রাজধানীর কাছের শহরে ফতুল্লার ওই বাড়িতে সোমবার অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক উদ্ধার করে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট।
পুলিশের উপর সাম্প্রতিক বোমা হামলায় ব্যবহৃত বিস্ফোরকের সঙ্গে এই বাড়িতে পাওয়া বিস্ফোরকের মিল পাওয়ার কথাও জানিয়েছেন কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম।
২০১৬ সালে গুলশান হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধারাবাহিক অভিযানে বিভিন্ন জেলায় অনেক জঙ্গি আস্তানার সন্ধান মেলে এবং নিহতও হন শীর্ষ জঙ্গিনেতারা। তখন পুলিশ কর্মকর্তারা বলছিলেন, জঙ্গিদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি ঢাকায় পুলিশকে লক্ষ্য করে কয়েকটি বোমাহামলা হয় এবং হামলার পর জঙ্গি সংগঠনের নামে দায় স্বীকারের বার্তার খবরও আসে।
এই হামলাগুলোর সঙ্গে জঙ্গি যোগসাজশের কথা বললেও কারা তারা সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু জানা যাচ্ছিল না।
এর মধ্যেই রোববার মধ্যরাতে ফতুল্লার সেয়াচর এলাকায় তক্কার মাঠ সংলগ্ন টিনশেড একটি বাড়ি ঘিরে ফেলে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট ও নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ; ভোরে শুরু হয় অভিযান।
বেলা ১২টার দিকে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের বোমা নিষ্ক্রিয়কারী ইউনিট ওই বাড়িতে কয়েকটি ইমপ্রোভাইসড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইসের (আইইডি) বিস্ফোরণ ঘটায়। তারপর বেলা আড়াইটার দিকে অভিযান শেষে সাংবাদিকদের সামনে আসেন মনিরুল।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এটি একটি নতুন সেল।”
নব্য জেএমবিকে ‘বিধ্বস্ত’ করা গেলেও জঙ্গি মতাদর্শের ব্যক্তিদের থাকার বিষয়টি তুলে ধরে মনিরুল বলেন, “যেহেতু আইডিয়োলজিস্ট একজিস্ট করছে এখানে, নতুন সেল হিসেবে এটি গড়ে উঠেছিল বলে আমরা মনে করছি।”
কবে থেকে এখানে তারা সক্রিয়- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমাদের ধারণা, গত ৬/৭ মাস আগে থেকে তারা এই প্রস্তুতিটা গ্রহণ করেছিল।”
আরেক প্রশ্নের জবাবে মনিরুল বলেন, “এখানে যাদেরকে ইতোমধ্যে আটক করা হয়েছে, তারা কেউ কেউ শুধু সাংগঠনিক কার্যক্রমই নয়, প্ল্যানিং থেকে শুরু করে এক্সিকিউশন পর্যন্ত সব কিছুর সাথে একেবারে সরাসরি জড়িত ছিল।”
মিজানুর রহমান নামে নব্য জেএমবির এক সদস্যকে রোববার রাতে ঢাকায় গ্রেপ্তারের পর তা কাছ থেকে ফতুল্লার বাড়িটির বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায় বলে জানান মনিরুল।
এরপর ভোরে বাড়ির মালিকের বড় ছেলে ফরিদউদ্দিন রুমি ও তার স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। রুমি ঢাকার আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ও প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষক। তার স্ত্রী জান্নাতুল ফোয়ারা অনু অগ্রণী ব্যাংকের কর্মকর্তা।
বাড়িটির মালিক জয়নাল আবেদীন বাংলাদেশ ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত একজন ডিজিএম।
এলাকাবাসী ও পুলিশ জানায়, তক্কার মাঠ সংলগ্ন সেহাচর ও শিয়াচর এলাকায় জয়নাল আবেদীনের দুটি বাড়ি। শিয়াচরের দোতলা বাড়িতে জয়নাল আবেদীন সপরিবারে থাকেন। সেহাচরের টিনশেড বাড়িতে আগে ভাড়াটিয়া ছিল। গত ডিসেম্বরে ভাড়াটিয়া তুলে দিয়ে বাড়িটি ছেলেরা ব্যবহার করছেন।
কাউন্টার টেররিজম ইউনিট কর্মকর্তারা জানান, ভোরে শিয়াচরের বাড়ি থেকে রুমি ও তার স্ত্রীকে আটক করা হয়। এরপর সেহাচরের টিনশেড বাড়িটি ঘিরে চলে অভিযান।
সকাল ১০টার মধ্যেই বাড়িটির আশেপাশের ১৭ থেকে ২০টি ঘর খালি করে ফেলা হয়। আশপাশের বাড়ি থেকে মানুষজনকে সরিয়ে নেওয়া হয়। বিভিন্ন ভবনের ছাদেও পুলিশ অবস্থান নেয়।
বেলা ১১টার দিকে বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল ঘটনাস্থলে যায়। একটি রোবটও ছিল তাদের সঙ্গে। প্রথমে রোবট পাঠিয়ে দূর নিয়ন্ত্রত ক্যামেরার মাধ্যমে ভেতরের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হয়। পরে বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দলের সদস্যরা ভেতরে ঢোকেন। এরপর চারটি বিস্ফোরণের বিকট শব্দ হয়।
অভিযান শেষে সেখানে ফায়ার সার্ভিসের দল আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। পরবর্তীতে সেখানে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন ও সিআইটির ফরেনসিক ইউনিট কাজ শুরু করে। অভিযানের আগে আশপাশের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছিল।
বাড়ির মালিক জয়নাল আবেদীনের কোনো সম্পৃক্ততা রয়েছে কি না- জানতে চাইলে মনিরুল বলেন, “তার এক ছেলে ও পুত্রবধূকে আটক করা হয়েছে। এখনই আমরা বলতে পারব না, তার সম্পৃক্ততা ছিল কি না। এটি নিশ্চিত করতে আমাদের আরও কিছুটা সময় লাগবে।”
ঢাকায় গ্রেপ্তার মিজানুর রহমানের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জে গ্রেপ্তার রুমির সাংগঠনিক সর্ম্পক রয়েছে বলে নিশ্চিত মনিরুল।
বাড়িতে বিস্ফোরকের মজুদ
অভিযান শেষে মনিরুল বলেন, “এখানে তিনটি রেডি আইইডি, যেগুলো ব্যবহারের উপযোগী ছিল এবং বেশ কিছু বিস্ফোরক দ্রব্য, কেমিকেল পাওয়া গেছে। এগুলো ধ্বংস করা হয়েছে।”
তিনি বলেন, “এখানে যে বিস্ফোরকের উপাদান পাওয়া গেছে, তাতে ১৫ থেকে ২০টি বিস্ফোরক বানানো যেত। তিনটি প্রস্তুত ছিল। আর আগে যে ৫টি ঘটনায় ব্যবহার হয়েছে, তার চেয়ে এগুলো আকারে বড় ও শক্তিশালী।
“একটি রেফ্রিজারেটরভর্তি বিভিন্ন ধরনের সেনসেটিভ কেমিকেল ছিল। উদ্ধারকৃত আলামতের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ডিভাইস রয়েছে। তারা হয়ত সুইসাইড ভেস্ট তৈরিরচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল।”
দুটি খেলনা পিস্তল পাওয়ার কথা জানিয়ে মনিরুল বলেন, “শুটিংয়ের জন্য সাধারণত এগুলো ব্যবহার হয়। এটি চেম্বারযুক্ত, কিন্তু ভেতরে কোনো এক্সপ্লোসিভ নাই।”
পুলিশের উপর নিক্ষিপ্ত বোমার সঙ্গে মিল
ঢাকায় গত এপ্রিল থেকে পুলিশের উপর যে কয়টি হামলার ঘটনা সংগঠিত হয়েছে, তাতে ব্যবহৃত বিস্ফোরকের সঙ্গে ফতুল্লার বাড়িতে পাওয়া বিস্ফোরকের মিল পাওয়ার কথা জানান মনিরুল।
তিনি বলেন, “ঢাকা শহরে গত এপ্রিল থেকে যে কয়টা ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, সেখানে প্রাপ্ত আলামতের সাথে সেই আলামতের হুবহু মিল রয়েছে।
“যারা ধরা পড়েছে, তাদের কেউ কেউ এই সমস্ত ঘটনার একেবারে সরাসরি জড়িত প্লানিং, এক্সিকিউশন থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে জড়িত থাকতে পারে। তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রেখেছি।”
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মনিরুল বলেন, পুলিশের উপর সাম্প্রতিক পাঁচটি হামলার ঘটনা পরিকল্পিত। এর উদ্দেশ্য পুলিশকে হত্যা, পুলিশের মনোবল ভেঙে দেওয়া, পাশাপাশি আতঙ্ক সৃষ্টি করা।
“পাশাপাশি এক ধরনের প্রতিশোধপরায়নতা। তারা মনে করে, পুলিশ যেহেতু তাদের জঙ্গি সংগঠনের বিস্তাররোধে সক্রিয় ভুমিকা পালন করেছিল, তাই তারা পুলিশকে শত্রু মনে করে, মুরতাদ মনে করে। এই কারণে পুলিশকে টার্গেট।”