কান্না থামছে না সুন্দ্রাটিকিতে

এক সঙ্গে চার শিশু নিখোঁজ হওয়ার পর উদ্বিগ্ন ছিল সুন্দ্রাটিকির মানুষ, শিশুগুলোর লাশ মেলার পর এখন কান্নার রোল হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার গ্রামটিতে।

রাসেল চৌধুরী হবিগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Feb 2016, 04:09 PM
Updated : 17 Feb 2016, 04:09 PM

বুধবার সকালে লাশ উদ্ধারের পর দুপুরে করাঙ্গী নদীর পাড়ের গ্রামটিতে গিয়েও দেখা যায়, নিহতদের মা-বাবারা মুর্ছা যাচ্ছেন বারবার। তাদের সান্ত্বনা দিতে আসা গোটা গ্রামের মানুষের চোখেও জল।

একসঙ্গে চার শিশু খুন হওয়ার খবর শুনে আশপাশের এলাকা থেকে যে হাজার হাজার মানুষ সুন্দ্রাটেকিতে ছুটে গিয়েছিল, বিকালে ফেরার সময়ও তাদের চোখে ছিল বেদনার ছাপ।

গত শুক্রবার খেলতে গিয়ে একসঙ্গে নিখোঁজ হয় চারটি পরিবারের ৭ থেকে ১০ বছর বয়সী চারটি শিশু। পাঁচ দিন পর বালুচাপা পড়া লাশ দেখে সবাইকে খবর দেয় অন্য দুটি শিশু।    

এরপর মাটি খুঁড়ে বের করে আনা হয় আবদাল মিয়া তালুকদারের ছেলে মনির মিয়া (৭), ওয়াহিদ মিয়ার ছেলে জাকারিয়া আহমেদ শুভ (৮), আব্দুল আজিজের ছেলে তাজেল মিয়া (১০) এবং আব্দুল কাদিরের ছেলে ইসমাইল হোসেনের (১০) লাশ।

মনির সুন্দ্রাটিকি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে এবং তার দুই চাচাত ভাই শুভ ও তাজেল একই স্কুলে দ্বিতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ত। আর তাদের প্রতিবেশী ইসমাইল পড়ত সুন্দ্রাটেকি মাদ্রাসায়।

হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে গ্রামের দুই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাহুবল মডেল থানার ওসি মোশাররফ হোসেন।তারা হলেন- আব্দুল আলী ও জুয়েল। খুনিদের ধরিয়ে দিতে এক লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছেন সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি মিজানুর রহমান।

কী কারণে এই শিশুগুলোকে হত্যা করা হয়েছ, তা নিশ্চিত করে বলতে পারেনি পুলিশ। তবে নিহতদের স্বজনদের সন্দেহ, গাছ কাটা নিয়ে গ্রামে বিরোধ থেকে এই হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে।

নিহত মনিরের বাবা আবদাল মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মাসখানেক আগে গাছ কাটা নিয়ে গ্রামের আব্দুল হাইয়ের সঙ্গে তাদের মারামারি হয়। তার জেরে আব্দুল হাই ও তার পক্ষের লোকজন এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে থাকতে পারে।

গত শুক্রবার অনেক খোঁজাখুঁজির পর এই শিশুগুলোর সন্ধান না পেয়ে রাতে উপজেলার সব এলাকায় মাইকিং করেন স্বজনরা। তাতেও সন্ধান না পেয়ে পরদিন শুভর বাবা ওয়াহিদ মিয়া থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন।

তারপর থেকে খোঁজ চললেও কোনো সন্ধান মিলছিল না। বুধবার সকালে লাশ পাওয়ার পরপরই পুলিশসহ প্রশাসনিক কর্মকর্তারা যান সেখানে।

হবিগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ইমরান হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সকালে লাশ পাওয়ার খবর পেয়েই একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং বাহুবলের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়।”  

পুলিশ সুপার জয়দেব কুমার ভদ্র সাংবাদিকদের জানান, মাটির স্তূপের নিচ থেকে তুলে আনার পর লাশগুলো জেলা সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয় ময়নাতদন্তের জন্য। এরপর সন্ধ্যায় স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয় লাশ।

হবিগঞ্জ আধুনিক সদর হাসপাতালের চিকিৎসক দেবাশীষ দাশ সাংবাদিকদের বলেন, চার শিশুকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া তাদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্নও রয়েছে।

পুলিশ সুপার জয়দেব বলেন, চার শিশুকে অন্য কোথাও হত্যার পর লাশ বিল এলাকায় এনে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

“প্রাথমিকভাবে এটা শত্রুতা থেকে হত্যাকাণ্ড বলেই মনে হচ্ছে,” উল্লেখ করে তদন্তের মাধ্যমে খুনিদের দ্রুততম সময়ে গ্রেপ্তারের আশ্বাস দেন তিনি।

শিয়ালে খাচ্ছিল লাশ

করাঙ্গী নদীর পাশে মাটির নিচে মনির, শুভ, তাজেল ও ইসমাইলের লাশের প্রথম খোঁজ জানায় গ্রামেরই দুটি শিশু। তারপর খবর পান অন্যরা, ছুটে যায় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা।

গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দিনমজুর কাজল মিয়া সকালে করাঙ্গী নদীর পাশে মাটি কাটতে গিয়েছিলেন। তার সঙ্গে কাজ করতে যাওয়া কয়েকজনের জন্য দুই শিশু সকালের নাস্তা নিয়ে যাচ্ছিল সকাল ৯টার দিকে।  

হঠাৎ ওই শিশুদের চিৎকার শুনে এগিয়ে কাজল মিয়া মাটিচাপা অবস্থায় এক শিশুর হাত ও মাথা দেখতে পান। হালকা দুর্গন্ধও আসছিল।

এরপর কাজল মিয়া নিখোঁজ চার শিশুর পরিবারকে খবর পাঠান। খবর দেওয়া হয় বাহুবল থানায়ও।

কাজল মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, তিনি প্রথমে দেখেছিলেন তাজেল মিয়ার হাত। হাতের কিছু অংশ শিয়ালে খেয়ে ফেলছিল।

লাশ উত্তোলনে সহায়তাকারী আকলিছ মিয়ার ধারণা, খুন বেশি আগে করা হয়নি। পুরনো হলে অনেক দুর্গন্ধ থাকত। তাজেল মিয়ার হাতের কিছু অংশ শিয়াল খেয়ে ফেলেছিল। সব শিশুর গায়েই পোশাক ছিল।

“তাদের মুখ ছিল কাটা এবং জিহ্বা বের করা। ১/২ ফুট পর পর লাশগুলো চাপা দেওয়া হয়। গর্তগুলো ছিল ৩ ফুটের মতো গভীর।”

</div>  </p>