পাবনায় পেপার মিলের বর্জ্যে ক্ষতিগ্রস্ত বিপুল কৃষি জমি

পাবনায় একটি কাগজ কলের রাসায়নিক বর্জ্যে কয়েকশ একর ফসলের জমি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

সৈকত আফরোজ আসাদ পাবনা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Nov 2020, 04:10 AM
Updated : 30 Nov 2020, 05:23 AM

স্থানীয়দের অভিযোগ, তিন বছর আগে মিল স্থাপনের পর থেকে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় স্থায়ী জলাবদ্ধতায় অনাবাদি হয়ে পড়েছে ঈশ্বরদী উপজেলার ১০ গ্রামের কয়েকশ একর ফসলি জমি।

এছাড়া বিষাক্ত বর্জ্যের কারণে জলাশয়ের মাছ মারা যাচ্ছে এবং পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ছে বলেও তাদের অভিযোগ।

রশিদ পেপার মিলের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ উঠলেও আরও কয়েকটি কারখানা সেখানে ইতিমধ্যে গড়ে উঠেছে।

তবে পরিবেশ দূষণের কথা অস্বীকার করেছে রশিদ পেপার মিল কর্তৃপক্ষ।

স্থানীয়রা জানান, ২০১৭ সালে পাবনার মুলাডুলির সরাইকান্দি গ্রামের বিএডিসির পানাসি (পাবনা-নাটোর-সিরাজগঞ্জ) সেচ প্রকল্পের আওতাধীন কৃষি জমি ভরাট করে গড়ে তোলা হয় রশিদ পেপার মিল।

গ্রামের পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ করে কারখানা গড়ে তোলে ওঠায় তিন বছর আগে রশিদ পেপার মিলে উৎপাদন শুরুর পর রাসায়নিক মিশ্রিত দূষিত বর্জ্য ও অপরিশোধিত পানি চাষের জমিতে পড়া শুরু হয়। দুর্গন্ধযুক্ত এই পানিতে ধানসহ বিভিন্ন ফসল নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি ব্যাপকভাবে এলাকায় পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। 

সরেজমিনে ভদ্রার বিল এলাকায় দেখা যায়, জলাবদ্ধতা ও কারখানার দূষিত বর্জ্যের কারণে বিলের বুক জুড়ে এখন কচুরিপানার রাজত্ব। কারখানা বর্জ্য প্রবাহিত হচ্ছে কৃষি জমির উপর দিয়ে।

গ্রামবাসীরা জানান, এক সময় কৃষাণ-কৃষাণীর কর্মচাঞ্চল্যে দিনভর মুখরিত হয়ে থাকত মুলাডুলির ভদ্রার বিল। শত শত একর জমি জুড়ে ফলত ফসল। এতে জীবন-জীবিকা জড়িয়ে ছিল হাজারো কৃষক পরিবারের। সেই জমি এখন নীরব নিস্তব্ধ।

সরইকান্দি গ্রামের কৃষক আমজাদ হোসেন বলেন, রশিদ পেপার মিল নির্মাণের স্থান দিয়েই ভদ্রার বিলের পানি বের হয়ে যাওয়ার প্রধান নালা ছিল। ২০১৭ সাল থেকে পেপার মিল নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার পর এই নালা বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিলের পানি বের হওয়ার আর কোনো বিকল্প পথ না থাকায় শত শত একর জমিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এই বিলের জমিতে বছরে দুইটি ফসলের আবাদ করা যেত। জলাবদ্ধতার কারণে এখানে তিন বছর ধরে কোনো আবাদ হয় না।

দাশুড়িয়ার আফজাল হোসেন বলেন, পেপার মিল ছাড়াও আশপাশে আরও কয়েকটি কারখানা গড়ে উঠেছে। জলাবদ্ধতার কারণে এখানকার কৃষকরা বাধ্য হয়েই শিল্প কারখানার মালিকদের কাছে স্বল্প মূল্য জমি বিক্রি করে দিচ্ছে।

মুলাডুলি ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য আব্দুল আজিজ বলেন, ভদ্রার বিল থেকে পানি নিষ্কাশন ক্যানেল হয়ে নদীতে গিয়ে মিশত। দুই মৌসুমে গ্রামের চাষিরা বছরে দুটি ফসল পেত। কিন্তু রশিদ পেপার মিলসহ কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠান পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ করে স্থাপনা নির্মাণ করেছে।

“ফলে পানি নির্গমনের পথ বন্ধের কারণে সৃষ্ট স্থায়ী জলাবদ্ধতায় গত তিনবছর ধরে অনাবাদী হয়ে পড়েছে উপজেলার সরাইকান্দি, লক্ষ্মীকোলা, চাঁদপুর, দরগাপাড়া, কারিগরপাড়া, দেবীপুর, বহরপুর, রামচন্দ্রপুর গ্রামের প্রায় ৫০০ একর কৃষিজমি।”

রাসায়নিক মিশ্রিত দুর্গন্ধযুক্ত পানি পুকুরে মেশায় মাছ মারা যাচ্ছে বলেও তিনি জানান।

“কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষতিপূরণ ও প্রতিকার চেয়ে উল্টো ভয়-ভীতি ও হুমকি মিলেছে। তারা আমাদের কথার তোয়াক্কাই করছে না।”

তবে নীতিমালা মেনে পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে উৎপাদন চলছে জানালেও সংবাদকর্মীদের কারখানায় প্রবেশ করতে দেয়নি কর্তৃপক্ষ। সাক্ষাতেও কথা বলেননি রশিদ পেপার মিল মালিক কিংবা তার কোনো প্রতিনিধি।

পরে কয়েকদিন টানা চেষ্টার পর প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক জহিরুল হকের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রশিদ পেপার মিলে জার্মান প্রযুক্তির ইটিপি ব্যবহার হচ্ছে। ‘মেশিন অ্যাডজাস্ট করতে কিছুটা অসুবিধা হওয়ায়’ পানি অন্যের জমিতে গিয়েছে। এটি সমাধান হয়ে যাবে।

“একটি পুকুরের তিন চারটি মাছ মারা গেছে; এ নিয়ে মাথা ব্যথার কিছু নেই।”

কৃষি জমিতে শিল্পায়নের ব্যপারে জহিরুল ইসলাম বলেন, কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগে কারখানা স্থাপন করা হয়েছে। সরকারি অনুমোদন নিয়ে সকল কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

তবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অমান্য করে কৃষি জমি নষ্ট করে শিল্পায়নের ‘সুযোগ নেই’ বলে মন্তব্য করেছেন পাবনা জেলা প্রশাসক কবীর মাহমুদ।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কৃষি প্রধান এলাকায় ফসলি জমিতে কীভাবে এই শিল্প প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে তা খতিয়ে দেখা হবে। সাধারণ কৃষকদের ক্ষতি করে কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান চলতে পারে না। এই ব্যপ্যারে প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়া হবে।