আম্পান গুঁড়িয়ে দিল আমচাষির স্বপ্ন

ভরা মৌসুমে আমের ফলন ওঠার ঠিক আগে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় আম্পান চাষিদের স্বপ্ন গুঁড়িয়ে দিয়েছে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 May 2020, 01:27 PM
Updated : 21 May 2020, 03:13 PM

দেশের পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে কয়েকটি জেলায় বড় আকারে আমের চাষ হয়। প্রতিবছর সাধারণত মে-এর মধ্যভাগ থেকে আম পাড়া শুরু হয়। বিভিন্ন জেলায় ইতিমধ্যে আম পাড়ার সময়ও নির্ধারণ করে দিয়েছিল প্রশাসন।   

কিন্তু এরই মধ্যে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় আম্পান বুধবার দুপুরের পর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ উপকূলে আঘাত হানে। পরে রাতে এ ঝড় প্রবেশ করে বাংলাদেশে। এরপর কয়েকটি জেলায় ব্যাপক তাণ্ডব চালায়।

প্রাথমিকভাবে ঘূর্ণিঝড় আম্পানে সারা দেশে এক লাখ ৭৬ হাজার হেক্টর জমির ফল ও ফসলের ক্ষতির তথ্য এসেছে জানিয়ে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক ঢাকায় এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ৭ হাজার ৩৮৪ হেক্টর জমির আমের আবাদের মধ্যে ১০ শতাংশ নষ্ট হয়েছে বলে তারা ধারণা করছেন।

তবে সাতক্ষীরা জেলায় ৬০-৭০ শতাংশ আম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেছেন, বিভিন্ন জেলায় ঝড়েপড়া আম জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে কিনে তা ত্রাণ হিসেবে দুস্থদের মাঝে বিতরণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিনিধিদের পাঠানো সংবাদে আমের ক্ষয়ক্ষতির চিত্র উঠে এসেছে।

রাজশাহী

বুধবার মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত ঝড়ে রাজশাহীর অন্তত ১৫ থেকে ২০ শতাংশ আম গাছ থেকে ঝরে পড়েছে বলে কৃষি বিভাগ ও জেলা প্রশাসন জানিয়েছে।

বৃহস্পতিবার সকালে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও রাজশাহী জেলা প্রশাসক হামিদুল হক সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বরেন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শামসুল হক বলেন, “রাতে বিভিন্ন স্থানে খোঁজ নিয়ে আমরা জেলা প্রশাসককে জানিয়েছিলাম যে ২০ শতাংশ আম ঝরে পড়েছে। তবে সকালে আমরা বিভিন্ন বাগান পরিদর্শন করে দেখছি ক্ষতির পরিমাণ আরেকটু কম। শহরে ১০ শতাংশ এবং চারঘাট উপজেলায় ১৫ শতাংশ আম ঝরে পড়েছে। তবে বাঘা উপজেলায় বেশি; সেখানে ঝরেছে প্রায় ২০ শতাংশ। সব মিলে আম ঝরেছে ১৫ শতাংশ।”

শামসুল হক আরও বলেন, “আম ঝরে গেলে ফলন কমে। এরপর চাষিরা যদি ভালো দাম না পান তাহলে হয়ত ক্ষতির মুখে পড়বেন। তাই আমের যেন সঠিক মূল্য পাওয়া যায় তার জন্য যা যা করা দরকার আমরা করার চেষ্টা করছি।”

তবে রাজশাহী জেলা প্রশাসক হামিদুল হক ক্ষতির পরিমাণ আরেকটু বেশি বলে মনে করেন। তিনি ক্ষতির পরিমাণ ২০ শতাংশ বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।

রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের পর্যবেক্ষক লতিফা হেলেন বলেন, আম্পানের মূল কেন্দ্র রাজশাহীতে আঘাত করেনি। তবে বৃহস্পতিবার রাত ২টা ৫৫ মিনিট থেকে ২টা ৫৮ মিনিট পর্যন্ত বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৫৯ কিলোমিটার। রাজশাহীতে ঝড়ের সঙ্গে বৃষ্টিপাতও হয়েছে। বুধবার ভোর ৬টা থেকে বৃহস্পতিবার ভোর ৬টা পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৮১ মিলিমিটার।

চাঁপাইনবাগঞ্জ

চাঁপাইনবাগঞ্জে ঝড়ে আমের বিপুল ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে চাষিরা বলছেন ২০ থেকে ৪০ শতাংশ আম ঝড়ে গেছে। অপরদিকে কৃষি বিভাগ বলছে আম ঝরেছে ৫ শতাংশের মতো।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজলার আম ব্যবসায়ী মোহাম্মদ মাসুদ বলেন, তার এলাকায় ১০ বিঘা আমবাগান আছে। রাতের ঝড়ে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ ভাগ আম ঝরে পড়েছে। তিনি ৩ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন। এ বছর মুকুল ভালো হলেও বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় আম ধরেছিল ৫০ ভাগের মত। এর মধ্যে ঝড়ে অর্ধেকেরও বেশি আম পড়ে যাওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছেন।

মূল পুঁজি ফিরে আসার সম্ভাবনাও নেই বলে তিনি মনে করছেন।

চাঁপাইনবাগঞ্জ শহরের শাহীবাগ এলাকার মনসুর আহমেদ পারভেজের গোমস্তাপুর উপজেলার রানীবাড়ি গ্রামে ৬৫ বিঘার পৈত্রিক বাগান আছে।

তিনি বলেন, “বাগানে মুকুল ভালো আসলেও ফেব্রুয়ারি মাসে বৃষ্টির কারণে আমার বাগানে অনেক মুকুল নষ্ট হয়ে যায়। বাগানে আমগাছে আম ধরেছিল কম। এদিকে ঝড়ে প্রায় ২০ ভাগ আম পড়ে গেছে।”

চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্পসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, “জেলায় সারা রাত ঝড়ে ৫ ভাগের মতো আম ঝরে পড়েছে।”

তিনি জানান, জেলায় ৩৩ হাজার ৩৫ হেক্টর জমিতে আমের চাষ হয়। গত বছর ২ লাখ ৩৯ হাজার মেট্রিক টন আম জেলায় উৎপাদন হয়েছিল।

প্রতি বছর আম বাগান বৃদ্ধি পাওয়ায় এবার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ২ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন বলে তিনি আশা করছেন। 

নওগাঁ

বুধবার সন্ধ্যা থেকে বৃহস্পতিবার বিকাল পর্যন্ত ঝড়-বৃষ্টিতে জেলার পোরশা, সাপাহার, নিয়ামতপুর, পত্নীতলা ও ধামইরহাট উপজেলার আম বাগানে ১০ থেকে ২৫ ভাগ আম ঝরে পড়েছে বলে চাষিদের অভিমত।

এতে আম চাষিদের প্রায় শত কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে স্থানীয়দের ভাষ্য।

পোরশা উপজেলা সদরের নিতপুরের আমবাগান মালিক মাহবুবুল আলম খোকন বলেন, তার বাগানের প্রায় ৪০ শতাংশ আম ঝরে পড়েছে। এছাড়া আশপাশের বাগানগুলোর ২৫ থেকে ৩০ ভাগ আম ঝরে পড়েছে।

সাপাহার উপজেলা সদরের আম বাগান মালিক জসিম উদ্দিন বলেন, তার বাগানের প্রায় ২৫ থেকে ৩০ ভাগ আম ঝরে পড়েছে। এছাড়া উপজেলার আম ঝরে পড়েছে কমপক্ষে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত।

নিয়ামতপুর, মান্দা, ধামইরহাট, বদলগাছি ও পত্নীতলাসহ অন্যান্য উপজেলা থেকেও এ ধরনের খবর পাওয়া গেছে।

তবে কৃষি  সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নওগাঁ উপ-পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেনছেন, তাদের পাওয়া খবর অনুসারে এ পর্যন্ত ঝড়ে ৩ থেকে ৫ শতাংশ আম ঝরে পড়েছে। ক্ষয়ক্ষতির পুরো পরিমাণ এখনও তারা নিরূপণ করতে পারেননি।

মেহেরপুর

এবার আমের ফলন ভালো হলেও করোনার কারণে বাইরের ব্যবসায়ীরা মেহেরপুরে আসতে না পারায় আমের বাজারজাত, মূল্য নিয়ে চাষিরা চিন্তিত ছিল। ঠিক তখনই আম্পান মেহেরপুরের আম চাষিদের স্বপ্ন মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিল।

আমের এই করুণ দৃশ্য নিকট অতীতে কখনও দেখা যায়নি বলে আম বাগান মালিক ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এই জেলার ল্যাংড়া, হিমসাগর, মুম্বাই জাতের আমের কদর ও খ্যাতি দেশ জুড়ে। প্রতিবছর এই জেলার আম এলাকার চাহিদা মিটিয়ে শুধু দেশেই নয় বিদেশেও রপ্তানি হয়।

মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আখতারুজ্জামান বলেন, প্রথমে করোনাভাইরাস মেহেরপুরের সুস্বাদু আমের বাজারে আঘাত হানে। ইউরোপের বাজার বন্ধ হয়ে যায়। সেই সাথে লকডাউনের কারণে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে মেহেরপুরের আমের চাহিদাও বন্ধ হয়ে যায়। আর এখন আম্পান সব শেষ করে দিয়ে গেল।

তিনি বলেন, জেলায় সাড়ে ১২ হাজার ছোটবড় আম বাগান রয়েছে। এই জেলায় ফসলি জমিতেও আমবাগান করা হয়। কিন্তু আম্পানে জেলার ৯০ ভাগ গাছ থেকে পড়ে মাটির সাথে লুটিয়ে পড়েছে।

মেহেরপুর সদরের আমবাগান মালিক ডাবলু হোসেন বলেন, শোলমারী গ্রামে প্রায় ১৫০ গাচ নিয়ে তার আমবাগান। গতবার ১২ লাখ টাকার আম বিক্রি হয়েছিল। স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেও এবার আরও বেশি টাকা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু একরাতের ঝড়ে বাগানের সব গাছের আম পড়ে শেষ।

ব্যাংক কিংবা সরকারিভাবে প্রণোদনা না দিলে তারা পুঁজি হারিয়ে পথে বসবেন বলে আশঙ্কা করছেন।

মেহেরপুর জেলা প্রশাসক আতাউল গনি বলেন, ল্যাংড়া, হিমসাগরখ্যাত মেহেরপুরে এবার আম্পানে আমের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। জেলা প্রশাসন ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয়ে মাঠে কাজ শুরু করেছে। পরিমাণ জানা গেলে বাগান মালিকদের ক্ষতি উত্তরণে সরকারি কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যায় কিনা সেটা ভেবে দেখা হবে।