করোনাভাইরাসে রপ্তানি বন্ধ: লোকসানে বাগেরহাটের কাঁকড়া চাষি

করোনাভাইরাস সংক্রমণের মধ্যে হঠাৎ রপ্তানি বন্ধ থাকায় লোকসানের মুখে পড়েছেন বাগেরহাটের শত শত কাঁকড়া চাষি।

অলীপ ঘটক বাগেরহাট প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Oct 2020, 02:16 PM
Updated : 16 Oct 2020, 02:17 PM

বাংলাদেশ থেকে কাঁকড়ার সবচেয়ে বড় আমদানিকারী দেশ হলো চীন। এছাড়া রয়েছে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গপুর। করোনাভাইরাস সংক্রমণ মহামারী আকার ধারণ করার পর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়।

তবে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গপুর সীমিত আকারে কাঁকড়া নিলেও দাম অনেক কম। লোকসানের আশঙ্কায় জেলার বহু চাষি এবার কাঁকড়া চাষে বিনিয়োগ বন্ধ রেখেছেন।

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলায় ব্যাপক কাঁকড়া চাষ হয়। লোনা পানিতে শিলা জাতের কাঁকড়া চাষ করেন চাষিরা। কাঁকড়া চাষে ঝুঁকি কম হওয়ায় গত প্রায় এক দশক ধরে কয়েক হাজার চাষি এই পেশায় নেমেছেন।

নারী কাঁকড়ার প্রতি কেজির বর্তমান রপ্তানি মূল্য ছয়শ টাকা এবং পুরুষ কাঁকড়া পাঁচশ টাকা; যা গত বছর ছিল যথাক্রমে ১২শ ও এক হাজার টাকা।

বাগেরহাটের কাঁকড়া চাষি, ডিপো মালিক ও মৎস্য বিভাগের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

জেলা মৎস্য বিভাগ জানায়, বাগেরহাটের সাত উপজেলায় ৭০৬ হেক্টর জমিতে এক হাজার ৪১৬টি কাঁকড়ার খামার রয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কাঁকড়া উৎপাদন হয় দুই হাজার ৬২৯ মেট্রিকটন। আগামী অর্থ বছরে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় তিন হাজার মেট্রিক টন।

নদী ও খাল হচ্ছে কাঁকড়ার বিচরণ ক্ষেত্র। এক দশক আগে সরকার বিদেশে কাঁকড়ার বাজার তৈরি করার পর বাগেরহাটে কাঁকড়ার বাণিজ্যিক চাষ শুরু হয়। সেসময় স্থানীয় কিছু চাষি নদী থেকে কাঁকড়া সংগ্রহ করে চাষ শুরু করেন। দিন দিন চাহিদা বেড়ে যাওয়া এবং ভালো লাভ হওয়ায় জমি মালিকরা কাঁকড়া চাষে ঝুঁকতে থাকেন।

কাঁকড়া চাষ সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ কাঁকড়া রপ্তানি হয়। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চার মাস কাঁকড়ার ব্যাপক চাহিদা থাকে। মৌসুমের শুরুতে প্রতিদিন শুধু বাগেরহাট থেকেই রপ্তানি হয় ১২ থেকে ১৫ মেট্রিক টন। এই চার মাসে প্রায় দেড় হাজার মেট্রিক টন কাঁকড়া বিদেশে রপ্তানি হয়।

বাগেরহাটের জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. খালেদ কনক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দেশের মোট কাঁকড়া রপ্তানির ত্রিশ ভাগেরও বেশি যায় এই জেলা থেকে। ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি এই তিন মাস চীনে নানা উৎসব থাকে। এই সময় বিপুল পরিমাণ কাঁকড়া নেয় তারা আমাদের দেশ থেকে।

“মোট কাঁকড়া রপ্তানির শতকরা ৭০ থেকে ৮০ ভাগ যায় চীনের বাজারে। কাঁকড়া  ও কুচে রপ্তানি করে গত ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে আয় হয়েছে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা।”

খালেদ কনক জানান, ভরা মৌসুমে চীনে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব হওয়ায় তারা কাঁকড়া নিচ্ছে না। তাই গত ২৩ জানুয়ারি থেকে সরকার কাঁকড়া রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। পরে মৎস্য অধিদপ্তর ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চীনের সঙ্গে যোগাযোগ করে গত সেপ্টম্বর মাসে আবার রপ্তানি চালু করে।

“চলতি মাসে চীন হঠাৎ করে আবার কাঁকড়া নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তারা কী কারণে কাঁকড়া নিচ্ছে না তা এখনও জানতে পারিনি। তবে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে রপ্তানি সীমিত পরিসরে চালু রয়েছে।”

চীনের বাজারে রপ্তানি বন্ধ থাকা এবং গত ভরা মৌসুমে রপ্তানি না হওয়ায় কাঁকড়া চাষিদের বিপুল লোকসান হয়েছে; এই কারণে এ বছর লোকসানের আশঙ্কায় জেলার বহু চাষি কাঁকড়া চাষ করছে না বলে জানান এই মৎস্য কর্কর্তা।

বাগেরহাট শহরের নাগেরবাজারের কাঁকড়া ব্যবসায়ী অনিক এন্টারপ্রাইজের মালিক অসীম সাহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রতি বছর কাঁকড়ার ভরা মৌসুমে (নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) আমার ডিপোতে দুই থেকে তিন মেট্রিক টন কাঁকড়া কেনাবেচা হয়।

“করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে সবচেয়ে বড় বাজার চীনে কাঁকড়া রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে ছোট কিছু দেশে অনিয়মিতভাবে সীমিত পরিসরে রপ্তানি চালু রয়েছে। তবে দাম নেই। কবে নাগাদ কাঁকড়ার বাজার স্বাভাবিক হবে তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না।”

বাগেরহাট সদর উপজেলার বেমরতা ইউনিয়নের বেনেগাঁতি গ্রামের কাঁকড়া চাষি মোক্তার শেখ বলেন, “আগে আমি বাগদা চিংড়ির চাষ করতাম। চিংড়িতে মড়ক ও নানা রোগ বালাইতে প্রতি বছর লোকসান হচ্ছিল। আমাদের এখানে বাণিজ্যিকভাবে কাঁকড়ার চাষ শুরু হলে আমি চিংড়ি চাষ ছেড়ে কাঁকড়া চাষ শুরু করি। 

“গত পাঁচ বছর ধরে ১২ শতাংশ জমিতে কাঁকড়া চাষ করছি। এতে মুনাফা ভালো হয়।”

তিনি বলেন, চলতি বছর হঠাৎ করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে কাঁকড়া রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়; যার কারণে ঘের থেকে সময়মত কাঁকড়া না ধরায় সব মরে যায়। এ বছর প্রায় এক লাখ টাকা লোকসান হয়েছে।

আগামী মৌসুমের জন্য কাঁকড়ার চাষ করছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কবে কমবে তা কেউ বলতে পারছে না। বর্তমানে অল্প কয়টা দেশে কাঁকড়া রপ্তানি হচ্ছে। সেসব দেশে আবার দামও অনেক কম। চীন দেশেই কাঁকড়ার সবচেয়ে বড় বাজার সেই বাজার কবে খুলবে তা অনিশ্চিত। তাই আমি আমার ঘেরে কাঁকড়া এখনও ছাড়িনি।”

আরেক ক্ষুদ্র চাষি কালা সাহা বলেন, “আমি আট শতাংশ জমিতে কাঁকড়ার চাষ করে আসছি। এই ঘেরে কাঁকড়ার আয় দিয়ে আমার সংসার চলে। এই বছর বিদেশে কাঁকড়া রপ্তানি বন্ধ থাকায় বড় বড় কাঁকড়া মরে গেছে। এতে আমার এক লাখ টাকারও বেশি লোকসান হয়েছে। এ বছর আমি কাঁকড়া চাষ বন্ধ রেখেছি।”

রামপাল উপজেলার ভাগা গ্রামের বিশ্বজিত মণ্ডল বলেন, “গত মৌসুমে এক বিঘা জমিতে আমি কাঁকড়া চাষ করি। ব্যাংক থেকে পাঁচ লাখ টাকা্ ঋণ নিয়ে কাঁকড়া চাষ করি। কাঁকড়ার উৎপাদনও ভালো হয়। গত ফেব্রুয়ারিতে হঠাৎ চীনের বাজার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমার ঘেরে থাকা প্রায় তিন মেট্রিক টন কাঁকড়া মরে যায়। এতে আমি দারুণভাবে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছি। আমি এখন দেনাগ্রস্থ হয়ে পড়েছি।”

কাঁকড়া চাষি অসীম সাহা বলেন, “লাভজনক হওয়ায় সাত আট বছর ধরে কাঁকড়ার চাষ করছি। পাঁচ বিঘা জমিতে এই বছর অন্তত ৪০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলাম। চীন কাঁকড়া নেওয়া বন্ধ করায় আমরা খামার থেকে কাঁকড়া না ধরায় কাঁকড়া মরে যায়। এতে আমার অন্তত ২০ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। এই বছর আমি কাঁকড়া চাষ বন্ধ রেখেছি।”

বাগেরহাট জেলা কাঁকড়া চাষি সমবায় সমিতির সভাপতি দীপঙ্কর মজুমদার বলেন, বাগেরহাট জেলার সদর, রামপাল ও মোংলা উপজেলায় প্রায় দুই হাজার কাঁকড়া চাষি রয়েছেন। বিদেশে রপ্তানি হওয়ায় দিনদিন এর চাষ বাড়ছে। কাঁকড়া রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার চীন। করোনাভাইরাসের কারণে গত ফেব্রুয়ারি থেকে চীনে রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ছোট ছোট দেশও আমদানি বন্ধ করে দেয়। গত সেপ্টম্বর মাসে ছোটো ছোটো কিছু দেশে সীমিত আকারে কাঁকড়া রপ্তানি হচ্ছে, তবে দাম নেই।

“এখানকার চাষিরা অনেকেই ব্যাংক, এনজিও ও মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে এই চাষে বিনিয়োগ করে থাকে। নভেম্বর মাস আসছে আবার কাঁকড়া রপ্তাতির ভরা মৌসুম। জেলার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ কাঁকড়া চাষি চাষ বন্ধ রেখেছেন।”

কাঁকড় শিল্পকে বাঁচাতে সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন চাষি সমিতির এই নেতা।

সরকারের কৃষি তথ্য সার্ভিসের (এআইএস) ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, কাঁকড়া বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই দেশের রপ্তানিযোগ্য মৎস্য সম্পদের মধ্যে চিংড়ির পরেই কাঁকড়ার স্থান। আমাদের দেশে বর্তমানে উৎপাদিত কাঁকড়ার পরিমাণ সঠিকভাবে নিরূপণ করা সম্ভব না হলেও কাঁকড়া রপ্তানি থেকে প্রতি বছর প্রায় ২৫ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে। 

প্রজাতিভিত্তিক মিঠা ও লোনা পানির উভয় পরিবেশে কাঁকড়া বেঁচে থাকে। মিঠা পানির কাঁকড়া আকারে ছোট এবং লোনা পানির কাঁকড়া আকারে বেশ বড় হয়। দেশের প্রাপ্ত সর্বমোট ১৫টি প্রজাতির কাঁকড়ার মধ্যে চার প্রজাতির কাঁকড়া সাধু বা মিঠা পানির এবং ১১টি প্রজাতির সামুদ্রিক।

সেন্টমার্টিন ব্যতীত কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, পটুয়াখালী, বরিশাল, সাতক্ষীরা ও খুলনার উপকূলীয় নদী এবং মহেষখালী, কুতুবদিয়া, সন্দ্বীপ, হাতিয়া, দুবলারচর এলাকা, উপকূলীয় চিংড়ির খামার, সমুদ্রের মোহনা, নদী এবং ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলে (সুন্দরবন) কাঁকড়ার বিস্তৃতি দেখা যায়। গত কয়েক বছর ধরে চিংড়ির মতো বিদেশে রপ্তানি শুরু হওয়ায় উপকূলবাসীর মধ্যে কাঁকড়ার চাষ সম্পর্কে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত কাঁকড়া পরিকল্পিতভাবে চাষে উৎসাহ সৃষ্টি হয়।