মুশতাকের মৃত্যুতে ‘অপমৃত্যু’ মামলা

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় কারাগারে থাকা মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর ঘটনায় থানায় একটি ‘অপমৃত্যু’ মামলা করেছে কারা কর্তৃপক্ষ।

গাজীপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Feb 2021, 01:26 PM
Updated : 26 Feb 2021, 05:55 PM

শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে মুশতাকের মরদেহ শুক্রবার বিকালে পৌঁছেছে ঢাকার লালমাটিয়ায় তার বাসায়।

মুশতাকের চাচাতো ভাই ডা. নাফিসুর রহমান সাংবাদিকদের বলেছেন, এশার পর লালমাটিয়া সি ব্লকের মিনার মসজিদে জানাজা শেষে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হবে তার ভাইকে।

বৃহস্পতিবার রাতে গাজীপুরের কাশিমপুরের হাই সিকিউরিটি কারাগারে মৃত্যু হয় ৫৩ বছর বয়সী মুশতাকের। কীভাবে তার মৃত্যু হল, সে বিষয়ে এখনও কর্তৃপক্ষের স্পষ্ট কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

পেশায় ব্যবসায়ী মুশতাক অনলাইনে লেখালেখিতে বেশ সক্রিয় ছিলেন। সেটি কেন্দ্র করেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় পড়েন তিনি।

করোনাভাইরাস সঙ্কটের মধ্যে গত বছরের ৬ মে র‌্যাব মুশতাককে তার লালমাটিয়ার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। তার সঙ্গে কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরকেও গ্রেপ্তার করা হয়।

পরদিন ‘সরকারবিরোধী প্রচার ও গুজব ছড়ানোর’ অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তাদের বিরুদ্ধে রমনা থানায় মামলা করা হয়।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় কারাবন্দি লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর প্রতিবাদে শুক্রবার শাহবাগ মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখান বামপন্থী বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

এরপর গত নয় মাসে ছয়বার মুশতাকের জামিন আবেদন নাকচ হয়েছে, যা নিয়ে সমালোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে। সমালোচনা চলছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা নিয়েও।

মুশতাকের মৃত্যুর ঘটনার প্রতিবাদে বামপন্থি বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন শুক্রবার দুপুরে ঢাকার শাহবাগ মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখিয়েছে। তারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের পাশাপাশি মুশতাকের মৃত্যুর তদন্ত ও বিচার দাবি করেছে। বিকালে জাতীয় যাদুঘরের সামনে তার গায়েবানা জানাজাও হয়েছে।

কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ জেল সুপার মো. গিয়াস উদ্দিন নিজে বাদী হয়ে শুক্রবার গাজীপুর সদর থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা করেছেন। 

তিনি বলেন,বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কারাগারের ভেতরে মুশতাক হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে কারা হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে সেখান থেকে নেওয়া হয় গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

গাজীপুরের নির্বাহী হাকিম ও সহকারী কমিশনার মো. ওয়াসিম উজ্জামান চৌধুরীর উপস্থিতিতে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মুশতাকের মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত করেন সদর থানার এসআই সৈয়দ বায়েজীদ।

তিনি বলেন, “তার পিঠে আগের যে কোনো সময় ঘা হওয়ার মত দাগ পাওয়া গেছে। ডান হাতে হালকা লালচে-কালো ছোট দাগ পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, হাসপাতালে আনার সময় বা গাড়িতে ওঠানো-নামানোর সময় এ দাগ হয়ে থাকতে পারে।”

মুশতাকের মরদেহের ময়নাতদন্ত করার পর গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. শাফী মোহাইমেন বলেন, “বৃহস্পতিবার রাতে মৃত অবস্থায় তাকে এ হাসপাতালে আনা হয়েছিল। দৃশ্যত গায়ে কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।”

মুশতাক আহমেদ

মৃত্যুর কারণ জানতে ভিসেরা সংরক্ষণ করা হয়েছে জানিয়ে ডা. মোহাইমেন বলেন, ঢাকার সিআইডির ল্যাবে কেমিকেল অ্যানলাইসিস এবং ঢাকা মেডিকেলে হিস্টোপ্যাথলজি পরীক্ষা করা হবে। 

সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত শেষে শুক্রবার দুপুরে মুশতাকের মরদেহ তার স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বিকালে লাশবাহী গাড়ি পৌঁছায় লালমাটিয়ার সি ব্লকের বাসায়।

নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানার ছোট বালাপুর এলাকার আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে মুশতাক বাংলাদেশে কুমির চাষের অন্যতম উদ্যোক্তা।

যুক্তরাজ্যে পড়াশোনারে সুযোগে ফ্রান্সের বিভিন্ন খামার ঘুরে দেখে দেশে ফেরার পর এক যুগ আগে ময়মনসিংহের ভালুকায় দেশের প্রথম কুমির খামার করতে নেমেছিলেন মুশতাক। বাংলাদেশ থেকে কুমির রপ্তানি তার হাত দিয়েই শুরু হয়। এ বিষয়ে একটি বইও লিখেছেন তিনি।

লেখক মুশতাক আহমেদের মরদেহ শুক্রবার বিকালে আনা হয় তার লালমাটিয়ার বাসায়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় বন্দি মুশতাক বৃহস্পতিবার রাতে কাশিমপুর কারাগারে মারা যান। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

মুশতাক ও কিশোকে গ্রেপ্তারের পর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যে মামলা করা হয়, সেখানে রাষ্ট্রচিন্তা সংগঠনের দিদারুল ভূইয়া এবং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক পরিচালক মিনহাজ মান্নানকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এ দুজন পরে জামিনে মুক্তি পান। মুশতাকের মত কিশোরের জামিনের আবেদনও কয়েক দফা নামঞ্জুর হয়।

এ মামলায় আসামির তালিকায় আরও ছিলেন নেত্র নিউজের সম্পাদক সুইডেন প্রবাসী তাসনিম খলিল, জার্মানিতে থাকা ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক শাহেদ আলম, হাঙ্গেরি প্রবাসী জুলকারনাইন সায়ের খান (আল জাজিরার প্রতিবেদনের স্যামি), আশিক ইমরান, স্বপন ওয়াহিদ ও ফিলিপ শুমাখার।

তবে তদন্তের পর পুলিশ শুধু মুশতাক, কিশোর ও দিদারকে আসামি করে এ মাসের শুরুতে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। বাকি আট আসামিকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা।