তার তিন বছরের মেয়াদকালে তিনি ৪ হাজার ২০০ টাকায় দুটি টিস্যু বক্স ক্রয় করে একটি নিজের বাসায় নিয়ে যায়।
Published : 08 Sep 2024, 09:13 PM
বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চিত্রকলা, প্রাচ্যকলা ও ছাপচিত্র বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সুজন সেনকে অপসারণের দাবি তুলেছেন বিভাগের শিক্ষার্থীরা।
রোববার দুপুরে উপাচার্য সালেহ হাসান নকীবের কাছে ওই শিক্ষকের অপসারণের দাবিতে অভিযোগপত্র জমা দেয় শিক্ষার্থীরা।
অভিযোগপত্রে সুজন সেনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দায়িত্বে থাকাকালীন নানা অনিয়মের কথা উল্লেখ করেছে তারা।
এর আগে চারুকলা সংলগ্ন মুক্তমঞ্চের সামনে সুজন সেনের কুশপুত্তলিকা দাহ করে শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া তার পদত্যাগের দাবিতে অবস্থান কর্মসূচিও পালন করে তারা।
এ সময় শিক্ষার্থীরা ‘ভাউচার সুজনের দুই গালে, জুতা মারো তালে তালে’, ‘এক দফা এক দাবি, সুজন সেনের চাকরিচ্যুতি’, ‘চারুকলায় তেলবাজি, চলবে না, চলবে না’, ‘চারুকলায় দুর্নীতি, চলবে না, চলবে না’- সহ বিভিন্ন স্লোগান দেয়।
এরপরে উপাচার্য বরাবর দেওয়া অভিযোগের অনুলিপি বিভাগের সভাপতি বরাবর জমা দেয় তারা। এছাড়া অনুলিপিটি ছাত্র উপদেষ্টার দপ্তর এবং বিভাগীয় সভাপতিকেও দেওয়া হয়।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, “শিক্ষক হিসেবে সুজন সেনের দায়িত্ব শিক্ষার্থীদের সঠিক শিক্ষাদান করা হলেও এর পরিবর্তে তিনি স্বৈরাচারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। চারুকলার প্রতিটি বিষয় ব্যবহারিক সম্পর্কিত হওয়া সত্ত্বেও কোন শিক্ষার্থী তাকে সরাসরি শ্রেণির ব্যবহারিক বিষয় হাতেনাতে শিখিয়ে দিতে দেখেনি। শিক্ষার্থীদের মনমতো নম্বর প্রদান, খেয়াল খুশিমতো বিভিন্ন বর্ষের পরীক্ষা নেওয়া, অনেক ক্ষেত্রে কোর্স শেষ না করেই পরীক্ষা নেওয়া, পছন্দের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার আগেই প্রশ্নপত্র সরবরাহ করা এবং শিক্ষার্থীদেরকে নানাভাবে অপদস্ত করতেন তিনি। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ফিল্ড স্টাডিতে গিয়েও তিনি টাকা ত্মসাত করেছেন বলেও জানা যায়।”
এছাড়াও অন্যের কাজ কারচুপি করে ‘রাজনৈতিক প্রভাব’ খাটিয়ে বিভাগে শিক্ষক হওয়ার কথাও উল্লেখ করে শিক্ষার্থীরা।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, “শহীদ জিয়াউর রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ (এপ্রিল ২০২১-এপ্রিল ২০২৪) থাকাকালীন সুজন সেন নাস্তা, খাবার, ইলেকট্রনিক দ্রব্য ও তৈজসপত্রসহ অন্যান্য দ্রব্য ক্রয়ের শতকরা ৮০ ভাগ ভাউচারেই জালিয়াতি করেছে। এই ভাউচারগুলোর মধ্যে কিছু ভাউচার তিনি নিজে লিখেছেন এবং কিছু হল সুপার মামুনুর রহমানকে দিয়ে লিখিয়েছেন। শুধু মামুনুরের হাতে লেখা তিন শতাধিক জাল ভাউচারেই তিনি প্রায় ১০ লাখ ৪৬ হাজার ৪৫৬ টাকার দ্রব্য ক্রয় দেখিয়েছেন।”
তার তিন বছরের মেয়াদকালে তিনি ৪ হাজার ২০০ টাকায় দুটি টিস্যু বক্স ক্রয় করে একটি নিজের বাসায় নিয়ে যায়। নাস্তা ও খাবার বাবদ প্রায় ৪ লক্ষ ১৮ হাজার ৮৯০ টাকা, ইন্টারনেট, লাইব্রেরি এবং ক্রীড়া তহবিল থেকে তিনি প্রায় ১ লক্ষ ৮২ হাজার ৬১০ টাকা, নিজের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ‘অ্যাভন মেটালিক’ থেকে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে হলের জন্য তিনি প্রায় ২ লক্ষ ২০ হাজার ৫৪৫ টাকার নেমপ্লেট, অনারবোর্ড এবং ক্রেস্ট ক্রয়, প্রাধ্যক্ষের কক্ষ সম্প্রসারণের জন্য ১ লক্ষ ৩৫ হাজার টাকা দিয়ে দুটি এসি এবং ইন্টোরিয়রের জন্য আসবাব, র্যাক, জানালার পর্দা, গ্লাস ভোর পর্দা, টিস্যু বক্স বাবদ ১ লক্ষ ৪০ হাজার ৭৩৩ টাকা ব্যয় করেন বলে জানা যায় অভিযোগপত্রে।
এ ছাড়া হলের বিবিধ খরচে এক ভাউচারে ৪ হাজার ২০০ টাকায় দুটি টিস্যু বক্স ক্রয় করার বিষয়টিও উঠে এসেছে বলে অভিযোগপত্রে বলা হয়। এই টিস্যু বক্সের একটি নিজ বাসাতেও নিয়ে গেছেন বলে উল্লেখ করা হয়।
ছাত্র কল্যাণ তহবিলের ৫৩ হাজার ৫০০ টাকার পুরোটাতে দুর্নীতি হয়েছে উল্লেখ করে বলা হয়, “তহবিল থেকে শিক্ষার্থী পরিচয়ে সহযোগিতা চেয়ে ৪৯টি আবেদনের প্রেক্ষিতে তিনটি বৈধ আবেদনের মধ্যে কেবল একজন শিক্ষার্থী ১০০০ টাকা পেয়েছেন। বঙ্গবন্ধু কর্নারের নামে তিনি প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয় দেখালেও এখানে বই বাবদ তিনি খরচ করেছেন মাত্র ৪৪ হাজার ৬৯৭ টাকা। বাকি অর্থ তিনি নিজের দোকান থেকে ক্রয় করা চড়া মূল্যের স্মারক, ফলক এবং উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচেই ব্যয় করেছেন।
“এ ছাড়া হলের প্রাধ্যক্ষ থাকা অবস্থায় ২০২২ সালের শেষের দিকে সুজন সেন প্রাধ্যক্ষ পরিষদের আহ্বায়কের দায়িত্বে ছিলেন। একই বছরের ২৮ ডিসেম্বর সমন্বিত হল সমাপনীর আয়োজন করা হয়। এ সময় কোনো দরপত্র আহ্বান ও ক্রেস্ট কমিটির পরামর্শ ছাড়াই একক সিদ্ধান্তে নিজের দোকান থেকে ক্রেস্ট ক্রয় করেন তিনি। ১৯০৬ জন শিক্ষার্থীর জন্য প্রায় ১৫০ টাকার প্রস্তাবিত মূল্যে অত্যন্ত নিম্নমানের ক্রেস্ট সরবরাহ করেন তিনি (সংযুক্তি-৩২)। তৎকালীন এ বিষয়ে একাধিক হল প্রাধ্যক্ষ প্রতিবাদ করেছিলেন বলে জানানো হয়।”
অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, সুজন সেনের মেয়াদকালে জিয়াউর রহমান হলে প্রকৌশল দপ্তর থেকে এককভাবে ৩৯ লাখ ২২ হাজার ২০৮ টাকা এবং বিভিন্ন বিভাগ ও হল মিলে সমন্বিতভাবে ১১ লাখ ৮১ হাজার ৭০০ টাকার কার্যাদেশ আসে। এর বাইরেও প্রায় ৩৩ লাখ টাকার আরেকটি কার্যাদেশ আসে বলে হল সুপার মামুনুর রহমান জানিয়েছেন।
“তবে সেটির কাগজপত্র জন সেন নিজের কাছেই রেখে দিয়েছেন। এটি তিনি হল কর্তৃপক্ষের হাতে দেননি।"
অভিযোগের বিষয়ে জানতে সুজন সেনকে ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
এ বিষয়ে চিত্রকলা, প্রাচ্যকলা ও ছাপচিত্র বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক বনি আদম বলেন, “একজন চেয়ারম্যান চাইলেই কাউকে অব্যাহতি দিতে পারে না। আমরা অনুলিপিটা গ্রহণ করেছি। এর ভিত্তিতে বিভাগের শিক্ষকদের নিয়ে একটি জরুরি বৈঠকে বসবো। অধিকাংশ শিক্ষকের মতামতের ভিত্তিতে যা সিদ্ধান্ত আসবে সেটাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। সোমবার মধ্যে আমরা বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারবো।"