ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাত সামাল দিতে এরই মধ্যে উপকূলীয় জেলাগুলোয় প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হয়েছে। লোকজনকে নেওয়া হচ্ছে আশ্রয়কেন্দ্রে।
তবে করোনাভাইরাসের সামাজিক দূরত্বের কথা মাথায় রেখে এবার আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর ব্যবস্থাপনায় আনা হয়েছে কিছুটা ভিন্নতা।
শক্তিশালী এই ঝড়ে সতর্ক করতে মঙ্গলবারই মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরকে সাত নম্বর বিপদ সংকেত এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্র বন্দরকে ছয় নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
এছাড়া সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম ও তাদের কাছাকাছি দ্বীপ ও চরগুলো ৭ নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় রাখা হয়েছে।
এরই মধ্যে জেলাগুলো থেকে প্রস্তুতি খবরাখবর পাঠিয়েছেন আমাদের প্রতিনিধিরা।
ঘূর্ণিঝড় আম্পান মোকাবেলায় বরগুনায় ৫০৯টি সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত রয়েছে।
জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন ও শিক্ষা বিভাগের নেতৃত্বে এসব আশ্রয়কেন্দ্রে জীবাণুনাশক স্প্রে করা হয়েছে।
বরগুনা জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ জানিয়েছেন, বরগুনায় ১৬৮টি সাইক্লোন শেল্টার রয়েছে। তার সাথে স্কুল কাম সাইক্লোন শেল্টার রয়েছে ৩৪১টি।
এছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভবন, ইউনিয়ন পরিষদ ভবন ও সরকারি অফিস আশ্রয়কেন্দ্রের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।
তিনি আরও জানিয়েছেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে মঙ্গলবার দুপুরের পর এসব আশ্রয়কেন্দ্রে লোকজন ওঠানো হবে।
“আশ্রয়কেন্দ্রে যারা অবস্থান করবেন, জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন ও ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে তাদের খাবারের ব্যবস্থা করা হবে।”
বরগুনা জেলা দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা লুৎফর রহমান জানিয়েছেন, দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য তাদের সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রে গ্রাম পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের দল সার্বক্ষণিক সামাজিক ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার কাজে নিয়োজিত থাকবে।
বিকাল থেকে স্থানীয় কমিউনিটি রেডিও লোকবেতারে আবহাওয়া বার্তা প্রচার ও ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির পক্ষ থেকে মাইকিং করা হচ্ছে।
পশ্চিম মধ্যবঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে ভোলায় সাত নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় ভোলা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ১১০৪ সাইক্লোন শেল্টার খোলার পাশাপাশি ৯২টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে।
সোমবার সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত উপকূলীয় এলাকায় সকর্তামূলক প্রচার চালাচ্ছে সিপিপি সদস্যরা।
ভোলার বিচ্ছিন্ন চর ও নদীর তীরবর্তী বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় আম্পান মোকাবেলায় সর্বোচ্চ প্রস্তুতির অংশ হিসাবে ভোলার ২১টি চরের তিন লাখ বাসিন্দাকে নিরাপদ আশ্রয়ে আনার কাজ শুরু করেছে জেলা প্রশাসন।
উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে নৌ বাহিনী, নৌ পুলিশ, জেলা পুলিশ ও কোস্টগার্ড এ সব মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে আসতে সহায়তা করবে।
একই সাথে সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় নেওয়া মানুষের সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার
জন্য অতিরিক্ত ৪০০টিসহ মোট ১১০৪টি আশ্রয় কেন্দ্র খুলে দেওয়া হয়েছে।
ভোলার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাসুদ আলম ছিদ্দিক জানান, ঘূর্ণিঝড়ে সবাইকে সতর্ক করার পাশাপাশি নিরাপদে আসতে সিপিপি ও রেডক্রিসেন্টের ১০ হাজার ২০০ সেচ্চাসেবী উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় মাইকিং শুরু করেছে।
এছাড়াও আশ্রয় কেন্দ্রে মানুষদের জন্য তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থা করা ছাড়াও নগদ টাকা, শুকনো খাবার ও শিশু খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড়ের আগে, সময় ও পরে এ তিন ধাপেই কাজ করার জন্য সব প্রস্তুতি নিয়েছে জেলা প্রশাসন।
অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় আম্পানের কারণে সোমবার বিকাল থেকে মোংলা বন্দরে অবস্থান নেওয়া জাহাজে পণ্য ওঠানামার কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আ
বহাওয়ার পূর্বাভাসে মোংলা সমুদ্র বন্দরে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলায় বন্দর কর্তৃপক্ষ বন্দরে অবস্থান নেওয়া জাহাজে সব কাজ বন্ধ করে দেয়।
এদিকে, ঘূর্ণিঝড় আম্পান ধেয়ে আসায় উপকূলীয় এলাকার মানুষদের ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে মাইকিং করছে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি।
সোমবার বিকালে রেড ক্রিসেন্টের সদস্যরা মাইকিং করে স্থানীয় মানুষদের সচেতন করে।
জেলার উপকূলীয় চার উপজেলার বাসিন্দাদের ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে রেডক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবকরা প্রস্তুতি নিয়েছে।
তবে এখনো এ এলাকার কোনো মানুষ ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে ওঠেনি বলে খবর পাওয়া গেছে।
“বন্দরে বর্তমানে সার, ফ্লাই অ্যাশ, কয়লাবাহীসহ মোট ১৪টি দেশি-বিদেশি জাহাজ অবস্থান করছে। মোংলা বন্দরের সব নৌযান নিরাপদে সরিয়ে রাখা হয়েছে।”
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) বেলায়েত হোসেন বলেন, সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের দুবলার চরের শুটকি পল্লীতে এখন কোনো জেলে বা শ্রমিক নেই।
“কয়েকদিন আগে সুন্দরবন বিভাগের অনুমতি নিয়ে নদীখালে মাছ শিকার করতে প্রায় তিন হাজার জেলে সুন্দরবনে প্রবেশ করে। তাদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।”
বনবিভাগের কর্মরত যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী সুন্দরবনের বিভিন্ন স্টেশন, ক্যাম্প ও ফাঁড়িতে অবস্থান করছেন তাদের নিরাপদে থাকতে বলা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
বাগেরহাট রেড ক্রিসেন্ট ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার নাজমুল কবির ঝিলাম বলেন, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পূর্বাভাস পেয়ে আমরা প্রস্তুতি গ্রহণ করেছি।
“জেলার চারটি উপকূলীয় উপজেলায় আমাদের সেচ্ছাসেবকরা প্রস্তুত রয়েছে। সেচ্ছাসেবকরা উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দাদের ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে ওঠার জন্য মাইকিং করছে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে সবাই যাতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে এ ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে আশ্রয় নেয় তার জন্য কাজ করছেন তারা।
“ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রেগুলোতে শুকনা খাবারের ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করে যাতে আমরা এই দুর্যোগ মোকাবেলা করতে পারি সেই লক্ষে রেডক্রিসেন্ট কাজ করবে।”
ঘূর্ণিঝড় আম্পান মোকাবেলায় উপকূলীয় জেলা ঝালকাঠিতে প্রস্তুতি নিয়েছে বলে জেলা প্রসাশন জানিয়েছে।
সোমবার বিকালে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির এক জরুরি সভায় জেলা প্রশাসক জোহর আলী একথা জানান।
সভায় জেলা প্রশাসক বলেন, জেলায় মোট ২৭৬টি আশ্রয় কেন্দ্রই প্রস্তুত রাখা রয়েছে। প্রয়োজনে কন্ট্রোল রুমসহ সব রকমের প্রস্তুতি নেওয়া হবে।
“এছাড়া পানি বৃদ্ধির শঙ্কায় শুকনো খাবার মজুদ করে রাখা হচ্ছে। এছাড়া ত্রাণ কার্যক্রম তো চলছেই।”
সাতক্ষীরায় নিরাপদ তথা সামাজিক দূরত্ব মেনে উপকুলবাসীকে সাইক্লোন শেল্টারে নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসন।
ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় সাতক্ষীরায় জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে এ সভায় সভাপতিত্ব করেন সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল।
তিনি বলেন, “অতিদ্রুত সব ধান কেটে ঘরে তুলতে হবে। নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য জেলাজুড়ে মাইকিং করা হবে।
উপকূলের বেড়িবাঁধের ঝুকিপূর্ণি ৩৭টি পয়েন্টে সার্বক্ষণিক তদারকি করার জন্য জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ১৪৭টি সাইক্লোন শেল্টার আছে বলে জানান তিনি।
সেখানে মঙ্গলবার বিকালের মধ্যে ঝুকিপূর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের আশ্রয় নেওয়ার জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া তিনি জানান, উপদ্রুত এলাকায় ১ হাজার ৭৯৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। সেগুলোকে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহার করা হবে।
“ইতোমধ্যে উদ্ধারকারী দল উপকূল এলাকায় পোঁছে গেছে। তারা এলাকার নারী শিশু ও বয়োবৃদ্ধদের এসব আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসার কাজ শুরু করেছে। সামাজিক দূরত্ব বাজায় রেখে উপদ্রুত এলাকার মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।”
ঘূর্ণিঝড় আম্পান মোকাবেলায় পুলিশ, র্যাব, কোস্টগার্ড, বিজিবি সহায়তা করছে। প্রয়োজনে অন্য বাহিনীর সদস্যদেরও সম্পৃক্ত করা হবে বলেও জানান তিনি।
“উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে আশ্রয় কেন্দ্রে চলে আসা মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।”
১৩ বছর আগে ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাতে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল লণ্ডভণ্ড হয়েছিল। এরপর অতি প্রবল এই ঘূর্ণিঝড় আম্পান আছড়ে পড়তে যাচ্ছে।