বন্যা নিয়েছে সব, শূন্য থেকে শুরু পারুলের

পানিতেই জীবন হাওরের, সেই পানিই কেড়ে নিয়েছে সংসারের সব, এখন ফের শূন্য থেকে শুরু করতে হবে সুনামগঞ্জের পারুল বেগমের।  

কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধিশামস শামীম, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 July 2022, 02:04 PM
Updated : 4 July 2022, 02:04 PM

পারুলের স্বামী বছর পাঁচেক আগে নদীতে বালুচাপা পড়ে মারা যান; তারও চার বছর আগে হাওরেই ডুবে একসঙ্গে মারা যায় পারুলের বাবা-মা। তবু হাওর ছাড়েননি তিনি। পাঁচ সন্তান নিয়ে বছর পঁয়তাল্লিশের পারুল কোনোমতে সাঁতরে যাচ্ছিলেন স্রোতের প্রতিকূলে।

নিজের শ্রম আর ঘাম দিয়ে তিন দশক ধরে বিন্দু বিন্দু করে পারুল গড়ে তুলেছিলেন যে বসতি, সংসার; শতাব্দীর ভয়াবহ বন্যা তার সব কেড়ে নিয়েছে।

পারুল বেগম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলছিলেন, “আমার টিনের ঘরটি বানের স্রোতে ভেসে গেছে, জিনিসপত্রও নেই। এখন থাকার ব্যবস্থাই নেই। পাঁচ সন্তান নিয়ে বিপদে আছি। কিছু ত্রাণ পেলেও ঘর মেরামতের সাধ্য নেই।”

সদর উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের আমিরপুর উড়াকান্দা গ্রামের এই নারীর প্রতি হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন এক প্রবাসীসহ স্থানীয় কিছু মানুষ। সামান্য সাহায্যে হয়তো নিজের ঘরে মাথা গোঁজার একটা ব্যবস্থা হবে। কিন্তু ভেসে যাওয়া সংসার কি আর ভরপুর করতে পারবেন পারুল? সেই দুশ্চিন্তাই তার কপালের ভাঁজে।

এবারের বন্যায় সুনামগঞ্জের সবকটি উপজেলাই ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে বাধ্য হয়েছেন। দিনের পর দিন পানি নিচে থাকা ঘরের আসবাবপত্র, ধান, কৃষিকাজের যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে গেছে।

প্রাথমিকভাবে জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই পরিসংখ্যানের বাইরে রয়ে গেছে আরও অনেক বসতি। এতে শুধু ছিন্নমূল বা গরিব মানুষই নয়; নিম্নবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্তরাও বড় ধরনের বিপদে পড়েছেন।

সুনামগঞ্জ পৌর শহরের হাজিপাড়া আবাসিক এলাকার বাসিন্দা সেলিম আহমদ মোটামুটি সচ্ছল পরিবারেরই মানুষ। নিজের বাসায় থাকেন। তিনটি টিনসেড ভাড়া দেন। পাশের একটি বাসায় তার ভাইও থাকেন। বন্যায় বাসায় বুক সমান পানি উঠে। পানি দেখে একটি পরিবার চলে গেছে। বন্যায় বিধ্বস্ত বাড়িঘর থেকে অন্য দুটি পরিবারও চলে যেতে চাচ্ছে।         

সেলিম আহমদ বলেন, “বন্যায় নিজের সংসারের মোটরসাইকেল, ফ্রিজ, কাঁথা, বালিশ, কম্বল, খাবার-দাবারসহ জরুরি জিনিসপত্র সব নষ্ট হয়ে গেছে। এর মধ্যে ভাড়াটিয়ারা বাসা ছেড়ে দেওয়ার কথা জানিয়েছে। একজন ছেড়ে চলে গেছে। অন্যরাও বাসা খুঁজেছে। বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার আগে আরেক সংকটে এখন আমি দিশেহারা।”

সুনামগঞ্জ ও ছাতক পৌর শহরের অলিগলিতে যুদ্ধবিধ্বস্ত জনপদের মতো সংসারের নষ্ট উপকরণ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। সুনামগঞ্জ পৌর শহরের প্রতিটি গলিতে ছেঁড়া জুতো, কাপড়-চোপড় এবং বিছানা-কাঁথা-বালিশ পড়ে আছে।

সুনামগঞ্জ পৌর কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, “আমি নিজেই একতলার একটি বাসায় থাকতাম। আমার ৫০ বছরের সংগৃহীত বইপত্র, জরুরি কাগজ-পত্র, কাপড়-চোপড় ও সংসারের গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র সব নষ্ট হয়ে গেছে।”

“১৭ জুন সকালে এক কাপড়ে জুতা ছাড়াই বেরুতে পেরেছিলাম প্রাণ নিয়ে। আমার এক ছাত্রের বাসায় দোতলায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম। শুধু আমার নয়, নীচতলা ও টিনশেড ঘরে যারা ছিলেন সবারই একই অবস্থা। সবাই নিঃস্ব হয়ে গেছেন। এই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে অন্তত পাঁচ বছর সময় লাগবে।”

সুনামগঞ্জ পৌর শহরের নতুনপাড়া এলাকায় টিনশেডের বাসায় দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে বাস করেন প্রশান্তি দাস (৪৫)। মানুষের বাসাবাড়ি ও মেসে রান্না করে সংসার চালান তিনি। ১১ বছর আগে এক দুর্ঘটনায় হারান স্বামী রবীন্দ্র দাসকে। পর পর দুবার দুর্ঘটনায় পড়ে ছেলে জনি দাসও চিকিৎসার অভাবে এখন পঙ্গু প্রায়। মেয়ে পপি দাস পড়ে স্থানীয় হাইস্কুলে দশম শ্রেণিতে। বন্যায় সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন এই নারী।

প্রশান্তি বলেন, “আমি বান্দি (গৃহকর্মীর) কাম করি। সংসারের জিনিসপত্র আর জুড়াইতাম পারমুনি? আমি বেটি মানুষ, এখন কিলা (কিভাবে) বাসা ভাড়া দিমু ইতা মনে অইলে দুনিয়া আন্দার (অন্ধকার) অইযায়।”

তিনি জানান, ১৬ জুন রাতে বজ্রপাত, ঝড় ও ভারি বর্ষণ নিয়ে ঘুমাতে গেলেও বন্যা এতো ভয়াবহ হবে কল্পনায় আসেনি তার। রাত ১২টার দিকে দেখেন বিছানা ভিজে গেছে। দেখতে দেখতে সবকিছু পানিতে তলিয়ে যায়। দরজা খুলে দেখেন রাস্তায় বুক সমান পানি।

এর মধ্যেই কোনোমতে চরম অস্থিরতার মধ্যে রাত পার করেন প্রশান্তি। পরদিন সকালে আরও পাঁচ-ছয়টি পরিবারের সঙ্গে পাশের দোতলার ছাদে আশ্রয় নেন।

প্রশান্তি আরও জানান, তার কোনো সঞ্চয় নেই। পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে যা অবশিষ্ট থাকতো তা দিয়ে একটি একটি করে সংসারের খুঁটিনাটি জিনিসপত্র সংগ্রহ করতেন। কিন্তু বন্যা তার সব শেষ করে গেছে।

“আমার, ছেলেমেয়ের জুতা, জামা-কাপড়, বাসন-কোসন সব নষ্ট করে গেছে। মানুষের বাসাবাড়িতে কাজ করে এই জিনিসপত্র আর কখনও কেনা সম্ভব না।”

সহায়-সম্বলহীন এ নারী বলেন, এখন পানি নেমে যাওয়ার পর একমাত্র স্টিলের খাটে কোনোমতে ছেলেমেয়েকে নিয়ে আছি। ত্রাণ হিসেবে চার কেজি চাল ও এক প্যাকেট শুকনো খাবারের প্যাকেট পেয়েছি। এখন বাসাবাড়িতে কাজ শুরু করব সেই অবস্থাও নেই।

একই মালিকের টিনশেড বাসায় প্রশান্তির পাশেই ভাড়া থাকেন দিনমজুর হিবলু নাগ (৪৫)। বৃদ্ধা মা, স্ত্রী ও এক ছেলে নিয়ে এক কামরার বাসায় তার সংসার। ঠেলাগাড়ি করে পাড়ায় পাড়ায় সবজি বিক্রি করে সংসার চলে তার। ছেলে একটি দোকানে নামমাত্র মজুরিতে চাকরি করে।

হিবলু জানান, বন্যার দুদিন আগে ১৫ দিন চলার মতো বাজার করে এনেছিলেন। আধাবস্তা চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, তেল, মরিচ, হলুদ, রসুন সব ছিল তার চোখের সামনে। বন্যায় সব ভেসে ও নষ্ট হয়ে গেছে। বৃদ্ধা মা আর প্রাণ নিয়ে যে বেরুতে পেরেছেন এটাই ছিল তার বড় পাওয়া।

লেপ, তোষক, কাঁথা, কম্বল, জুতা সব ভেসে গেছে, পায়ে দেবেন এমন জুতো পর্যন্ত নেই জানিয়ে হিবলু নাগ বলেন, “জীবনে আর জুরাইতে পারমুকি সংসারের ইতা? (জীবনে আর জুড়াতে পারব সংসারের জিনিসপত্র?)।”

কাঠের কাজ করে সংসার চালান সুনামগঞ্জ শহরতলির মাইজবাড়ি এলাকার দিনমজুর রায়হান আহমদ (৩৪)। বন্যায় তার কাঁচা ঘর নষ্ট হয়ে গেছে। ঘরের যা খাবার ছিল তাও ডুবে নষ্ট হয়ে গেছে। এখন পানি কমলেও ঘরে খাবার নেই, তাই কাজে বেরিয়েছেন।

রায়হান বলেন, “ঘর ভেঙে নিয়েছে বন্যা। এখন সংস্কার করার কথা। কিন্তু সংসার চালাতে গিয়ে ঘরে হাত না দিয়ে দিনমজুরির কাজ করতে হচ্ছে। এই অবস্থা শুধু আমার নয়। সুনামগঞ্জের সব গরিবের এখন একই অবস্থা।”

সুনামগঞ্জের তরুণ গবেষক কল্লোল তালুকদার চপল বলেন, এই জনপদের গোড়াপত্তনের ১৫০ বছরের রেকর্ড পাওয়া যায়। সেখানে সব বড়ো বড়ো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথাও আছে। কিন্তু এমন ভয়াবহ দুর্যোগের কোনো রেকর্ড নেই।

“তাই বলা যায়, এই দুর্যোগ সর্বকালের ভয়াবহ দুর্যোগ। যারা নিজ চোখে দেখেনি, নিজেরা ভুক্তভোগী না তারা কল্পনাও করতে পারবে না এই বিভীষিকার কথা”, বলেন তিনি।