কাঁচা চা পাতার দাম স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি পাবে এমন আশা থাকলেও এখন সেই পাতা বিক্রি হচ্ছে সর্বনিম্ন দরে।”
তিনি অভিযোগ করে বলেন, “কাঁচা চা পাতার মূল্য নির্ধারণ কমিটির নির্ধারিত ১৮ টাকা কেজি দরে চা পাতা ক্রয় না করে কারখানাগুলো বর্তমানে ১৩ থেকে ১৪ টাকা দরে পাতা কিনছে। এ ছাড়া বড় আকারের চা পাতা আনার অজুহাতে চা পাতার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ওজন কেটে রেখে অবশিষ্ট ওজনের পাতার মূল্য পরিশোধ করছে কারখানাগুলো।
“এ হিসাবে এক হাজার কেজি কাঁচা চা পাতা এনে চা বাগান মালিকরা ছয়শ থেকে সাতশ কেজির দাম পাচ্ছেন। যা প্রতি কেজি কাঁচা চা পাতার দাম পড়ে ১০ টাকারও কম।”
অথচ এক কেজি কাঁচা চা পাতা উত্তোলনসহ উৎপাদন খরচ পড়ে ১৫ থেকে ১৬ টাকা বলে তিনি দাবি করেন।
চলতি ভরা মৌসুমের শুরু থেকে এ অবস্থা চলতে থাকায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন চা বাগান মালিক ও চা চাষিরা। এ জন্য কেউ কেউ হতাশায় ও ক্ষোভে চা বাগান কেটে অন্য ফসল আবাদের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে তিনি জানান।
পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার সারিয়ালজোত এলাকার সাইদ আলী বলেন, “ঋণ নিয়ে বাড়ির পাশের এক একর জমিতে চায়ের আবাদ করি। প্রথম দিকে পাতার ভালোই দাম পাচ্ছিলাম।“
কিন্তু গত দুবছরে দাম এমন পর্যায়ে এসেছে যে তিনি এখন চা চাষে আর আগ্রহ পাচ্ছেন না। এ জন্য তিনি বাগান কেটে ফেলছেন বলে জানান।
একই এলাকার রফিকুল ইসলাম চা পাতা বিক্রি করতে গিয়ে কারখানার লোকজনের কাছে লাঞ্ছিত হয়েছেন বলে অভিযোগ করেন।
এ জন্য তিনি ২ বিঘা জমির চা বাগান কেটে ফেলে তাতে সবজি ও অন্য ফসল আবাদ করেছেন।
তিনি বলেন, “এমনিতেই লোকসান তার ওপর পাতা বিক্রি করতে গিয়ে অপমান সহ্য করতে পারিনি। এজন্য এ বছর বাগান রাখতে চাইলেও আর রাখিনি।”
সাইদ ও রফিকুল জানান, তাদের মত কমপক্ষে এলাকার ৮/১০ জন কৃষক তাদের চা বাগান কেটে অন্যান্য ফসলের আবাদ শুরু করেছেন।
তেঁতুলিয়ার চা চাষি আব্দুল জব্বার বলেন, “৪/৫ বছর আগে কারখানাগুলো ২৬ টাকা থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত দরে চা পাতা কিনত। এখন প্রতি কেজি চা পাতায় ১২ থেকে ১৪ টাকা উৎপাদন খরচ হয়। অথচ কারখানাগুলো চা পাতা কিনছে ১৪ থেকে ১৬ টাকা দরে। এর সঙ্গে নানা অজুহাতে ওজন কেটে নিচ্ছে। সবকিছু মিলে লোকসানে পড়ছে চাষিরা। এ জন্য অনেকে চা চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।”
মাহমুদুল ইসলাম নামের এক চা বাগান মালিক বলেন, “চা কারখানা বাড়ায় প্রতিযোগিতা করে কাঁচা চা পাতার মূল্য বাড়ার কথা থাকলেও সিন্ডিকেট করে সব কারখানা একই দামে পাতা কিনছে। এতে চাষিরা একসঙ্গে পাতা বিক্রি করতে গিয়ে নান সংকটে পড়ছে। কারখানাগুলো রেশনিং করে কিনলে চাষিরা উপকৃত হত।”
চা চাষি ও পঞ্চগড় সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান শেখ মিলন বলেন, “চায়ের আবাদ করে আমরা যেন অভিশাপ ডেকে এনেছি। কারখানার সিন্ডিকেটে আমরা জিম্মি হয়ে পড়েছি। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেলেও কারখানা মলিকরা নির্ধারিত ১৮ টাকাতো দিচ্ছেই না তার ওপর মোট ওজন থেকে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কেটে (কর্তন) রেখে অবশিষ্ট ওজনের মূল্য দিচ্ছে। এতে-প্রতি কেজি পাতা উৎপাদনে ১৫ বা ১৭ টাকা খরচ হলেও আমরা পাচ্ছি ১০ থেকে ১২ টাকা। এভাবে মার খেতে খেতে অনেক চাষি বাধ্য হয়ে চা বাগান কেটে অন্য ফসলের আবাদ শুরু করেছেন। তিনি নিজেও তার ৩ একর চা বাগান আগামিতে রাখবেন কিনা তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন বলে জানান।
এ সম্পর্কে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নাইমুজ্জামান মুক্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “এলাকার অনেক কৃষক এখন চায়ের আবাদের ওপর নির্ভরশীল।”
দামের সংকটে তারা এখন দুর্যোগে পড়েছেন বলে জানিয়েছেন।
এসব প্রশাসনেরই দেখার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “প্রয়োজনে প্রতিটি চা কারখানায় ট্যাগ অফিসার নিয়োগ, চা পাতা কেনার আগাম নোটিস দেওয়া এবং অনুপযুক্ত চা পাতা চিহ্নিত করতে চাষি ও কারখানার প্রতিনিধির সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা যেতে পারে।
তিনি বলেন, “এসব প্রস্তাব অনুযায়ী কাজ করলে চাষিদের অনেক অভিযোগই আর থাকবে না।”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে সমতল অঞ্চলে চায়ের গোড়াপত্তন হয়েছে উল্লেখ করে তিনি প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের চাষিদের সংকট নিরসনে তাড়াতাড়ি উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান।
চা বোর্ড পঞ্চগড়স্থ আঞ্চলিক কার্যালয়ের কর্মকর্তা মো. আমির হোসেন বলেন, “গত বছর জেলায় এক কোটি ৭৭ লাখ ৭৯ হাজার কেজি চা উৎপন্ন হয়েছে। যার বাজার মূল্য ছিল ২৬০ কোটি টাকা। দেশে মোট উৎপাদিত চায়ের ১৯ শতাংশ চা পঞ্চগড়ের উৎপাদিত পাতা থেকে হয়েছে।”
এবার দুই কোটি কেজি চা উৎপন্ন হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, “গত বছর সমতলের এই চা অঞ্চল থেকে রেকর্ড এক কোটি ৭৭ লাখ ৬০ হাজার কেজি চা উৎপন্ন হয়েছে। যা জাতীয় চা উৎপাদনের ১৯ শতাংশ।”
এ অঞ্চলে প্রায় ১৩ হাজার একর জমিতে চা চাষ হচ্ছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, “এর মধ্যে শুধু পঞ্চগড়েই রয়েছে ১০ হাজার একরেরও বেশি চা বাগান। বড় বাগানের পাশাপাশি এখানে ক্ষুদ্র চা চাষির সংখ্যাও রয়েছে ১০ হাজারের বেশি।”
তিনি আরও বলেন, “চা কারখানাগুলো প্রকৃত অর্থে চাষিদের সাথে অমানবিক আচরণ করছে।”
এ বিষয়ে কী পদক্ষেপ নিয়েছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরা চা বোর্ড সংশ্লিষ্টদের বিষয়টি জনিয়েছি।”
তেঁতুলিয়া বিসমিল্লাহ টি ফ্যাক্টরির মালিক জাহাঙ্গীর আলম দাবি করে বলেন, “খরার কারণে প্রথম দিকে সে রকম চা পাতা পাওয়া যায়নি। এখন অনেক চাষি একইসঙ্গে পাতা আনায় আমরাও বিপাকে পড়েছি।”
প্রশাসন নির্ধারিত ১৮ টাকা দরেই প্রতি কেজি চা পাতা কিনছেন বলে দাবি করেন জাহাঙ্গীর আলম।
কাঁচা চা পাতা মূল্য নির্ধারণ কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক জহুরুল ইসলাম বলেন, “আমরা বিষয়টি নিয়ে অবগত রয়েছি। শিগগির সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে বসে উন্মুক্ত আলোচনায় নতুন মূল্য নির্ধারণ এবং অন্যান্য সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেওয়া হবে।”