শীতলক্ষ্যায় লঞ্চডুবি: ৬ লাশ উদ্ধার, রাতে বন্ধ তল্লাশি

নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদীতে সিটি গ্রুপের মালিকানাধীন একটি মালবাহী জাহাজের ধাক্কায় লঞ্চডুবির ঘটনায় এ পর্যন্ত ছয় জনের লাশ উদ্ধার করা গেছে; রাতের মত তল্লাশি অভিযান স্থগিত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন উদ্ধারকর্মীরা।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 March 2022, 04:03 PM
Updated : 21 March 2022, 09:17 AM

রোববার দুপুরে লঞ্চডুবির সাত ঘণ্টা পর এই ঘোষণা দিয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারী পরিচালক শাহজাহান সিকদার গণমাধ্যমকে বলেন, “উদ্ধারকাজ আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে। তবে একটি টিম দুর্ঘটনাস্থলে রাখা হয়েছে।

“ডুবন্ত জাহাজ পানির ওপরে তোলা হলে তার ভেতরে তল্লাশি চালানো হবে। পানির নিচে উদ্ধার অভিযান আগামীকাল (সোমবার) পুনরায় শুরু হবে।”

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) একটি উদ্ধারকারী জাহাজ ও একটি বার্জের সহায়তায় লঞ্চটিকে উঠানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে সন্ধ্যায় শীতলক্ষ্যা পাড়ে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান।

“লঞ্চটি পানির ২৫ মিটার (প্রায় ৫৫ হাত) গভীরে ডুবে আছে এবং এটি দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে,” বলেন তিনি।

রাত পৌনে ১০টার দিকে উদ্ধারকারী জাহাজ প্রত্যয় ঘটনাস্থলে পৌঁছে।

এরপর বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক (নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছে উদ্ধার জাহাজ প্রত্যয়। ডুবে যাওয়া লঞ্চটিকে বেঁধে ওপরে তোলা হবে।

রাতে অভিযান চলবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এখন আমাদের কাজ চলছে।”

নারায়ণগঞ্জ লঞ্চ টার্মিনাল থেকে মুন্সীগঞ্জের যাওয়ার পথে রোববার সোনাকান্দা এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীতে রূপসী-৯ জাহাজের ধাক্কায় ডুবে যাওয়া লঞ্চটি উদ্ধারে কাজ করছে।

রোববার দুপুর ২টার দিকে নারায়ণগঞ্জ সদরের সৈয়দপুর এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীতে সিটি গ্রুপের মালিকানাধীন মালবাহী জাহাজ রূপসী-৯ পেছন থেকে চাপা দিলে ডুবে যায় যাত্রীবাহী লঞ্চ এমএল আফসার উদ্দিন। লঞ্চটির নারায়ণগঞ্জ থেকে মুন্সীগঞ্জে যাচ্ছিল। 

সদর নৌ থানার ওসি মনিরুজ্জামান বলেন, রূপসী-৯ সিটি গ্রপের মালিকানাধীন একটি কার্গো জাহাজ। জাহাজ চলাচাল সম্পর্কিত ওয়েবসাইট ভেসেলফাইন্ডারে রূপসী-৯ এর মালিক হিসাবে সিটি সিড ক্রাশিং ইন্ডাস্ট্রিজের নাম রয়েছে।

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য সিটি গ্রুপের পরিচালক পরিচালক বিশ্বজিত সাহাকে ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।

রাকিব আল রাজু নামে একজন কাছের আরেকটি লঞ্চ থেকে ওই ঘটনার ভিডিও মোবাইল ফোনে ধারণ করে ফেইসবুকে দিলে তা ভাইরাল হয়ে যায়। সেখানে দেখা যায়, রূপসী-৯ জাহাজটি একপাশ থেকে চলন্ত লঞ্চটির ওপর চেপে বসে। লঞ্চের আতঙ্কিত যাত্রীরা নদীতে লাফিয়ে পড়তে শুরু করেন। এ অবস্থা চলে প্রায় ২৫ সেকেন্ড। এক পর্যায়ে লঞ্চটি ডুবে যায়।

ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি নৌ পুলিশ ও বিআইডব্লিউটিএ উদ্ধারকাজে অংশ নিচ্ছে।

৬ লাশ উদ্ধার, ৪টি হস্তান্তর

রাতে উদ্ধার অভিযান স্থগিতের আগ পর্যন্ত যে ছয়জনের লাশ উদ্ধার করা হয়, তার চারটি স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।  

যাদের লাশ শনাক্ত হয়েছে তারা হলেন- মো. জয়নাল (৫০), স্মৃতি (২০), আরিফা বেগম (৩৫) ও তার দেড় বছরের সন্তান শাফায়েত।

নৌ পুলিশ নারায়ণগঞ্জের এসপি মিনা মাহমুদা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নিহতদের মধ্যে চারজনের লাশ শনাক্ত করে নিয়ে গেছেন স্বজনরা।

একটি শিশু ও একজন পুরুষের লাশ নারায়ণগঞ্জ নৌ থানা প্রাঙ্গণে রাতেও রাখা ছিল।

নৌ পুলিশের কাছে চারজনের নিখোঁজ হওয়ার তথ্য দিয়েছেন তাদের স্বজনেরা। তারা হলেন আব্দুল্লাহ জাবেদ (২৭), হাতেম আলী (৬০), আরোহী (১৮ মাস) এবং জোবায়ের হোসেন।

নারায়ণগঞ্জের সোনাকান্দা এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীতে রোববার মালবাহী জাহাজ রূপসী-৯ এর ধাক্কায় অর্ধশত যাত্রী নিয়ে মাঝনদীতে ডুবে যায় একটি লঞ্চ। লঞ্চডুবির পর উৎসুক মানুষ ভিড় করে নদীর পাড়ে।

‘এখনও নিখোঁজ ১৫-২০ জন’

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান জানান, ফায়ার সার্ভিসের দুটি দলের পাঁচজন ডুবুরি এখানে কাজ করছেন। তারা পানির নিচ থেকে দুর্ঘটনায় নিহত পাঁচজনের লাশ উদ্ধার করেছেন। আর একজন লঞ্চ যাত্রী সাঁতার কেটে ফিরে আসার পর মারা যান। 

কতজন নিখোঁজ রয়েছে জানতে চাইলে লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর বলেন, “লঞ্চের যাত্রীদের ভাষ্য অনুযায়ী, সেখানে ৪০ থেকে ৫০ জনের মতো যাত্রী ছিলেন। তাদের মধ্যে ২০ থেকে ২৫ জন তীরে উঠতে পেরেছেন। ছয় জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।

“ধারণা করা হচ্ছে, এখনও ১৫ থেকে ২০ জন নিখোঁজ রয়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত কোনো স্বজন নিখোঁজ থাকার বিষয়ে অভিযোগ জানাননি।”

নারায়ণগঞ্জের এই এলাকায় নদীর পানি দূষণে কালো রং ধারণ করেছে। পাড়ে দাঁড়ালে কটূ গন্ধ পাওয়া যায়।

ফায়ার সার্ভিসের একজন ডুবুরি বলেন, “এ রকম দূষিত পানিতে উদ্ধার অভিযান চালানো বেশ কষ্টসাধ্য ।“

তদন্তে নৌ পরিবহনের কমিটি

এ ঘটনা তদন্তে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে। কমিটিকে আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

অফিস আদেশে বলা হয়েছে, এ ঘটনায় নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আ ন ম বজলুর রশীদকে আহ্বায়ক করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অন্য দুই সদস্য হলেন- ক্যাপ্টেন আবু সাইদ মোহাম্মদ দেলোয়ার রহমান ও বিআইডব্লিউটিএ এর পরিচালক (নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক)।

কমিটি দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দুর্ঘটনার কারণ উদঘাটন এবং দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তি বা সংস্থাকে শনাক্ত করবে। এ ছাড়া দুর্ঘটনা প্রতিরোধে করণীয় নির্ধারণ করে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করবে বলে আদেশে বলা হয়েছে।

নারায়ণগঞ্জের সোনাকান্দা এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীতে রোববার মালবাহী জাহাজ রূপসী-৯ এর ধাক্কায় অর্ধশত যাত্রী নিয়ে মাঝনদীতে ডুবে যায় একটি লঞ্চ। লঞ্চডুবির পর উৎসুক মানুষ ভিড় করে নদীর পাড়ে।

জরুরি যোগাযোগে ‘হটলাইন’

লঞ্চডুবির ঘটনায় জরুরি যোগাযোগের জন্য বিআইডব্লিউটিএ একটি ‘হটলাইন’ খুলেছে; যারা নম্বর-১৬১১৩।

বিআইডব্লিউটিএর এর উপ-পরিচালক মিজানুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সংস্থার প্রধান কার্যালয়ের ষষ্ঠ তলায় ৬১৭ নম্বর কক্ষে নিয়ন্ত্রণ কক্ষে এই হটলাইন চালু করা হয়েছে।

এছাড়া আরও দুটি টেলিফোন নম্বরও দেওয়া হয়েছে। সেগুলো হল- +৮৮০২২২৩৩৫২৩০৬; মোবাইল- +৮৮০১৯৫৮৬৫৮২১৩।

মিজানুর বলেন, এই লঞ্চ দুর্ঘটনা সংক্রান্ত যে কোনো তথ্যের জন্য এই হটলাইন যোগাযোগ করার অনুরোধ জানানো হচ্ছে।

আরও পড়ুন