একুশে অগাস্ট: ভালো নেই মাদারীপুরের হতাহতদের পরিবার

আলোচিত একুশে অগাস্টে গ্রেনেড হামলার ১৩ বছর পরও শরীরে স্প্লিন্টার বয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন মাদারীপুরের চারজন; ভালো নেই আওয়ামী লীগের ওই সমাবেশে গিয়ে প্রাণ হারানো এই জেলার আরও চারজনের পরিবার।

রিপনচন্দ্র মল্লিক মাদারীপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 August 2017, 08:39 AM
Updated : 21 August 2017, 02:12 PM

এর মধ্যে এত বছরেও বিচার না পাওয়ায় হতাশ এসব পরিবারের সদস্যরা।

২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের সমাবেশে আওয়ামী লীগ সভাপতি তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে ছোড়া গ্রেনেডে প্রাণ হারিয়েছিলেন ২৪ জন, যার চারজনই মাদারীপুরের।

উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে সেই নিহতদের পরিবার দীর্ঘদিন ধরে জীবনযাপন করছে দৈন্যদশায়; অন্যদিকে আহতদের বেশিরভাগ কর্মক্ষমতা হারিয়ে হয়ে পড়েছেন পরিবারের বোঝা।

হামলায় আহত চারজন এখনো শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন বোমার স্প্লিন্টার। দীর্ঘদিন এসব স্প্লিন্টার শরীরের বিভিন্ন স্থানে থাকায় চিকিৎসার অভাবে শরীরের একেকটি অংশ হয়ে পড়ছে অকেজো। সুচিকিৎসার অভাবে ধীরে ধীরে পঙ্গুত্ব বরণ করছেন তারা।

বিচারের দীর্ঘসূত্রতার পাশাপাশি বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও আহতদের চিকিৎসাসহ পুনর্বাসন ও নিহতদের পরিবারগুলোর জন্য সাহায্য-সহযোগিতার তেমন কোনো উদ্যোগ না দেখে তাদের মধ্যে বাড়ছে হতাশা ও ক্ষোভ।

আওয়ামী লীগের সমাবেশে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি মেয়ের প্রথম জন্মবার্ষিকীর পোশাক আর মায়ের পেটের পাথর অপারেশনের ব্যবস্থা করে বাড়ি ফেরার কথা বলে ঢাকায় গিয়েছিলেন রাজৈর উপজেলার হোসেনপুর ইউনিয়নের চানপট্টি গ্রামের যুবলীগ নেতা লিটন মুন্সি।

ছেলেকে হারানোর ১৩ বছর পরের দিনটিতে চানপট্টি গ্রামের বাড়িতে লিটনের মা আছিয়া খাতুন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “আমার বাবা বলেছিল, মা তোমার পেটের পাথর অপারেশনের ব্যবস্থা করে আসব, মাত্র ১০ দিন অপেক্ষা কর। নয়দিনের মাথায় বাবা লাশ হয়ে ফিরেছে।”

লিটনের স্ত্রী মাফিয়া আক্তার বলেন, আগামী ১ সেপ্টেম্বর তাদের মেয়ে মিথিলার বয়স ১৪ বছর পূর্ণ হবে। ২০০৪ সালে প্রথম জন্মদিন উপলক্ষে জামা-কাপড় নিয়ে মাদারীপুরে তার ফেরার কথা ছিল। জন্মদিনের পোশাক আর তার আনা হয়নি।

লিটনের বাবা আইয়ুব আলী মুন্সি বলেন, “আমার ছেলের তো কোনো দোষ ছিল না। আমার একমাত্র ছেলেকে কবরে শুইয়ে রেখে কিভাবে বেঁচে আছি বলতে পারেন?”

শুধু লিটন মুন্সি নয়, ওইদিন মাদারীপুরের আরও তিনজন নিহত হন।

এদের মধ্যে শ্রমিক লীগ নেতা নাসির উদ্দিনের বাড়ি মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার কয়ারিয়া ইউনিয়নের রামপোল গ্রামে।

তবে দীর্ঘদিন আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকা নাছির থাকতেন ঢাকার হাজারিবাগে। এক সময়ে হাজারীবাগের শ্রমিক লীগের সভাপতিও নির্বাচিত হয়েছিলেন। ঢাকায় কখনও রিকশা চালাতেন, কখনও অন্য একজনের দোকানে কাজ করতেন।

নাসির ছিলেন আওয়ামী লীগের অন্ধভক্ত। তাই আওয়ামী লীগের মিছিল, মিটিং কিংবা সমাবেশ হলে তাকে কেউ বেধেঁ রাখতে পারত না। মিটিং-মিছিলের আগে থাকতেন, স্লোগান দিতেন।

রাজনীতির জন্য জীবন উৎসর্গ করা সেই নাসিরউদ্দিনের বৃদ্ধ মা-বাবা আর স্ত্রী-সন্তানদের খবর কেউ রাখেনা।

গ্রেনেড হামলায় নিহত আরেক যুবলীগ নেতা মোস্তাক আহম্মেদ ওরফে সেন্টু। তার বাড়ি কালকিনি উপজেলার ক্রোকিরচর গ্রামে।

সেন্টুর স্ত্রী আইরিন পারভীন বলেন, “ওকে হারিয়ে আমরা পথে বসে গেছি। খেয়ে না খেয়ে কোনো রকমভাবে বেঁচে আছি।”

মাদারীপুরের নিহতদের মধ্য চতুর্থজন সুফিয়া বেগম, বাড়ি রাজৈর উপজেলার কদমবাড়ি ইউনিয়নের মহিষমারি গ্রামে। ওইদিন মহিলা নেত্রীদের সঙ্গে প্রথম সারিতেই ছিলেন সুফিয়া। উদ্যমী সুফিয়া সপরিবারে ঢাকায় থাকতেন।

ওইদিনের গ্রেনেড হামলায় একটি পা নষ্ট হয়েছে কালকিনি পৌরসভার বিভাগদী গ্রামের মোহাম্মাদ আলী হাওলাদারের ছেলে হালান হাওলাদারের।আজীবন পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে তাকে।

বর্তমানে ঢাকায় থাকা হালান ফেরি করে রাস্তায় রাস্তায় মুরগি বিক্রি করেন। স্ত্রী ও পাঁচ বছর বয়সী ছেলের খরচ ঠিকমত দিতে না পারায় তারা বেশিরভাগ সময় স্ত্রীর বাবার বাড়িতেই থাকে। মা মনোয়ারা বেগম মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে হালান হাওলাদার বলেন, “অনেক শখ করে সেদিন আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য শুনতে যাই। পড়ে সেখানে বোমা হামলায় আহত হই।

“এখনও দুই হাত-পাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ১০০ এর বেশি স্প্লিন্টার নিয়ে যন্ত্রণায় বেঁচে আছি। এভাবে জীবন নিয়ে বেঁচে থাকা অসম্ভব। এর চেয়ে মৃত্যুই ভালো ছিল।”

কালকিনির ঝাউতলা গ্রামের ওয়াহেদ সরদারের ছেলে সাইদুল হক সরদার শরীরে স্প্লিন্টার নিয়ে যন্ত্রণাময় জীবনযাপন করছে।

বাঁচার তাগিদে কোনো কাজ-কর্মে ভালো কিছু করতে না পেরে জমি বিক্রি করে চার বছর আগে মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলেন। সেখানেও শরীরে স্প্লিন্টারের যন্ত্রণা নিয়ে কিছু করতে পারেনি, ফিরে আসতে হয়েছে দেশে।

সাইদুল বলেন, “একটি চাকরির জন্য অনেক জায়গায় ঘুরেছি, বিভিন্ন নেতাকর্মীর কাছে গিয়েছি। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। কেউ সাহায্য করেনি।”

গ্রেনেড হামলায় ডান হাত বাঁকা হয়ে গেছে কালকিনির কৃষ্ণনগর গ্রামের কবির হোসেনের। ঢাকার এক বস্তিতে থেকে এখন দিনমজুরের কাজ করেন তিনি।

আর সেদিন চোখ হারিয়ে এখন স্ত্রীর আয়ের উপর চলছেন মাদারীপুর সদরের ছিলারচর ইউনিয়নের পশ্চিম রঘুরামপুর গ্রামের প্রাণকৃষ্ণ। তার স্ত্রী গোবর দিয়ে জ্বালানি বানিয়ে বিক্রি করে সংসার চালান।

ভালোভাবে খেয়েপড়ে বাঁচতে চাওয়ার পাশাপাশি এতসব দুর্ভোগের পেছনে দায়ী হামলাকারীদের বিচারে শিগগিরই শাস্তি দেখতে তারা।