ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে না যাওয়ায় রাজশাহী কলেজের ৩০ ছাত্রকে মারধর

ছাত্রদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য রাতে ছাত্রাবাসে উপস্থিত হন কলেজের অধ্যক্ষ আবদুল খালেক ও একজন সহযোগী অধ্যাপক।

রাজশাহী প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Feb 2023, 08:03 AM
Updated : 23 Feb 2023, 08:03 AM

ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে না যাওয়ায় রাজশাহী কলেজ ছাত্রাবাসে থাকা ৩০ শিক্ষার্থীকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে। যাদের মধ্যে দু’জন শিক্ষানবিশ সংবাদকর্মী।

বুধবার রাতে কলেজের মুসলিম ছাত্রাবাসের ই এবং বি ব্লকে এই ঘটনার পর ছাত্রদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ছাত্রাবাসে উপস্থিত হন কলেজের অধ্যক্ষ আবদুল খালেক ও একজন সহযোগী অধ্যাপক।

ছাত্রলীগের কর্মীরা তাদের সামনেই শিক্ষার্থীদের দেখে নেওয়ার হুমকি দেন। পরে রাত ১টার দিকে বহিরাগতদের বের করে দিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করেন অধ্যক্ষ।

মারধরের শিকার সংবাদকর্মীরা হলেন, কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নাজমুস সাকিব ও শরীফুল ইসলাম। তারা রাজশাহী কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটির সদস্য।

নাজমুস সাকিব বলেন, বুধবার বিকালে ছাত্রলীগের একটি কর্মসূচি ছিল। ওই কর্মসূচিতে না যাওয়ায় সন্ধ্যার পর ছাত্রাবাসের ই ব্লক ও বি ব্লকের বিভিন্ন কক্ষে কক্ষে ঢুকে শিক্ষার্থীদের মারধর শুরু করেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।

তিনি বলেন, বিভিন্ন সময় ছাত্রলীগের কর্মীরা তাদের দলীয় কর্মসূচিতে জোর করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে যান। বুধবার বিকালেও ছাত্রলীগের একটা কর্মসূচিতে যেতে হয়।

সেখান থেকে অসুস্থতার জন্য মেডিকেলে যেতে চাইলেও ছাত্রলীগ নেতা রাফি (কর্মসূচির আহ্বায়ক) তাকে ছাত্রাবাস ছেড়ে দিতে বলেন। পরে তাকে কোনোরকমে বুঝিয়ে তিনি মেডিকেলে যান।

“সেখান থেকে সন্ধ্যা ৬টায় ছাত্রাবাসে ফিরলে ছাত্রলীগের শাহরুখ, রাজু, রাফি, হাসানসহ আট থেকে দশজন মিলে আমার কক্ষে ঢুকে মারধর করতে থাকেন।”

নাজমুস আরও বলেন, ছাত্রলীগ কর্মীরা তার মুঠোফোনসহ বেশ কিছু দামি জিনিস কেড়ে নেয়। একপর্যায়ে সব শিক্ষার্থীকে ব্লকে আটকে রেখে অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করতে থাকেন, অনেককে মারধরও করেন।

পরে সবাইকে ধাক্কা দিতে দিতে গণরুমে নিয়ে যায়। সেখানে ‘কারও কাছে কিছু বললে আরও ভয়ানক কিছু ঘটবে’ বলেও শাসানো হয়।

আরেক ভুক্তভোগী শরিফুল ইসলাম জানান, বুধবার সকাল সাড়ে ৯টায় ব্যক্তিগত কাজে ছাত্রাবাস থেকে বের হয়ে যান তিনি। সারা দিন ব্যস্ত ছিলেন। সন্ধ্যায় রুমে ঢুকে সংবাদ লিখছিলেন।

এমন সময় হঠাৎ ছাত্রলীগ কর্মী শাহরুখ তার রুমে ঢুকে পড়েন। কিছু না জিজ্ঞাসা করেই অতর্কিতে মারতে থাকেন।

তিনি সাংবাদিক পরিচয় দিলে আরও মারতে শুরু করেন। তার সঙ্গে আরও ছেলে এসে তাকে মেরে কক্ষ থেকে বের করে দেয়।

নাম প্রকাশ না করে এক শিক্ষার্থী অভিযোগ করে বলেন, ঘটনার পরে ছাত্রলীগের প্রোগ্রামে নিয়মিত উপস্থিত না থাকলে হোস্টেল থেকে বের করে দেওয়ার কথা বলে শাসিয়েছেন ছাত্রলীগ কলেজ শাখার সভাপতি রাশিক দত্ত।

প্রত্যক্ষদর্শী ওই শিক্ষার্থী আরও জানান, রাতে সাংবাদিক, কলেজ ফাঁড়ির পুলিশ, কলেজ অধ্যক্ষ আবদুল খালেক ও কলেজের সহযোগী অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ছাত্রাবাসে আসেন। এ সময় সাধারণ শিক্ষার্থীরা অধ্যক্ষের কাছে তাদের নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেন।

সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলার সময় ছাত্রলীগ কর্মীরা অধ্যক্ষের সামনেই দুই সাংবাদিককে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন। তখন ছাত্রাবাসে ব্যাপক ভিড় হয়।

রাতে প্রায় ১২টার দিকে তিনজন বহিরাগত একটি মোটরসাইকেলে ছাত্রাবাসে ঢোকেন। সে সময় অধ্যক্ষ একজন ছাত্রলীগ কর্মীর সঙ্গে ছাত্র নির্যাতনের বিষয় নিয়ে কথা বলছিলেন। একজন বহিরাগত অধ্যক্ষের সামনে থেকে ওই কর্মীকে টেনে নিয়ে যান। এতে সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।

এ সময় অধ্যক্ষ ও শিক্ষক আনিসুজ্জামান তাদের ডেকে জানতে চান, কেন তারা এত রাতে ছাত্রাবাসে ঢুকেছেন? তারা নিজেদের ছাত্রলীগের বড় ভাই দাবি করেন। শেষ পর্যন্ত রাত প্রায় ১টার দিকে তাদের বের করে দেওয়া হয়।

একজন ছাত্রলীগ নেতা অধ্যক্ষকে বলেন, “তিনি দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি থাকতে ওই দুই ছাত্রের গায়ে একটা ফুলের টোকাও কেউ দেবে না। অধ্যক্ষ তখন বলেন, সব সাধারণ ছাত্রেরই দায়িত্ব নিতে হবে। তাদের যেন কিছু না হয়।’’

শিক্ষার্থীরা জানান হামলায় জড়িত শাহরুখ, রাফি, ইমন, তরিকুল, রাজু, হাসান, আহসান- রাজশাহী কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি রাশিক দত্তের অনুসারী বলে পরিচিত। তবে রাশিক দত্ত ঘটনাস্থলে ছিলেন না।

ঘটনাটা শুনেছেন জানিয়ে রাশিক দত্ত সাংবাদিকদের বলেন, তার ছেলেরা এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। তাদেরও তো রাজনীতি করতে হয়। বিভিন্ন সংগঠনের চার থেকে পাঁচ জন করে যদি ২০ জন ছেলে চলে যায়, তাহলে তারা কীভাবে অনুষ্ঠানটা চালাবেন? তবে এরপর থেকে এমন হবে না। তাদের সঙ্গে বসে সমঝোতা করে নেবেন।

নগর ছাত্রলীগের সভাপতি নূর মোহাম্মদ সিয়াম বলেন, “ঘটনা শুনে আমিও বিব্রত। এর আগে আমরাও ছিলাম, এ রকম ঘটনা কখনও ঘটেনি। আমরা খুব আন্তরিকতার সাথে ছিলাম। এখন তাদের সঙ্গে কথা বলে দেখি কী করা যায়। “

কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর আব্দুল খালেক বলেন, “এর আগেও রাশিক নেতৃত্বে এসে একবার এমন ঘটনা ঘটিয়েছে, সেটা মোটামুটি এক ধরনের দফারফা হয়েছিল। আর সে এরকম ঘটনা করবে না বলে আমাদের কাছে জানিয়েছিল। আবার হঠাৎ করে কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে?

“এরকম ঘটনা যাতে করে আর না ঘটাতে পারে সেভাবে আমরা ব্যবস্থা নেব। আমরা তাদের ঊর্ধ্বতন নেতৃবৃন্দকে জানানোর কথা ভাবছি, দেখি তারা কী বলেন।”