নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের পাইনাদী নতুন মহল্লায় একটি ভবনের ছয়তলায় ২০ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত সুমাইয়া মাত্র আড়াই মাস আগে কন্যাসন্তানের জন্ম দেন।
Published : 31 Jul 2024, 09:24 AM
মাত্র আড়াই মাস আগে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে এক কন্যাসন্তানের জন্ম দেন সুমাইয়া আক্তার। কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে ২০ জুলাই ছয়তলার বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে যখন গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি মারা যান তখনও পেটের ঘা পুরোপুরি শুকায়নি।
পরিবারের সদস্যরা জানান, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের পাইনাদী নতুন মহল্লা এলাকার ছয়তলা একটি ভবনের ষষ্ঠ তলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন সুমাইয়া। বারান্দায় স্টিলের গ্রিল ভেদ করে গুলিটি যখন তার মাথায় লাগে, ঘটনার তাৎক্ষণিকতায় কিছুই বুঝে উঠতে পারেননি পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মা আসমা বেগম।
মেঝেতে লুটিয়ে পড়া মেয়ের মাথাটি যখন তিনি নিজের কোলে তুলে নেন, তখন তার হাত রক্তে রঞ্জিত হয়ে ওঠে।
আসমা বেগম বলছিলেন, “আরেক রুমে ছিল সুমাইয়া। নাতিডারে দুধ খাওয়ানোর পর যখন ঘুমায়, তখন সে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। একটু পরই মাইয়া আমার লুটাইয়া পড়ে। আমি প্রথমে কিছুই বুঝি নাই। এত ডাকলাম, কোনো কথা নাই। তখন বুঝলাম, আমার মাইয়া আর নাই।”
মধ্য বয়সী এই নারী কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “একটা শব্দও কইতে পারে নাই। তার আগেই লুটাইয়া পড়ে। এই কথাডাও কইতে পারে নাই যে, মা আমি তো থাকমু না, আমার মাইয়াডারে (শিশুকন্যা) তুমি দেইখা রাইখো।”
গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর পরই দ্রুততার সঙ্গে সুমাইয়াকে স্থানীয় একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসক জানান, হাসপাতালে আনার আগেই তার মৃত্যু হয়েছে।
২০ জুলাই বিকালে যখন সুমাইয়া গুলিবিদ্ধ হন তখন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শিমরাইল ও আশপাশের এলাকায় কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষ চলছিল।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ওইদিন বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে একটি বহুতল ভবনে (ওই ভবনে হাইওয়ে পুলিশের একটি ক্যাম্প ছিল) ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয়। এর মধ্যেই গুলির ঘটনা ঘটে।
সুমাইয়া আক্তার বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের প্রয়াত সেলিম মাতবরের মেয়ে। তার স্বামী পোশাক কারখানার কর্মী মো. জাহিদ সোনারগাঁ উপজেলার কাঁচপুরে একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। সুমাইয়া নিজেও পোশাক কারখানার কর্মী ছিলেন। অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। থাকছিলেন কুমিল্লায় তার শ্বশুরবাড়িতে।
শিমরাইলে আগুন দেওয়া ভবনটির অদূরে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের পাইনাদী নতুন মহল্লা এলাকায় ছয়তলা ভবনে সুমাইয়ার মায়ের বাসা। ১২ মে সন্তান প্রসবের পর শ্বশুরবাড়িতে না পাঠিয়ে সুমাইয়া ও সদ্যভূমিষ্ঠ নাতনিকে নিজের বাসায় নিয়ে আসেন আসমা বেগম। এক সপ্তাহ পরেই শ্বশুরবাড়িতে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল তার। তার আগেই গুলিতে প্রাণ হারাতে হয়েছে তাকে।
এজন্য এখন নিজেকে দুষছেন মা আসমা বেগম। তিনি বলেন, “পরের শুক্রবারই মেয়েটা কুমিল্লা চলে যেতো। এর মধ্যেই এইসব হইয়া গেলো। আমি কেন মেয়েটারে আমার কাছে আনলাম। আল্লাহ গো”, কাঁদতে থাকেন তিনি।
সুমাইয়ার মাথার ডান পাশে যে গুলিটি বিদ্ধ হয়েছিল, সেটি বারান্দার স্টিলের গ্রিল ভেদ করে আসে। মঙ্গলবার দুপুরে এই প্রতিবেদককে গ্রিলে থাকা সেই ক্ষতচিহ্নটিও দেখান আসমা।
তিনি বলছিলেন, “আমি প্রথমে কিছু বুঝতেই পারিনি। যখন মাথায় হাত দিলাম আর দেখলাম, রক্তে আমার হাত ভাইসা যাইতেছে। চাইপা ধইরাও রক্তা পড়া থামাইতে পারি নাই। আমার চিৎকারে তখন ঘরে থাকা দুই ছেলে আসে। ডাক্তারের কাছে নিলে কইলো সে তো আর নাই। আমারে একবার মা বইলাও ডাকতে পারে নাই। মা আমার ছোট্ট নাতিডারে রাইখা গেলো গা।”
অভাবের তাড়নায় আসমা বেগম স্বামীর সঙ্গে যখন গ্রাম থেকে শহরে আসেন তখন তার সন্তানেরা ছোট। নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে কাজ করা তার স্বামী কোভিড মহামারির সময় মারা যান। এখন হারালেন আদরের মেয়েকে।
আসমা বেগম বলেন, “আমরা গরিব মানুষ গো বাবা। ভাতের অভাবে ছোট পোলাপান লইয়া ঢাকা শহরে আইছিলাম। আর মাইয়া আমার গুলি খাইয়া মরলো। এই বিচার আমি কার কাছে চামু?”
আসমা যখন কাঁদছিলেন, আশ্চর্যজনকভাবে তার কোলে থাকা আড়াই মাসের শিশুটির দুই চোখে বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে দেখা যায়।