‘চাইল চাই ন্যা, আমাগেরে কাম দ্যান’

“চাইর দিকে পানি, কাজকাম পাইতেছি না। বালবাচ্চা নিয়্যা কষ্টে দিন কাটাইতে হইতেছে। চাইল আর শুকন্যা খাবারে কয় দিন চলবে? এহন আমরা আর এই চাইল চাই ন্যা, আমাগেরে কাজ দেন।”

শেখ মফিজুর রহমান শিপন ফরিদপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 July 2020, 09:58 AM
Updated : 23 July 2020, 05:57 PM

ফরিদপুর সদর উপজেলার ডিক্রিরচর ইউনিয়নের ধলার মোড়ে বেড়িবাঁধে আশ্রয় নেওয়া কৃষক মো. বাচ্চু শেখ এভাবেই জীবনজীবিকার অনিশ্চয়তার কথা বলছিলেন।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ১০ দিন ধরে তারা বেড়িবাঁধের ওপর পরিবার নিয়ে আছেন। বাঁধের পাশেই পানি। তাছাড়া কয়েক দিন ধরে সমানে ঝরছে বৃষ্টি।

পলিথিন আর বাঁশ দিয়ে তৈরি অস্থায়ী ছাউনি যে কখন বাতাস এসে উড়িয়ে নিয়ে যায় সেই ভাবনাতে রাতে তার ঘুম আসে না।

বাচ্চু বলেন, স্ত্রী ও তিন সন্তানের সঙ্গে গরু-ছাগল ও হাঁসমুরগি নিয়ে এখানে বসত গড়েছেন তিনি। এখানে আসার পর একবার ইউনিয়ন পরিষদ থেকে কিছু চাল আর শুকনো খাবার পেয়েছেন।

“তাতে তো আর সকলের পেট বাঁচে না!”

ফরিদপুর পৌরসভার ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের হরিসভার বাসিন্দা ষাটোর্দ্ধ নূরজাহান বেগমেরও একই অবস্থা।

তিনি বলেন, “হঠাৎ কইর‌্যা বানের পানিত বাঁধ ভাইঙ্গ্যা ঘরবাড়ি তলায় গেল। ঘরের মাল-সামানও কিছু বাইর করতি পারি নাই। পাঁচজন ছাওয়াল-মাইয়ার সাথে গরু-বাছুর নিয়্যা রাস্তার উপর পলিথিন আর বাঁশের বেড়া দিয়্যা ঘর তুইল্যা রইছি। এখন কয়ডা টিন পাইলে ঘরডা তুলতি পারতাম।”

গবাদিপশু নিয়ে তারা আরও বেশি বিপাকে আছেন বলে জানান।

হাফিজা খাতুন নামে ওই এলাকার আরেক বাসিন্দা বলেন, “পরিবারের হগলতিরে নিয়্যা আইজ প্রায় এক সপ্তাহ রাস্তায় পইর‌্যা রইছি। আমাগের অবস্থা যেমন তেমন, গরু-ছাগলের খাবার জুটাইতি পারতেছি না। অবলা প্রাণী খিদের জ্বালায় চিৎকার পারে। সহ্য করা যায় না।”

জেলা শহরের টিবি হাসপাতাল মোড় থেকে পূর্ব দিকে চলে গেছে গুচ্ছ গ্রামের রাস্তা, যেখানে শুধুই হতদিরদ্র পরিবারের বসবাস। এই বন্যায় ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় এসব পরিবার এসে আশ্রয় নিয়েছে উঁচু সড়কে। সেখানকার মানুষের দুর্ভোগ আরও বেশি।

আছিয়া বেগম নামে একজন গৃহবধূ বলেন, “গত পাঁচ দিন হইল এহেনে উঠছি। একবার চিঁড়্যা আর মুড়ি দিছিলো। তারপর আর কেউর দেখা নাই। এহন কি কইর‌্যা দিন চলবি আমাগের!”

বানভাসী মানুষের মাঝে এখন এমনই সব হাহাকারের চিত্র।

সপ্তাহ দুই আগে পদ্মার পানি ফরিদপুর সদর, চরভদ্রাসন ও সদরপুর উপজেলার চরাঞ্চলে ঢুকতে শুরু করে। গত পাঁচ দিনে বিভিন্ন স্থানে পানি বেড়ে যাওয়ায় এবং বাঁধ ভেঙে পড়ায় প্লাবিত হয়েছে এসব উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা। এছাড়া আড়িয়াল খাঁ ও কুমার নদের পানি বেড়ে বিভিন্ন খালনালা দিয়ে পানি প্রবেশ করেছে পাশের ভাঙ্গা ও নগরকান্দা উপজেলায়।

জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, জেলার পাঁচটি উপজেলার ৩০টি ইউনিয়নের দেড় শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

জেলা প্রশাসক অতুল সরকার বন্যার্তদের মাঝে পর্যাপ্ত সরকারি সহায়তা দেওয়া হচ্ছে জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, বানভাসী মানুষদের জন্য বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৫৫০ মেট্রিকটক চাল, সাত হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার ও সাত লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এসব সামগ্রী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং ইউনিয়ন পরিষদ জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে বিতরণ করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, ত্রাণের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। প্রয়োজনে বরাদ্দ আরও বাড়ানো হবে।

বৃহস্পতিবার দুপুরে ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের হরিসভার বেড়িবাঁধে আশ্রয় নেওয়া বন্যার্তদের খাদ্যসহায়তা দিয়েছে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ।

ফরিদপুর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি শওকত আলী জাহিদ বলেন, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে বন্যার্তদের মাঝে বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে।

এছাড়া যুবদলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির ফরিদপুর বিভাগীয় সহ-সভাপতি মাহবুবুল হাসান পিংকু আলিয়াবাদ সাদিপুর এলাকায় বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণসামগ্রী দিয়েছেন।