অনেক এলাকায় ‘দীর্ঘ সময় আগে বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু হলেও শেষ হয়নি। সিডরে ক্ষতিগ্রস্তরা ঘুরে দাঁড়ালেও বাঁধগুলোর সংস্কার ও মেরামত যথাযথভাবে না হওয়ায় বরগুনা ও বাগেরহাট জেলার উপকূলীয় এলাকার মানুষ দিন কাটাচ্ছেন অনিশ্চয়তায়।
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাতে সহস্রাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় এসব এলাকার বেড়িবাঁধসহ অসংখ্য স্থাপনা।
সেদিন জলোচ্ছ্বাসে বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলায় সাউথখালী ইউনিয়নের বগী, গাবতলা ও সাউথখালী গ্রামে আটশতাধিক মানুষের প্রাণহানির কথা এখনও দাগ কেটে আছে মানুষের মনে।
উপকূলীয় শরণখোলা উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে ‘বলেশ্বর’ ও ‘ভোলা’ নদী । চারটি ইউনিয়নের এ উপজেলার জনসংখ্যা প্রায় এক লাখ ষাট হাজার। এ অঞ্চলের মানুষের আয়ের প্রধান উৎস সুন্দরবন, সাগর, নদী-খালের মাছ।
বলেশ্বর নদের বগী বন্দর এলাকার দোকানি মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, “সিডরের পর সরকার আমাদের জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা করতে বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়ায় আমরা খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু নির্মাণ কাজের মেয়াদ পেরিয়ে গেলেও কাজ এখনো শেষ হয়নি। আমরা আর ত্রাণ চাই না, আমরা চাই এই বাঁধটি যেন নদী শাসন করে টেকসই করা হয়।”
এ উপজেলার চর অঞ্চল উত্তর সোনাতলা, মধ্যে সোনাতলা, বগি বন্দর, সাউথখালী, গাবতলা ও সাতঘর গ্রামের মানুষের মুখেও একই কথা।
শরণখোলা উপজেলার স্থানীয় সাংবাদিক ইসমাইল হোসেন লিটন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সিডরের জলোচ্ছ্বাসে বাঁধ ভেঙে এ উপজেলায় পানি ঢুকে বহু মানুষের মৃত্যু হয়। তাই এখন কোনো দুর্যোগের খবর এলে শরণখোলাবাসীর দুশ্চিন্তার শেষ থাকে না।
“সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় বুলবুল নিয়েও শরণখোলাবাসী আতঙ্কে ছিল; আবহাওয়া দপ্তর যখন পূর্বাভাস দিল নদনদীতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে পাঁচ থেকে সাত ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হবে, তখন সবাই ভয়ে ছিল।”
বুলবুলের প্রভাবে নদ-নদীতে পানির চাপ আরও বাড়লে প্রাণহানি বাড়ার আশঙ্কা ছিল বলে মনে করেন লিটন।
সাউথখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হোসেন বলেন, সিডরের পর বলেশ্বর ও ভৈরব নদের ৬২ কিলোমিটার অংশে টেকসই মজবুত বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি ওঠে। পরে সরকার তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়।
২০১৬ সালের ২৩ জানুয়ারি এই বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়ে চলতি বছরের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। এখন পর্যন্ত যে অংশটুকুর কাজ শেষ হয়েছে তাতে চল্লিশ শতাংশের বেশি নয় বলে জানান তিনি।
উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্পের (সিইআইপি) নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম বলেন, শরণখোলা উপজেলার ৩৫/১ পোল্ডারের ৬২ কিলোমিটার অংশের বেড়িবাঁধ বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে নির্মাণ করা হচ্ছে।
৬৯৬ কোটি টাকার এ প্রকল্পের কাজ ২০২০ সালের জুন মাসে শেষ করা যাবে জানিয়ে তিনি বলেন, “এটি নির্মাণ হলে স্থানীয় বাসিন্দারা ঝড় জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে রক্ষা পাবে।”
সেদিন সন্ধ্যায় মহাবিপদ সংকেত জারির পর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি আর দমকা হাওয়ার মধ্যে অনেকে আশ্রয় কেন্দ্রে চলে গেলেও কেউ কেউ তাতে গুরুত্ব না দিয়ে থেকে গিয়েছিলেন বাড়িতে।
কিন্তু সিডর উপকূলে আঘাত হানার পর বাতাসের তোড়ে উড়ে যায় অসংখ্য কাঁচা ঘর। রাত সাড়ে ১০টার দিকে জলোচ্ছ্বাস ভাসিয়ে নেয় উপকূলের জনপদ।
যারা সেদিন বেঁচে গিয়েছেন, সকালে উঠে দেখেছেন চারদিকে ধ্বংসলীলা। এত বেশি লাশ পাওয়া যাচ্ছিল যে এক কবরে অনেককে কবর দিতে হচ্ছিল।
সেই কবরগুলো এখনও একটু উঁচু করে রাখা হয়েছে। বরগুনা প্রেসক্লাবের সহযোগিতায় স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা সংগ্রাম সম্প্রতি ইট দিয়ে কবরস্থানটি ঘিরে দিয়েছে। সারিবদ্ধ কবর দেখে মানুষ এসে থমকে দাঁড়ায়। অনেকের চোখ হয়ে ওঠে অশ্রুসজল।
জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সিডরের সময় ৩০ হাজার ৪৯৯টি গবাদী পশু ও ছয় লাখ ৫৮ হাজার ২৫৯ টি হাঁস-মুরগী মারা যায়। কমবেশি ক্ষতির শিকার হয় জেলার ২ লাখ ১৩ হাজার ৪৬১ পরিবার। ৭৭ হাজার ৭৫৪টি পরিবার সম্পূর্ণ গৃহহীন হয়ে পড়ে।
বরগুনা সদর উপজেলার নলটোনা ইউনিয়ন পরিষদ সিডরে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল জানিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান হুমায়ূন করীব বলেন, জোয়ার বাড়লে এলাকা তলিয়ে যায়, ফসলের ব্যাপক-ক্ষয়ক্ষতি হয়।
জেলার ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ কেন মেরামত হচ্ছে না জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক বলেন, “মন্ত্রণালয় থেকে পর্যাপ্ত বরাদ্দ না পাওয়ায় বাঁধগুলো সংস্কার করা যায়নি। এখন পর্যন্ত যা বরাদ্দ পাওয়া গেছে তা দিয়ে পুণঃনির্মাণ সম্ভব না।”