লাক্সারি ফ্যান কারখানার অনুমোদনই ছিল না

অগ্নিকাণ্ডে দশজন নিহত হওয়া গাজীপুরের ফ্যান কারখানাটির কোনো অনুমোদন ছিল না বলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।

আবুল হোসেন গাজীপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Dec 2019, 12:36 PM
Updated : 17 Dec 2019, 06:06 AM

সোমবার কারখানা পরিদর্শনে এসে এ তথ্য দেন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।

এছাড়া কারখানাটির কোনো ফায়ার লাইসেন্স এবং পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা ছিল না বলেও জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ।

নিহতদের লাশ শনাক্ত হওয়ার পর স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

এ ঘটনায় কারখানার নিহত এক শ্রমিকের বাবা বাদী হয়ে মামলা করেছেন।

গাজীপুর সদরের কেশরিতা গ্রামে রোববার সন্ধ্যায় রওজা হাইটেক-এর ‘লাক্সারি ফ্যান’ কারখানায় আগুনে ১০ জন নিহত ও দুইজন আহত হয়েছেন।

কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের যুগ্ম মহাপরিচালক ফরিদ আহমেদ বলেন, শ্রম মন্ত্রণালয় তথা কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের কোনো অনুমোদন ছাড়া কারখানাটি চলছিল। স্থানীয় একটি আবাসিক ভবন ভাড়া নিয়ে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণভাবে দোতলার উপরে টিনের শেড নির্মাণ করে ফ্যান তৈরির কারখানা গড়ে তোলা হয়।

“কারখানা স্থাপনে কোনো ধরনের নিয়ম মানা হয়নি, কারখানা স্থাপনের অনুমতি নিতে আবেদনও করেনি এই কারখানা কর্তৃপক্ষ।”

তিনি বলেন, অপরিকল্পিতভাবে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় কারখানাটি পরিচালিত হচ্ছিল। সম্ভবত শর্ট সার্কিট থেকে আগুন ধরলে কারখানার তৃতীয় তলায় দরজার কাছে দাহ্য পদার্থ থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। উপরে ৩য় তলায় আগুনের সূত্রপাত হলেও নিচে নামার জন্য সিঁড়ি ছিল একটি; বিকল্প কোনো সিঁড়ি ছিল না।

“তৃতীয় তলায় দরজার পাশে আগুনের সূত্রপাত হলে সেখানে থাকা ১৯ জনের মধ্যে নয়জন ঝুঁকি নিয়ে নিচে নামতে সক্ষম হলেও বিকল্প পথ না থাকায় ১০ জন শ্রমিক সেখানে আটকে পড়ে নিহত হন।”

ফরিদ আহমেদ জানান, এ ব্যাপারে কারখানা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে শ্রম আদালতে নিয়মানুয়ায়ী মামলা দায়ের করা হবে। এছাড়া আইন অনুযায়ী নিহত ও আহতদের কারখানার মালিকের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তবে এক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ে ভিক্টিমদের পরিবারের সদস্যদের আবেদন করতে হবে বলে তিনি জানান।

গাজীপুর ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক মো. মামুন অর রশিদ বলেন, “কারখানাটির কোনো ফায়ার লাইসেন্স ও অগ্নিনির্বাপনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ছিল না।”

লাক্সারি ফ্যান কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাহিদ হোসেন ঢালী সাংবাদিকদের বলেন, সরকারি বিধি মোতাবেক নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে এবং তারা যে উৎসব বোনাস ও বেতন পেতেন তাদের পোষ্যদের আজীবন তার সুবিধা দেওয়া হবে।

তবে ফায়ার লাইসেন্স এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের অনুমোদনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ফোন কেটে দেন।

লাশ হস্তান্তর 

শনাক্ত হওয়ার পর নিহত দশজনের লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে।

এরা হলেন গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মার্তা গ্রামের কামাল হোসেনের ছেলে রাশেদ (৩৪), নজরুল ইসলামের ছেলে শামীম (২২), সদরের কেশরিতা গ্রামের বীরবল চন্দ্র দাসের ছেলে উত্তম চন্দ্র দাস (১৮), একই উপজেলার কালনী গ্রামের সাইফুল ইসলামের ছেলে ফয়সাল খান (২০), গাজীপুর নগরীর  নোয়াগাঁও এলাকার লালমিয়ার ছেলে পারভেজ (১৯), ময়মনসিংহের কোতোয়ালি থানার রাঘবপুর গ্রামের সেলিমের ছেলে তরিকুল ইসলাম (১৯), রংপুরের হারাগাছের কাচু বকুলতলা গ্রামের তাজুল ইসলামের ছেলে ফরিদুল (২৩), নরসিংদীর বেলাবের চর কাশিনগর গ্রামের মাজু মিয়ার ছেলে সজল (২০), ব্রাক্ষণবাড়ীয়ার বাঞ্জারামপুরের মোরশেদ মিয়ার ছেলে ইউসুফ (৩০) এবং দিনাজপুরের কাহারোলের বারপাইটা গ্রামের আব্দুল হামিদের ছেলে লিমন (১৯)।

দুই আহত শ্রমিক কেশরিতা গ্রামের মোহাম্মদ আলীর ছেলে আনোয়ার হোসেন (২০) ও জামুনা এলাকার আব্দুল মোতালেববের ছেলে মো. হাসান (১৯) শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।

শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক প্রণয় ভূষণ দাশ জানান, লাশের ময়নাতদন্ত ও শনাক্ত করার পর হাসপাতালের মর্গ থেকে সোমবার দুপুরে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

“এর আগে ১০টি লাশের এবং উপস্থিত স্বজনদের  ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।”

এ সময় গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. শাহিনুর ইসলাম ও সিআিইডি ফরেনসিক বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আব্দুস সালামসহ  জেলা প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

লাশ হস্তান্তরের সময় পুরো হাসপাতাল এলাকায় নিহতের স্বজন ও সহকর্মীদের কান্নায় পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে।

গাজীপুর জেলা প্রশাসক এস এম তরিকুল ইসলাম বলেন, সোমবার লাশ হস্তান্তরের সময় জেলা প্রশাসন ঘোষিত ২৫ হাজার টাকা এবং মালিকের পক্ষ থেকে আরও ২০ হাজার টাকা প্রতিলাশের স্বজনদের দেওয়া হয়েছে। এছাড়া শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আরও ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে।

দুটি তদন্ত কমিটি

জেলা প্রশাসক সাংবাদিকদের জানান, ঘটনা তদন্তে গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. শাহিনুর ইসলামকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় দেওয়া হয়েছে সাত কার্যদিবস।

অপরদিকে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক মো. সাজ্জাদ হোসেন জানান, তাদের পক্ষ থেকে তিন সদস্যবিশষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সাত কার্যদিবসের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

জয়দেবপুর থানার ওসি জাবেদুল ইসলাম জানান, নিহত কারখানা শ্রমিক রাশেদুল ইসলামের বাবা কামাল হোসেন কারখানার পাঁচ মালিক ও ব্যবস্থাপক পদের দুইজনকে আসামি করে মামলা করেছেন। কামাল গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মার্তা গ্রামের বাসিন্দা।

গাজীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ রাসেল শেখ বলেন, মামলাটি নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে করতে হয়েছে। তাই নিহতদের দাফন পর্যন্ত মামলা করতে অপেক্ষায় থাকতে হয়।

মামলার পাঁচ আসামির মধ্যে কারখানার মালিক মুন্সিগঞ্জের জাহিদ হাসান ঢালী (৪২), গাজীপুর মহানগরের উত্তর ছায়াবীথির খোরশেদ আলম (৪৩), কাপাসিয়ার ডা. জহিরুল ইসলাম (৫৫) ও মুন্সিগঞ্জের শামিম ঢালীর (৩৬)। নাম জানা গেছে।

আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০৪ (ক) ধারায় অবহেলাজনিত মৃত্যু ঘটানোর অভিযোগ আনা হয়েছে।

রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৫টার দিকে আগুনের সূত্রপাত হলেও ফায়ার সার্ভিস সন্ধ্যা ৫টা ৫২ মিনিটে ওই কারখানার তিনতলা ভবনের তৃতীয় তলায় আগুন লাগার খবর পায়। পরে তাদের স্টেশনের চারটি ইউনিটের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে আগুন নিভে যায়।  

তৃতীয় তলায় একটি দরজার কাছে আগুনের সূত্রপাত হলে শ্রমিকরা আত্মরক্ষায় ভেতরের দিকে চলে যান। পরে মূহুর্তে আগুন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে তারা ভেতরে আটকা পড়েন। আগুন নিয়ন্ত্রণের পর তৃতীয় তলার কক্ষ থেকে ১০ শ্রমিককের লাশ উদ্ধার করা হয়। আহত দুই শ্রমিককে শহীদ তাজউদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।