বৈদ্যনাথতলা গ্রামের যে আমবাগানে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথগ্রহণ করেছিল, সেই ঐতিহাসিক আমবাগানের অনেক গাছ পরিচর্চার অভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। ভাস্কর্য্গুলোতে ধরেছে ফাটল; ভেঙ্গে গেছে অনেকগুলো; বিকৃত হয়ে গেছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ম্যুরাল।
স্বাধীনতার সুতিকাগার এ মুজিবনগরে সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ কেন নেই জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক পরিমল সিংহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নতুন করে সবকিছু করা হবে। তাই বর্তমান নির্মাণগুলোতে নজর কম।
“তাছাড়া সরকারের একাধিক মন্ত্রণালয় মুজিবনগরের দেখভাল করে বিধায় সম্বন্বয়হীনতা বড় একটা কারণ।”
মেহেরপুর-১ আসনের সাংসদ ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফরহাদ হোসেন দোদুল বলেন, “সাদা সিমেন্টে তৈরি সব ম্যুরাল ও ভাস্কর্য ভেঙ্গে ব্রঞ্চ দিয়ে আরও বড় আকারে তৈরি করা হবে। এ জন্য ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।”
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণ করে, যার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও সরকার পরিচালনা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। এই অস্থায়ী সরকারের সফল নেতৃত্বে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ।
সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে তার অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি করা হয়। ওই দিনকেই মুজিবনগর দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
শত্রুপক্ষের চোখ ফাঁকি দিয়ে সেদিন বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে আয়োজন করা হয় দেশের প্রথম সরকারের শপথ, গার্ড অব অনার, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ এবং মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক নিযুক্তকরণের আনুষ্ঠানিকতার।
সূর্য ওঠার পরই কলকাতা থেকে জাতীয় নেতারা গাড়ি নিয়ে আম্রকুঞ্জের নিচে সমবেত হন।স্থানীয়দের বানানো মঞ্চে ওঠেন দেশের প্রথম সরকারের মন্ত্রী পরিষদ। সংবাদ সংগ্রহের জন্য সেদিন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কর্মীরাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের পর ওই মঞ্চেই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন অধ্যাপক মো.ইউসুফ আলী। ঐতিহাসিক এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সেই সময়ের বৈদ্যনাথতলাকে মুজিবনগর ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশের প্রথম রাজধানীর স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
সেদিন অস্থায়ী সরকারের প্রথম গার্ড অব অনার প্রদানকারী ১২ আনসার সদস্যের মধ্যে চারজন বেঁচে থাকলেও ভাল নেই তারা। প্রথম সরকার গঠনের ৪৪ বছর পার হলেও আজও তাদের দেওয়া হয়নি যথাযথ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। যে খাস জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল তাদের নামে, তার ভোগ দখল পাননি আজও।
এমনকি গার্ড অব অনার প্রদানের যে ভাস্কর্য তৈরি হয়েছে তাতেও ১২ জনের জায়গায় আটজনের প্রতিকৃতি থাকায় তাতে আক্ষেপ জানিয়ে সবার প্রতিকৃতি স্থাপনের দাবি জানিয়েছেন তারা। পাশাপশি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, বিশেষ মুক্তিযোদ্ধার সম্মান ও বিশেষ ভাতাও চান তারা।
আনসার সদস্য লিয়াকত আলী বলেন, “সেদিন তৎকালীন মেহেরপুর মহকুমা প্রশাসকের ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। তখন এতকিছু পাব এই ভেবে মুক্তিযুদ্ধ করিনি। পরিবারের কি হবে সে চিন্তাও করিনি। দেশ স্বাধীনের অনেক পরে আমাদের মূল্যায়ন শুরু হয়।
“এখন কষ্ট একটাই। মুজিবনগরে প্রথম সরকারকে গার্ড অব অনার প্রদানের যে ভাস্কর্য তৈরি হয়েছে, সেখানে ১২ আনসারের বদলে আট আনসারকে দেখানো হয়েছে। এটা ইতিহাস বিকৃতির শামিল।”
আরেক আনসার সদস্য আজিমুদ্দিন শেখ বলেন, “সেদিন এই মুজিবনগরের জন্ম না হলে দেশ স্বাধীন হতো কিনা জানিনা। কিন্তু মুজিবনগর এখনও অবহেলিত। জন্মের প্রতি শ্রদ্ধা না দেখালে দেশ এগোবে কি করে?
“এখন বৃদ্ধ বয়সে শরীরে নানা রোগ বেঁধেছে। যে ভাতা পাই তাতে চিকিৎসা খরচ হয় না।”
সিরাজুল ইসলাম বলেন, “সরকার ১২ আনসারকে জমি দিয়েছে। কিন্তু ছয়জন জমির দখল পেয়েছে। বাকিরা জমির দখল আজও পায়নি। জীবিত অবস্থায় এই কাজটুকু দেখে যেতে পারলে ভাল লাগতো।”
হামিদুল হক বলেন,“মৃত্যুর আগে আমাদের যদি একটি রাষ্ট্রীয় খেতাবে ভূষিত করা হতো, তাহলে সন্তানরা হয়ত গর্ব করে পরিচয় দিতে পারতো।”