নিজের দলের নেতা, এমনকি পুলিশের এসআইকেও তিনি ‘ছাড়’ দেননি।
Published : 12 Jan 2025, 12:40 AM
শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলায় সাবেক এক যুবদল নেতার ‘দখল, চাঁদাবাজি, নির্যাতনে’ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে এলাকার মানুষ।
মারধর কিংবা দখলের অভিযোগ তিনি অস্বীকারও করেন না। তার ভাষায়, ‘অপরাধ’ করলে তিনি নিজেই ‘শাস্তি’ দেন। আর যা দখল করেছেন আগে তা তারই ছিল।
উপজেলা যুবদলের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক রনি মাঝির বিরুদ্ধে নড়িয়া থানায় দুটো মামলাও হয়েছে। একটি মামলা হয়েছে এক বিএনপি নেতা ও তার ছেলেকে মারধরের ঘটনায়। আর অন্যটি পুলিশের এক এসআইয়ের হাত ভেঙে দেওয়ার অভিযোগে।
এ ছাড়া জমি দখলের অভিযোগে এক নারী মামলা করলেও হুমকির মুখে তা উঠিয়ে নেন। পরে জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ওই নারী।
এলাকায় প্রভাবশালী হওয়ায় ভুক্তভোগীদের অনেকেই রনির বিরুদ্ধে মুখ খোলারও সাহস পান না। তবে জেলার পুলিশ সুপার মো. নজরুল ইসলাম এসব অভিযোগের বিষয়ে অবগত।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “রনি মাঝি দখল, অত্যাচার ও নির্যাতন চালায়। আমাদের গোয়েন্দা সূত্রে তার অপকর্মের বিষয়ে শুনেছি। সে পুলিশের উপরও নির্যাতন করেছে।
“পাশাপাশি অরন আহম্মেদ নামে এক ব্যবসায়ীকে মারধরের কথা শুনেছি। এসব ঘটনায় লিখিত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
নড়িয়া থানার ওসি আসলাম উদ্দিন মোল্লা বলেন, রনির বিরুদ্ধে তিনটি মামলাই আদালতে বিচারাধীন। তিনি উচ্চ আদালত থেকে এসব মামলায় জামিন নিয়ে বাইরে আছেন।
নতুন করে কেউ অভিযোগ দিলে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া যাবে বলে ওসি আসলামের ভাষ্য।
অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করলে রনি মাঝি বলেন, “ছোটবেলা থেকেই আমি অন্যায়ের প্রতিবাদী। কেউ গাঁজা, মদ, ইয়াবা সেবন ও বিক্রি এবং অন্যায় করলে আমি তাদেরকে নিজ হাতে ধরে এনে শাস্তি দিই। পরে পুলিশকে দিই।”
রনি ঘড়িসার ইউনিয়নের বাহির কুশিয়া এলাকার মৃত হায়দার আলী মাঝির ছেলে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, সরকার পতনের পর রনি মাঝি ও তার সহযোগীদের দৌরাত্ম বেড়েছে।
রনি মাঝির বিরুদ্ধে ঘড়িসার ডেভলপার মর্ডান সিটির প্লট দখলের অভিযোগ করেছেন কোম্পানির পরিচালক নাজির হোসেন খান।
তিনি বলেন, ২০১০ সাল থেকে ঘড়িসার এলাকার অলোক রানী কুণ্ডু ও তার ছেলেদের কাছ থেকে সাড়ে আট একর জমি কিনে ভরাট করে ১১০টি প্লট বানান। ৪০টি প্লট বিক্রি হয়েছে। ৫ অগাস্ট সরকার পরিবর্তনের পর বাকি ৭০টির প্লট ‘দখল করে নিয়েছেন’ রনি মাঝি।
“অফিসটিও জোর করে দখল করে মালামাল ও কাগজপত্র নিয়ে নিয়েছেন। ৫ জানুয়ারি সেখানে থাকা পাঁচ শতাধিক আমগাছ পুড়িয়ে দেওয়া হয়।”
ঘড়িসার ডেভলপার মর্ডান সিটির পরিচালক বলেন, “এখন আমাদের অফিসের মধ্যে প্রতিদিন রাতের বেলা মাদক সেবন করে, নারীদের নিয়ে অসামাজিক কার্যকলাপ করে যাচ্ছে। আমরা ভয়ে প্রতিবাদ করতে পারছি না। প্রশাসনের কাছে এ ব্যাপারে আমরা সহায়তা চাই।”
এদিকে পাগলার মোড় এলাকার ইতালি প্রবাসী আলাউদ্দিন লাকুড়িয়ার জমি দখল করে দোকানঘর নির্মাণের অভিযোগ রয়েছে রনি মাঝির বিরুদ্ধে। ওই ঘট্নায় পরে আলাউদ্দিনের স্ত্রী ইসমত আরা একটি মামলা করেন। কিন্তু পরে রনি মাঝির চাপে তিনি সেই মামলা তুলে নিতে বাধ্য হন।
পরে আবার এ নিয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন বলে জানান ইসমত আরা। তিনি বলেন, “আমদের পাঁচ শতাংশ জমি জবরদখল করে রনি মাঝি ভোগ করছে। আমরা প্রতিবাদ করলে ভয়ভীতি দখায়। আমি আমার জমি ফেরত চাই।”
এ ব্যাপারে কথা বলতে শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক মো. আশরাফ উদ্দিনের মোবাইলে ফোন করলে তিনি ধরেননি।
গত ৭ নভেম্বর নড়িয়া উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও হালইসার এলাকার বাসিন্দা মতিউর রহমান সাগরের ওপর হামলার অভিযোগ রয়েছে রনি মাঝির বিরুদ্ধে। সাগরের অভিযোগ, রড দিয়ে পিটিয়ে তার কলেজ পড়ুয়া ছেলে মিজানুর রহমান জাহিদের পা ভেঙে দিয়েছেন রনি।
ওই দিনই নড়িয়া থানায় এ বিষয়ে মামলা করেছেন বলে জানান বিএনপি নেতা সাগর।
সম্প্রতি চণ্ডিপুর স্কুলে রনি মাঝির চাচাত ভাই রবিন মাঝি মাদকসেবন ও মাদক বিক্রির সময় পুলিশের হাতে আটক হন। খবর পেয়ে রনি মাঝি সেখানে গিয়ে পুলিশকে মারধর করে আসামিদের ছিনিয়ে নেয়।
হামলায় নড়িয়া থানার এসআই ফরহাদ হোসেনের হাত ভেঙে যায় বলে জানান শরীয়তপুর পুলিশ সুপার কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তা (ডিআইও-১) কামরুল হোসেন তালুকদার।
তিনি বলেন, এ ঘটনায় নড়িয়া থানার এসআই ইকবাল হোসেন বাদী হয়ে একটি মামলা করেছেন।
কিছুদিন আগে ঘড়িসার বাজারের ব্যবসায়ী অরন আহম্মেদকে চাঁদা না দেওয়ার কারণে রনি মাঝি তার লোকজন তাকে মারধর করে বলে অভিযোগ করেন অরনের মা রিনা আহম্মেদ।
তিনি বলেন, “রনি দোকানে গিয়ে চাঁদা চায়। চাঁদা না দেওয়ায় দোকানের প্রায় তিন লাখ টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। প্রতিবাদ করায় আমার ছেলেকে রড দিয়ে পিটিয়ে আহত করেছে। পরে এক লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছে। টাকার জন্য আমার ছেলের শরীরে বৈদ্যুতিক শক দিয়েছে। এখন আমার ছেলে জীবনের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।”
শরীয়তপুর জেলা বিএনপির সভাপতি সফিকুর রহমান কিরণ বলেন, “ঘড়িসার এলাকার রনি মাঝির বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ আমরাও শুনেছি। কোনো সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, দখলদারদের বিএনপিতে স্থান নেই। সে আমাদের দলের কেউ নয়। প্রশাসনের কাছে অনুরোধ, সন্ত্রাসী চাঁদাবাজ ও দখলদারদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক।”
রনি মাঝি তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, “আমি আলাউদ্দিন লাকুড়িয়ার জমি দখল করিনি। আমার জায়গায় দোকান করছি।”
ঘড়িসার ডেভলপার মর্ডান সিটির প্লট দখলের ব্যাপারে রনি বলেন, “যেখানে প্রকল্প করেছে সেখানে আমাদের জমি আছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তারা আমাদের জায়গা দখল করে নিয়েছে। এখন সুযোগ হয়েছে আমি আমার জায়গা দখল করে নিছি।”
ব্যবসায়ী অরন আহম্মেদকে মারধরের বিষয়ে প্রশ্ন করলে সাবেক এই যুবদল নেতা বলেন, “অরন ইয়াবা ব্যবসায়ী। এজন্য তাকেসহ ১৭ জনকে ধরে এনে বিচার করেছি। প্রত্যেকের কাছে মাদক পাইছি। এ কারণে ওরা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে।”