উত্তরের রেলপথ: অন্তত ২শ সেতু মেয়াদোত্তীর্ণ

রেলওয়ের লালমনিরহাট বিভাগের অধীন উত্তরাঞ্চলের নয় জেলায় বৃটিশ শাসনামলে নির্মিত চার শতাধিক রেলসেতুর অর্ধেকই মেয়াদোত্তীর্ণ বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।

জিয়া শাহীন বগুড়া প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 June 2019, 12:47 PM
Updated : 27 June 2019, 12:47 PM

চুন-সুরকির সাহায্যে ইটের গাঁথুনিতে নির্মিত সেতুগুলোর মেয়াদকাল ছিল সর্বোচ্চ ৬০ বছর। সেখানে এগুলোর বয়স হয়েছে অন্তত ১২০ বছর।

রেলওয়ের কর্মকর্তারাই বলছেন, অনেক সেতুর গার্ডার দুর্বল হয়ে পড়েছে; কিন্তু তারপরও সেগুলো মেরামত করা হচ্ছে না। যখন পিলারের নিচ থেকে মাটি সরে যাওয়ার ঘটনা জনগণের চোখে পড়ছে কেবল তখনই সেতুগুলো মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

ট্রেনের চালকরা বলছেন, ব্রিজের অবস্থা যেমনই হোক না কেন ট্রেনের নির্ধারিত গতি কমানোর কোনো সুযোগ তাদের হাতে নেই। কর্তৃপক্ষের নির্ধারণ করে দেওয়া গতিতেই তাদের ট্রেন চালিয়ে নিতে হয়।

গত ২৩ জুন রাতে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় একটি সেতু থেকে ট্রেন পড়ে গিয়ে চারজন নিহত ও অন্তত একশ জন আহত হন।

তার দুদিনের মাথায় একনেক সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রেলের ইঞ্জিন পুনর্বাসন সংক্রান্ত একটি প্রকল্পের অনুমোদন দিতে গিয়ে সারাদেশে নড়বড়ে সব রেল সেতু চিহ্নিত করে দ্রুত সময়ের মধ্যে মেরামতের নির্দেশ দেন।

বগুড়াসহ এ অঞ্চলের ট্রেনগুলোর নিয়মিত যাত্রীরা বলছেন, একশ বছরের বেশি আগে বৃটিশ শাসনামলে নির্মিত ব্রিজগুলোর বেশিরভাগই যে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে; তা বাইরে থেকে খোলা চোখে দেখলেই অনুমান করা যায়। ট্রেনগুলো বিশেষত দ্রুতগামী আন্তঃনগর ট্রেন যখন ছুটে চলে তখন ব্রিজগুলো যেন কাঁপতে থাকে। যেকোনো সময় মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। কিন্তু নির্ধারিত সময় আর নির্দিষ্ট কিছু গন্তব্যে যাতায়াতের জন্য ট্রেনের বিকল্প কোনো যানবাহন না থাকায় বাধ্য হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই তাদের চলাচল করতে হচ্ছে।

রেলওয়ের হিসাব অনুযায়ী, উত্তরাঞ্চলে ১৮৯২ সালে রেললাইন স্থাপন শুরু হয়। পশ্চিমাঞ্চলের অধীন লালমনিরহাট বিভাগের আওতায় বগুড়ার সান্তাহার থেকে গাইবান্ধা, রংপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, লালমনিরহাট, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় পর্যন্ত নয় জেলায় ৫০০ দশমিক ৬১ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। দীর্ঘ এই রেলপথে আগে আন্তঃনগর, মেইল ও লোকাল মিলে ৩২ জোড়া বা ৬৪টি ট্রেন চলাচল করতো। তবে ইঞ্জিন ও কোচ সংকটের কারণে নয় জোড়া বা ১৮টি ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে যে ২৩ জোড়া বা ৪৬টি ট্রেন চলাচল করছে তার মধ্যে ৭ জোড়া বা ১৪টি আন্তঃনগর। বাকি ১৬ জোড়া বা ৩২টি ট্রেনের মধ্যে ১১ জোড়া মেইল এবং অন্য ৫ জোড়া বা ১০টি লোকাল। এসব ট্রেনে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ যাতায়াত করছেন।

রেলওয়ে প্রকৌশল শাখার দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, লালমনিরহাট বিভাগে রেলের ছোট-বড় মিলিয়ে ৪১১টি সেতু রয়েছে। চুনের সঙ্গে সুরকি মিশিয়ে ইট গেঁথে তার উপর লোহার গার্ডার যুক্ত করে সেতুগুলো নির্মাণ করা হয়। তবে সাম্প্রতিককালের সেতুগুলো আরসিসি ঢালাই দিয়েই নির্মাণ করা হচ্ছে।

রেলওয়ের বগুড়ার সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী আবু মাসুদ বলেন, ইটের গাঁথুনি দিয়ে নির্মিত সেতুগুলোর মেয়াদ গড়ে ৬০ বছর। আর আরসিসির ব্রিজগুলোর মেয়াদ ১০০ বছর।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, শত বছরের প্রাচীন সেতুগুলো ট্রেন চলাচলের জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মাঝেমধ্যে সেতুগুলোর পিলার দেবে যাচ্ছে; নয়তো গার্ডার দুর্বল হয়ে ট্রেন চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে।

সর্বশেষ গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর সকালে বগুড়ার সুখানপুকুর ও ভেলুরপাড়া রেল স্টেশনের মাঝে চকচকিয়া সেতুর একটি পিলার দেবে যায়। সেতুটি মেরামতে ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে যায়। ওই সময় পর্যন্ত ট্রেন চলাচলও বন্ধ রাখতে হয়।

একইভাবে এর আগে গাইবান্ধার মহিমাগঞ্জে বাঙালি নদীর উপর এবং কুড়িগ্রামে অপর একটি রেলসেতু মেরামত ও সংস্কার করতে হয়েছে।

এছাড়া গাইবান্ধার ভেড়ামারা এলাকায় অপর একটি সেতু মেরামত জরুরি হয়ে পড়েছে।

কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বগুড়া রেলওয়ে স্টেশনের পূর্ব দিকে করতোয়া নদীর উপর শত বছর আগে নির্মিত রেল সেতুর গার্ডারও দুর্বল হয়ে পড়েছে।

রেলওয়ের বগুড়ার সহকারী প্রকৌশলী আবু মাসুদ বলেন, বগুড়ায় করতোয়া নদীর উপর নির্মিত ব্রিজের গার্ডারগুলো শক্তিশালী করা প্রয়োজন। এরই মধ্যে কর্মকর্তারা ব্রিজটি পরিদর্শনও করেছেন।

বোনারপাড়া-সান্তাহার রুটে যাতায়াতকারী কাওসার আহম্মেদ বলেন, বগুড়া স্টেশনের কাছাকাছি করতোয়া নদীর উপর নির্মিত সেতুর উপর যখন ট্রেন ওঠে তখন পুরো সেতুটি কাঁপতে থাকে। প্রচণ্ড ভয়ও লাগে তখন।

তিনি বলেন, “সড়কপথে যানবাহন থাকলেও সময় যেমন বেশি লাগে তেমনি ভাড়াও কয়েকগুণ বেশি গুণতে হয়। যে কারণে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ট্রেনে চলাচল করি। মৌলভীবাজারে ট্রেন দুর্ঘটনার পর যাত্রীরা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে।”

বগুড়ার সান্তাহার থেকে দিনাজপুরগামী আন্তঃনগর দোলনচাঁপা এক্সপ্রেসের চালক আশরাফুল আলম বলেন, দ্রুত গতিতে ট্রেন চললে ব্রিজের উপর চাপও বেশি পড়ে। ব্রিজের অবস্থা যাই হোক না কেন তাদের ট্রেনের গতি কমানোর কোনো সুযোগ নেই।

বুধবার দুপুরে বগুড়া রেল স্টেশনে দোলনচাঁপা এক্সপ্রেসের যাত্রাবিরতিকালে তিনি বলেন, “এই দোলনচাঁপা এক্সপ্রেস ট্রেনটি ঘণ্টায় ৬৫ কিলোমিটার গতিতে চালানোর নির্দেশ রয়েছে। আমাদেরকে যে গতিসীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে তার কম বা বেশি করার কোনো সুযোগ নেই।”

ঝুঁকিপূর্ণ সেতুর উপর দিয়ে ট্রেন চালাতে ভয় করে কিনা প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “ভয় করলে তো আর ট্রেন চালানো যাবে না।”

রেলওয়ের লালমনিরহাট বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন বলেন, “আমার বিভাগের অধীন ৪১১টি ব্রিজের অর্ধেকেরই মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। তবে তাতে ভয়ের কিছু নেই। কিছু কিছু ব্রিজ সংস্কার, মেরামত আবার কোথাও কোথাও নতুন ব্রিজও নিমাণ করা হচ্ছে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া।”

এরই মধ্যে তিনটি ব্রিজের সংস্কার ও মেরামত শেষ হয়েছে। খুব শিগগিরই গাইবান্ধার ভেড়ামারায় ঝুঁকিপূর্ণ একটি ব্রিজ মেরামত শুরু করা হবে বলে তিনি জানান।