“প্যাকেটে ভরে ১৬ শ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে। আসলে ওরা ক্রেতাদের পকেট মারছে। এটা কি দেখার কেউ নেই?”
Published : 06 Apr 2024, 10:02 AM
ঈদ এলে সারা দেশেই লাচ্ছা সেমাইয়ের কদর বাড়ে; আর ক্রেতাদের কাছে বগুড়ার লাচ্ছার রয়েছে বাড়তি কদর। তবে এ গল্পের সবটাই সুমিষ্ট নয়।
খোদ কারিগররাই বলছেন, ‘সুনাম’ তৈরি হওয়ায় উৎপাদন খরচের ‘তিনগুণ’ দামেও বাজারে বিক্রি হয় বগুড়ার লাচ্ছা সেমাই। কিন্তু সে দামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে না শ্রমিকের মজুরি।
আবার ঘিয়ে ভাজা লাচ্ছা বলে যা বাজারে বিক্রি হয়, তা আসলে কী দিয়ে ভাজা, তা নিয়েও সংশয় থাকে ক্রেতাদের। তাদের আপত্তি আছে দাম নিয়েও।
বগুড়ার লাচ্ছার চাহিদা থাকায় এ জেলায় গড়ে উঠেছে দুই শতাধিক ছোট-বড় কারখানা।দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এখন সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে এ সেমাই।
ঈদে এ সেমাইয়ের বিক্রি ২০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায় বলে ব্যবসায়ীদের ভাষ্য।
লাচ্ছার বাজার
বাজার ঘুরে দেখা গেল, একেক বেকারির লাচ্ছা প্যাকেটে ভরে ডালডা ভাজা ও ঘিয়ে ভাজা নামে একেক দামে বিক্রি হচ্ছে। ‘শ্যামলী কনফেকশনারির ডালডা দিয়ে ভাজা খোলা লাচ্ছা সেমাইয়ের দাম ধরা হয়েছে ১৩০ টাকা। আর ঘিয়ে ভাজা প্যাকেটজাত লাচ্ছা বিক্রি হচ্ছে ৫০০ টাকা কেজি দরে।
পাশেই বগুড়ার সবচেয়ে বড় কনফেকশনারি ‘আকবরিয়ায়’ ডালডায় ভাজা লাচ্ছা ৩০০ টাকা; ঘিয়ে ভাজা লিখে প্যাকেটজাত লাচ্ছা স্পেশাল ১১’শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
আবার, ফতেহ আলী বাজারসহ অন্য কয়েক জায়গায় ডালডা লাচ্ছা প্রতি কেজি মিলছে ১৬০ টাকায় এবং ঘিয়ে ভাজা মিলছে ২২০ টাকায়।
এদিকে প্যাকেটের ঘিয়ে ভাজা লাচ্ছা কিনতে গিয়ে দামের ফারাক দেখে চোখ কপালে উঠছে ক্রেতাদের। আসল-নকল বুঝতেও হিমশিম খাচ্ছেন তারা।
কথা হয় বগুড়া বারের আইনজীবী আব্দুল লতিফ ববির সঙ্গে। বাজারের ঘিয়ে ভাজা লাচ্ছা নামে যে লাচ্ছা বিক্রি হচ্ছে, তার মান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি।
ববি বলেন, “প্যাকেটে ভরে ১৬ শ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে। আসলে ওরা ক্রেতাদের পকেট মারছে। এটা কি দেখার কেউ নেই?”
বগুড়া সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের দপ্তর সম্পাদক এইচ আলীম বলেন, “ময়দার দাম তো আগের চেয়ে কমেছে। যদি বিশুদ্ধ এবং পরিমিত ঘি দিয়ে তৈরি করে প্যাকেটজাত করে, তাহলেও তো ৭০০ টাকার বেশি হওয়ার কথা না।
“কিন্তু বিভিন্ন নামে প্যাকেটবন্দি করে ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা করে বিক্রি করছে; এটা অস্বাভাবিক।”
বাজারে গিয়ে সংশয়ে পড়ার কথা জানিয়ে সূত্রাপুর এলাকার গৃহিণী লাবনী আক্তার বলেন, “ঘিয়ে ভাজা লাচ্ছার একেকটার দাম একেক রকম। বুঝব কীভাবে কোনটা আসল ঘি দিয়ে তৈরি? তার উপর যে দাম, তাই খোলা ডালডা ভাজা লাচ্ছাই ১৩০ টাকায় কিনেছি।”
দামে ও মানে ‘নয় ছয়’
লাচ্ছা তৈরির কারিগর মো. আলমাস আলী বিডিনিউজের টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, লাচ্ছা সেমাই দুই ধরনের হয়। একটি ভুনা বা স্পেশাল, অন্যটি সাধারণ।
কোন লাচ্ছা বানাতে খরচ কেমন? আলমাস জানালেন, ৭৪ কেজির এক বস্তা ময়দা ৪ হাজার টাকা, ডালডা ১৬ কেজি ২২৬০ টাকা, পাম ওয়েল ২২ কেজি ২৯৫০ টাকা, চারকোল লাকড়ি ২ মণ ৮০০ টাকা। মোট ৯ হাজার ২৯৩ টাকার সঙ্গে তিনজন কারিগরের মজুরি ১ হাজার টাকা।
মোট ১০ হাজার ২৯৩ টাকায় ৯২ কেজি লাচ্ছা উৎপাদন হয়। সাধারণটা তৈরি করলে ১১১ টাকা আর স্পেশালটা ১৩০ টাকা কেজি উৎপাদন খরচ পড়ে। ওই লাচ্ছাই বাজারে বিক্রি হয় কয়েক গুণ বেশি দামে।
প্রায় ত্রিশ বছর লাচ্ছার কারিগর হিসাবে কাজ করে আসা এক হেড কারিগর বলেন, “আসলে ঘিয়ে ভাজা লাচ্ছা বলে বাজারে প্যাকেটজাত যা বিক্রি হয়, তা সম্পূর্ণ ঘিয়ে ভাজা নয়। আবার এই ঘি আসল কী-না, এটা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে।”
ঘি দিয়ে ভাজা লাচ্ছা তৈরির প্রক্রিয়া কী জানতে চাইলে তিনি বলন, প্রথমে পরিমাণমত ডালডার সঙ্গে সামান্য ঘি মিশিয়ে ময়দার মণ্ড তৈরি করা হয়। তারপর চুলায় পাম ওয়েল কিংবা ডালডার সঙ্গে ঘি দিয়ে ভেজে সেই লাচ্ছায় হালকা ঘি ছিটিয়ে প্যাকেটজাত করা হয়।
“তখন মনে হয়, সমস্ত লাচ্ছা বোধ হয় ঘিয়ে ভাজা হয়েছে। আসলে পুরোপুরি ঘি দিয়ে তৈরি করতে গেলে লাচ্ছা নিমিষে পুড়ে যাবে। ঘিয়ে ভাজা লাচ্ছা মূলত ফ্লেভার তৈরি করা। ঘির ফ্লেভার আর প্যাকেটজাত হলেই দাম বেড়ে যায় কয়েকগুণ।”
উৎপাদন খরচ আর বাজার দরের পার্থক্য নিয়ে প্রশ্ন করলে বগুড়া ব্রেড অ্যান্ড বিস্কুট ফ্যাক্টরি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও শিমু বেকারির মালিক ইমদাদুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি ঘিয়ে ভাজা লাচ্ছা পাইকারি ৬’শ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছি। অতিরিক্ত দাম নেওয়ার কোনো মানে বুঝি না।”
অনেক বেকারিতে একেক প্যাকেটে একেক দাম রাখা হচ্ছে কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “তাদের কি কারিশমা আছে, আমার জানা নেই।”
লাচ্ছার দাম এবং মান নিয়ে জানতে বগুড়া বেকারি অ্যান্ড বিস্কুট ফ্যাক্টরি মালিক সমিতির সভাপতি ও আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেলের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর আলাল হোসেনকে একাধিক বার ফোন ও মেসেজ করেও সাড়া মেলেনি।
বগুড়া ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ইফতেখার আহাম্মেদ বলেন, “দাম কে কত নিচ্ছে এটা আমাদের বিষয় নয়। ওজনে কম হচ্ছে কিনা বলুন। লাচ্ছার মান নিয়ে কথা বলতে পারবো না।”
শ্রমিকের বঞ্চনা
দিন দিন লাচ্ছার দাম বাড়লেও বাড়ে না শ্রমিকের মজুরি। কারিগররা বলছেন, বিশুদ্ধ ঘি পরিমিত দিয়ে লাচ্ছা সেমাই তৈরি করলে ৩৫০ টাকা কেজির দাম হবে; প্যাকেট না করলেও। তারা মজুরি কম পেলেও প্যাকেট করলেই মালিকরা পাঁচগুণ বেশি দামে বিক্রি করতে পারেন।
জেলায় ছয় হাজার শ্রমিক লাচ্ছা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত জানিয়ে বগুড়া বেকারি অ্যান্ড কনফেকশনারি শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক নুর মোহাম্মদ রাঙ্গা বলেন, মালিক পক্ষ প্রতি বছর শত কোটি টাকা লাভ করলেও তাদের মজুরি আর বোনাস বাড়ে না।
তিনি বলেন, “চাপে পড়ে কিংবা লোক দেখাতে কোনো কোনো মালিক কিছু শ্রমিককে বোনাস দিয়ে থাকে।”
কারখানাগুলোর পরিবেশ শ্রমিকদের সহায়ক নয় বলেও তার অভিযোগ।
শ্রমিকদের মজুরির বিষয়ে জানতে চাইলে বগুড়া বেকারি অ্যান্ড বিস্কুট ফ্যাক্টরি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইমদাদুল হক বলেন, “শ্রমিকদের মজুরি এবং বোনাস আমি দিয়ে দিই। অন্যরা কে কী করে, তা জানা নেই। তবে সমিতির পক্ষ থেকে মজুরি -বোনাস দেওয়ার কথা বলে দেই আমরা।”
সারা বছর তো কাজ থাকে না, তখন কীভাবে চলে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ঈদে লাচ্ছা তৈরির কাজ বেশি হয়। তবে সারা বছর শ্রমিকরা বিস্কুট, রুটিসহ বেকারির অন্য কাজ করে।”
বগুড়ায় লাচ্ছে যেভাবে জনপ্রিয়
বগুড়ার ইতিহাস ঐতিহ্যের লেখক আব্দুর রহিম বগরা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ হয়। ইংরেজরা সন্দেহ করেছিল, এই বিদ্রোহের সঙ্গে অযোধ্যার নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ ছিলেন। তখন ইংরেজরা তাকে অযোধ্যা ছাড়ার শর্ত দিয়েছিলেন।
“ওয়াজেদ আলী শাহ ছিলেন শিল্প অনুরাগী। তার বেকারি শিল্পও ছিল। তিনি সব কর্মকর্তা, কর্মচারীদের নিয়ে চলে যান কলকাতার মেকিয়া বুরুজসহ লা খোদা মসজিদের বিশাল এলাকায়। সেখানে অন্যান্য সামগ্রীর সঙ্গে লাচ্ছা সেমাইও তৈরি হত। সেখানে লাচ্ছা তৈরির পদ্ধতি শিখে পরে বগুড়ায় এসে বানানো শুরু করেন।”
রহিম বলেন, “বগুড়ার প্রথম বেকারি ‘ক্যালকাটা বেকারি’র মোজাম্মেল হকের বংশধররা কলকাতা থেকে চলে আসে এবং কিছু কর্মচারী নিয়ে বগুড়ায় লাচ্ছা সেমাই তৈরি শুরু করে। এভাবেই এখানে এ খাবারের প্রসার ঘটে; যা এখন দেশব্যাপী জনপ্রিয়।”
বগুড়া ব্রেড অ্যান্ড বিস্কুট ফ্যাক্টরি মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বলেন, “বগুড়ার লাচ্ছা শুধু সারা দেশেই নয়; সৌদি আরব মধ্যে পাচ্যের দেশ সহ আমেরিকা, ইউরোপেও যাচ্ছে।”