দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া: আগে গাড়ি ফেরির জন্য বসে থাকত, এখন ফেরিই অপেক্ষায়

পদ্মা সেতু চালুর পর শশব্যস্ত দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথ এখন অনেকটাই ঝামেলাহীন; আগে যেখানে ফেরির জন্য গাড়িগুলোকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো, এখন খোদ ফেরিই যানবাহনের জন্য অপেক্ষায় থাকছে।

মাহিদুল ইসলাম মাহি ও শামিম রেজাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 June 2022, 01:11 PM
Updated : 27 June 2022, 05:37 AM

শনিবারও রাজবাড়ী ও মানিকগঞ্জ জেলার এ ঘাট দুটিতে যে কোলাহলমুখর পরিবেশ ছিল, কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে রোববার সকাল থেকেই তা উধাও হয়ে গেছে। হকার-মজুর-যাত্রী-দোকানদার-শ্রমিকের হাঁক-ডাকের পরিচিত দৃশ্য যেন নিমিষেই হারিয়ে গেছে।

পদ্মা সেতুর প্রভাব পড়ায় এ নৌপথে যানবাহন কমে গেছে অনেক। ফলে কোনো ভোগান্তি ছাড়াই পদ্মা পাড়ি দিচ্ছেন যাত্রীরা। সকালের দিকে যানবাহন একটু বেশি থাকলেও দুপুরের পর তা আরও কমে আসে বলে জানিয়েছে ঘাট কর্তৃপক্ষ।  

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) দৌলতদিয়া ঘাট শাখার ব্যবস্থাপক প্রফুল্ল চৌহান বলেন, “সকাল থেকে ঘাট এলাকা একদম ফাঁকা রয়েছে। প্রতিটি ফেরি গাড়ির অপেক্ষায় রয়েছে। পদ্মা সেতু চালুর ফলে এই পথে যানবাহনের চাপ কমেছে। ফলে এই পথে ব্যবহারকারীরা কোনো প্রকার ভোগান্তি ছাড়া পদ্মা পাড়ি দিয়ে গন্তব্যে যাচ্ছেন।

পদ্মা সেতু চালুর পর শশব্যস্ত দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথ এখন অনেকটাই ঝামেলাহীন; আগে যেখানে ফেরির জন্য গাড়িগুলোকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হত, রোববার দেখা গেল ফেরি অপেক্ষায় ছিল গাড়ির জন্য।

এই নৌপথে ছোট-বড় মিলে ২০টি ফেরি চলাচল করছে বলে জানান প্রফুল্ল চৌহান।

বিআইডব্লিউটিসির পাটুরিয়া ঘাট কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক আব্দুস সালাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন,  “সকালের দিকে কিছু দূরপাল্লার বাস ছিল। তবে দুপুরের পর থেকে ঘাট এলাকা কিছুটা ফাঁকা।”

“গত সপ্তাহের তুলনায় আজ শতকরা ৬০ ভাগ গাড়ি কম চলাচল করেছে। পদ্মা সেতুর কারণে আসলে কী পরিমাণ গাড়ি কম চলছে তা এক-দুই সপ্তাহ পরে আরও ভালভাবে বোঝা যাবে। আজ এ নৌপথে ২১টি ফেরি সচল রয়েছে।“

বিআইডব্লিউটিসি আরিচা ঘাট কার্যালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) শাহ মো. খালেদ নেওয়াজ বলেন,  “পণ্যবাহীসহ বড় ট্রাক আছে আগের মতোই। তবে এখনি বলা যাচ্ছে না কী পরিমাণ গাড়ি কমেছে। দুই সপ্তাহ পরে পদ্মা সেতুর কারণে ঘাটে যানবাহন পারাপারের অবস্থা কী দাঁড়াবে তার বিস্তারিত পরিসংখ্যান জানাব।”

শনিবার মহাধুমধামে দেশের সবচেয়ে বড় পদ্মা সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে যানবাহনের জন্য খুলে দেওয়া হয় রোববার সকাল থেকে। সেতু চালুর ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রবেশদ্বার হিসেবে খ্যাত এ নৌপথে যাত্রী ও যানবাহন কমে যাবে আগেই ধারণা করা গিয়েছিল।

এই পরিস্থিতিতে ঘাটকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক ও কর্মচারীদের চোখেমুখে চিন্তার ভাঁজ রয়েছে। তারা কাজ হারাবেন বলে আশঙ্কা করছিলেন। 

পদ্মা সেতু চালুর পর শশব্যস্ত দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথ এখন অনেকটাই ঝামেলাহীন; আগে যেখানে ফেরির জন্য গাড়িগুলোকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হত, রোববার দেখা গেল ফেরি অপেক্ষায় ছিল গাড়ির জন্য।

‘ঘাটে এসে মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি’

দুপুরে দৌলতদিয়া ফেরি ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, যানবাহনের অপেক্ষায় বসে আছে ফেরি। ঘাট এলাকা একদম ফাঁকা। যানবাহনের চাপ নেই বললেই চলে। যানবাহনগুলো কোনো প্রকার ভোগান্তি ছাড়াই ফেরিতে উঠে পদ্মা পাড়ি দিচ্ছে।

সাতক্ষীরা থেকে ছেড়ে আসা সাতক্ষীরা লাইন পরিবহনের যাত্রী আমিরুল ইসলাম বলেন, “ফেরি ঘাট ফাঁকা থাকায় খুবই ভালো লাগছে। অপেক্ষা ছাড়াই সরাসরি ফেরিতে উঠতে পেরেছি। কয়েকদিন আগেও পাঁচ ঘণ্টা অপেক্ষা করে ফেরিতে উঠতে হয়েছে। পদ্মা সেতুর কারণে এটা সম্ভব হয়েছে। ধন্যবাদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।“

আরেক যাত্রী মনিরুল ইসলাম বলেন, “কী যে ভালো লাগছে সেটা বলে বোঝাতে পারব না। ঘাটের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি। কোনো জ্যাম নেই, ভোগান্তি নেই, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতেও হচ্ছে না। আজ থেকে হয়তো এই পথে আর ভোগান্তি থাকবে না।“

যশোর থেকে ছেড়ে আসা ট্রাকচালক কাশেম খান বলেন, “গত সপ্তাহেও দুই দিন অপেক্ষা করে ফেরিতে উঠতে হয়েছে। সারা বছরই আমাদের মতো ট্রাকচালকদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে ঘাটে এসে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় অনেক গাড়িই সেতু দিয়ে যাতায়াত করছে। যে কারণে ঘাটে কোনো জ্যাম নাই। সরাসরি ফেরিতে উঠতে পেরে খুবই ভালো লাগছে আমাদের।”

সকাল থেকে ঘাটে গাড়ি না থাকায় মন খারাপ দৌলতদিয়া ঘাট এলাকায় পান-সিগারেট বিক্রেতা কুদ্দুস খানের।

তিনি বলেন, “সকাল থেকে ঘাটে কোনো গাড়ি নেই। গাড়ি না থাকলে আমাদের পেট চলে না। গাড়ির চাপ থাকলে লোকজন থাকে ঘাটে সে সময় কিছু কেনাবেচা হয়। ঘাট ফাঁকা থাকার কারণে আজ দোকান খুলিনি।”

কেয়ার হোটেলের মালিক সোহেল রানা বলেন, “যাত্রী না থাকার কারণে সকাল থেকে খাবার হোটেল বন্ধ রেখেছি। কারণ হোটেল খুললেই শ্রমিকদের বেতনসহ অন্যান্য খরচ মিলিয়ে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা খরচ হয়। দিন শেষে দেখা যায় খরচের টাকাটাও উঠে না। তাই বন্ধ রেখেছি।”

ঘাটের ঝালমুড়ি বিক্রেতা ফজাই মণ্ডল বলেন, যাত্রী না থাকলে মুড়ি কিনবে কে? সকাল থেকে ১০০ টাকা বিক্রি করেছি। কয়েকদিন আগেও যাত্রীর চাপ ছিল, সে সময় দিনে এক হাজার টাকা মুড়ি বিক্রি করতাম। এখন থেকে সারাদিনে ৫০০ টাকা বিক্রি করতে পারব কি-না জানি না।

বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক লীগের দৌলতদিয়া ঘাট শাখার সভাপতি তোফাজ্জল হোসেন তপু বলেন, স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাই। ভোগান্তি থেকে মুক্তি পেয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ। ফলে এই নৌপথে যানবাহনের চাপ কমেছে।

“ঘাটকে কেন্দ্র করে অনেকের জীবন চলত। সকাল থেকে ঘাটে যাত্রী না থাকায় অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। যারা খুলেছে তারাও রয়েছে চিন্তার মধ্যে, কারণ বেচাকেনা নেই। সেজন্য দৌলতদিয়া এলাকায় নদীশাসন, আধুনিক নৌবন্দর ও ডকইয়ার্ড নির্মাণ করা গেলে মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।“

‘অবস্থা ভাল না, বিক্রি মেলা কম’

দুপুরে পাটুরিয়া ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় কোলাহলহীন। মানুষ বসে আছে অলস। ফেরি ঘাটে আগের সেই মুখরতা নেই। 

লঞ্চ ঘাট এলাকার মায়ের আঁচল স্টোরের মালিক মো. রাজেদ আলী বলেন, “২০ বছর ধরে ঘাট এলাকায় দোকান করে সংসার চালাই। তবে আজ পুরো ঘাট এলাকা ফাঁকা। বিক্রি নেই বললেই চলে।“

পাটুরিয়া পুলিশ কন্ট্রোল রুমের পাশের চা দোকানি সাইদুল মিয়া বলেন, “অবস্থা ভাল না। আজ বিক্রি মেলা কমে গেছে।“

পুলিশ কন্ট্রোল রুম এলাকার শরিফ হোটেলের মালিক আলীম মোল্লার বাড়ি রাজবাড়ী জেলায়। তিনি আর তার বাবা মিলে হোটেল চালান। সেখানে আটজন কাজ করেন।

তিনি বলেন, “বিক্রি এতো কম আজ কর্মচারীদের বেতন দিতে পারব না। ঘাটে সেলফি বাস (ঘাট থেকে গাবতলি পর্যন্ত চলাচলকারী গাড়ি) ছাড়া আর কোনো বাসই তো চোখে পড়ছে না। গাড়ি নাই, যাত্রীও নাই। আমার বিক্রিও নাই। এভাবে চললে হোটেল চালানো কঠিন হবে।“

প্রায় একই কথা বললেন চা ও কনফেকশনারি দোকান মালিক হানিফ মিয়া।

পঞ্চাশোর্ধ্ব এই দোকানি বলেন, “ঘাটে তো আজ মানুষ নাই বললেই চলে, বেচুম কার কাছে?”

দিলীপ দাস জননী টিস্যু ও আবুল খায়ের গ্রুপের স্থানীয় ডিলার। তিনি সেখানকার অর্ধশতাধিক দোকান-হোটেলে টিস্যু সরবরাহ করেন।

তিনি বলেন, “আজ ঘাট এলাকায় গাড়ি অনেক কম দেখলাম আর মানুষের চলাচলও কম।”

মধুমতি ভাসমান কারখানার মেকানিক নজরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পদ্মা সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচল চালু হওয়ায় আমাদের ঘাটে ছোট গাড়ি পারাপার অনেক কমেছে। বড় গাড়িও খুবই কম পারাপার হচ্ছে। সেলফি পরিবহনসহ লোকাল পরিবহনের কিছু যাত্রী চোখে পড়ছে।”