কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরে গেলেও কোনো লাভ হয়নি বলে জানান দুর্ঘটনায় অঙ্গহানির শিকার শেখ ফরিদ।
Published : 06 Jul 2023, 03:11 PM
নারায়ণগঞ্জে স্টিল রি-রোলিং মিল শ্রমিকদের উচ্চমাত্রার ঝুঁকির পরিবেশে কাজ করতে হচ্ছে। একদিকে তাদের কাজে যেমন নেই নিরাপদ পরিবেশ; অন্যদিকে, নিয়মিত কারখানায় কাজ করলেও তাদের দেওয়া হয় না কোনো প্রকার নিয়োগপত্র বা কার্ড।
দেশের চাহিদার অধিকাংশ রড উৎপাদন করেন এসব স্টিল রি-রোলিং কারখানার শ্রমিকরা। তবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করা এসব শ্রমিকদের মেলে না পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। উচ্চঝুঁকির ভাট্টিতে (লোহা গলানোর চুল্লি) কাজ করার সময় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার না থাকায় দুর্ঘটনার শিকার হয়ে প্রাণ ও অঙ্গহানির ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত।
কারখানা থেকে নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র না দেওয়ায় কর্মরত অবস্থায় দুর্ঘটনার শিকার শ্রমিকরা পান না ক্ষতিপূরণও।
এ ছাড়া শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের নিম্নতম মজুরি বোর্ড থাকলেও শ্রমিকরা কাজ করেন দৈনিক মজুরিতে। যা নির্ধারিত মজুরির চেয়ে অনেক কম।
এক দশকেরও বেশি সময় স্টিল রি-রোলিং মিলে কাজ করেন মধ্যবয়সী শেখ ফরিদ। কারখানায় বেশিরভাগ সময় ভাট্টিতে কাটান। কাজ করার সময় শরীরে আগুনের ছ্যাঁকা লাগা, ভারী লোহার টুকরো পায়ের উপর পড়ার মতো ঘটনা কতবার ঘটেছে তার কোনো হিসাব নেই। তবে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনাটির শিকার হন গত বছরের মার্চে। ওই দুর্ঘটনার স্মৃতি এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি।
কর্মস্থলে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার না থাকায় দুর্ঘটনার শিকার হন বলে জানান তিনি।
ভাট্টির ভেতরে থাকা দ্রুতগতির পাখায় বাঁ হাত ঢুকে গিয়ে তিনটি আঙুল কাটা পড়ে তার। তবে এই অঙ্গহানির পর কারখানার পক্ষ থেকে কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি ফরিদ।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরেও গিয়েও কোনো লাভ হয়নি বলে অভিযোগ তার। পাঁচ মাস পর আঙুল কাটা হাত নিয়েই অন্য কারখানায় পুনরায় কাজে যোগ দেন।
ফরিদ জানান, হরহামেশা দুর্ঘটনার সম্মুখীন হতে হয় তাদের। কিন্তু শ্রম আইন অনুযায়ী, ন্যায্য ক্ষতিপূরণের দাবিতে আইনের দ্বারস্থ হওয়ারও সুযোগ পান না শ্রমিকরা। কারণ তাদের দেওয়া হয় না কোনো নিয়োগপত্র বা পরিচয়পত্র।
স্টিল রি-রোলিং মিলে কর্মরত আরও অন্তত ১৪ জন শ্রমিক এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে ফরিদের কথার মিল পাওয়া যায়।
চলতি বছরের ৪ মে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলায় লোহা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রহিমা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স লিমিটেডের (আরআইসিএল) চুল্লিতে লোহা গলানোর সময় বিস্ফোরণে গলিত লোহা গায়ে পড়ে সাতজন শ্রমিক দগ্ধ হন। দগ্ধ শ্রমিকদের কেউই বেঁচে নেই। সর্বশেষ চিকিৎসাধীন শ্রমিকটিও গত ১০ মে মারা যান।
এই কারখানাটিতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় ছাড়পত্র দেয়নি কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর। ছাড়পত্র ছাড়াই গত ছয়মাস ধরে কারখানাটিতে উৎপাদন কার্যক্রম চলছিল। কাজের সময় নিরাপত্তা সরঞ্জাম সরবরাহ না করার কথা জানান ওই কারখানার শ্রমিকরাও।
এর আগে ২০২১ সালের ২৫ অক্টোবর ফতুল্লার পাগলা এলাকায় সিএইচআরএম নামে কারখানার চুল্লিতে কাজ করার সময় বিস্ফোরণে পাঁচজন শ্রমিক মারা যান। ওই সময়ও কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের দাবি উঠেছিল। তবে তা নিশ্চিত করা যায়নি।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর বলছে, নিবন্ধনের তালিকা অনুযায়ী নারায়ণগঞ্জ জেলায় বর্তমানে চলমান স্টিল রি-রোলিং কারখানার সংখ্যা ৯০টি। তবে কারও মতে, এই সংখ্যা দুই শতাধিক।
এর মধ্যে মাত্র তিন-চারটি কারখানায় শ্রমিকদের নিরাপত্তার সরঞ্জাম ও পরিবেশ রয়েছে। বাকি সবগুলো কারখানাতেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুবই দুর্বল বলে জানান কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের জেলা কার্যালয়ের উপমহাপরিদর্শক রাজীব চন্দ্র দাস।
লোহা গলানোর এসব কারখানা উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হলেও শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয় না বলে অভিযোগ শ্রমিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের।
নারায়ণগঞ্জে আরআইসিএল কারখানায় যেদিন বিস্ফোরণ ঘটে, সেদিন ঢাকার শ্যামপুরের একটি স্টিল মিলে কাজ করতে গিয়ে আহত হন শ্রমিক জাকির হোসেন। তিনি থাকেন ফতুল্লার পাগলা এলাকায়। ব্যান্ডেজ করা পা নিয়ে খুড়িয়ে হাঁটছিলেন জাকির।
জাকির বলেন, “আমাদের সেইফটি জ্যাকেট তো দূরের কথা; ঠিকমতো বুটও (জুতা) পাই না। কোম্পানির কোনো চিন্তা নাই আমাদের নিয়া। হেলমেট না পাইয়া মাথায় গামছা বাইন্ধা কাজ করি। গায়ে মোটা জিন্সের কাপড় বাইন্ধা লই। ওইদিনও বুট পাই নাই কারখানায়। খালি পায়ে কাজ করার সময় পায়ে লোহা পড়ছে। লোহা ঠান্ডা ছিল কিন্তু যে ব্যথা পাইছি, তাতে ১৫ দিন কাজে যাইতে পারিনি। এমন ঘটনা প্রায় সময় হয় আমাদের।”
সরেজমিনে ফতুল্লার পিঠালীপুল এলাকার একটি স্টিল রি-রোলিং কারখানায় গিয়ে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সরঞ্জাম ছাড়াই কাজ করতে দেখা যায় শ্রমিকদের।
পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল, হাতে কাপড়ের তৈরি দস্তানা (গ্ল্যাভস), গায়ে সাধারণ টি শার্ট ও প্যান্ট এবং কোমড় বরাবর জিন্সের কয়েকটি কাপড় বেঁধে স্বয়ংক্রিয় মেশিনে লোহার পাত কাটতে দেখা যায় কয়েকজন শ্রমিককে।
কারখানাটির শ্রমিক আবু তাহের বলেন, “আমরা এমনেই কাজ করি। জ্যাকেট, হেলমেট ওইগুলা তো কাগজি কথাবার্তা। আমরা ফুল হাতার গেঞ্জি আর প্যান্ট পইড়াই কাজ করি। ভাট্টিতেও এমনেই কাজ করি। ওই মাঝে মাঝে পায়ে পরার লাইগা বুট দেয়। যেই বুট দেয় তা পরাও যায় না। সব রিজেক্ট মাল কই থেইক্কা জানি কিইন্না আনে। কতবার পায়ের নক কাটা পড়ছে। মাল তোলার সময় থোতাও (থুতনি) ফাটছে অনেকবার।”
ভাট্টিতে কাজ করা আরেক শ্রমিক উজ্জ্বল হোসেন বলেন, “জুতা আর গ্ল্যাভস ছাড়া আর কিছুই দিই না। এই কথা কারে বলমু? কেউ কি আমাগো মত গরিবের কথা চিন্তা করে? গত ১৫ বছরে ২০টা কারখানায় কাজ করছি। সবখানে একই অবস্থা।”
কথা বলতে বলতে আগের রাতে গরম লোহার ছ্যাঁকা লাগা পা দেখান মো. সুমন। তিনি বলেন, “এই আগুনের ছ্যাঁকা লাগা নতুন কিছু না। এইগুলা প্রতিদিনই লাগে।”
উচ্চঝুঁকি নিয়ে এসব কারখানায় কাজ করলেও মজুরি বোর্ড অনুযায়ী বেতন পান না বলে অভিযোগ শ্রমিকদের।
তারা জানান, সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরি ১০ হাজার ৬০০ টাকা হলেও ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকায় কাজ করেন এমন অনেক শ্রমিক রয়েছেন। তাদেরও মাসিক নয়, দৈনিক হিসেবে মজুরি দেওয়া হয়। মজুরি বাড়ানোর কথা বললে ছাঁটাই করা হয়। কারখানা থেকে নিয়োগপত্র বা পরিচয়পত্র না দেওয়ায় অবৈধ ছাঁটাইয়ের বিরুদ্ধে আইনগত প্রক্রিয়ায়ও যেতে পারেন না শ্রমিকরা।
নারায়ণগঞ্জের পাগলার রসুলপুরের বাসিন্দা চাঁন মিয়া জানান, তিনি কাজ করতেন শ্যামপুরের একটি কারখানায়। গত ডিসেম্বরে তাকে কারখানাটি থেকে ছাঁটাই করা হয়। তিনি পরে এক শ্রমিক নেতার পরামর্শে কদমতলী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। এরপর কারখানা কর্তৃপক্ষ তাকে পুনরায় কাজে যোগ দেওয়ার জন্য চিঠি দেয়। কিন্তু কারখানার গেইটে গেলে তাকে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়। পরে শ্রম আদালতে মামলার আবেদন করেন চাঁন মিয়া।
তিনি আরও বলেন, “নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র না থাকায় ফেব্রুয়ারিতে প্রথম মামলাটি নেয়নি শ্রম আদালত। পরে আমি মার্চে আবারও মামলার আবেদন করি। ওইটা আদালত গ্রহণ করছে। এখন অন্য কারখানায় কাজ করি কিন্তু মামলাটা চলমান আছে। আমাকে কোনো কারণ ছাড়াই ছাঁটাই করছে, আমি শ্রম আইন অনুযায়ী ন্যায্য পাওনার জন্য মামলাটা করছি। আমি চাই, এই মামলার কারণে হলেও স্টিল রি-রোলিং মিলগুলো নিয়মের মধ্যে আসুক।”
স্টিল রি-রোলিং মিলস শ্রমিক ফ্রন্টের নারায়ণগঞ্জ জেলার সাধারণ সম্পাদক এস এম কাদির বলেন, “বাংলাদেশের শ্রমিকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন রি-রোলিং ও স্টিল মিলের কারখানার শ্রমিকরা। কিন্তু এসব কারখানায় শ্রমিকদের ন্যূনতম নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা হয় না। সেইফটি ইক্যুইপমেন্ট না পেয়ে পুরান জিন্সের কাপড়, গামছা ব্যবহার করেন শ্রমিকরা। মালিকপক্ষ মুনাফার লোভে শ্রমিকদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার না করেই উৎপাদন কার্যক্রম চালান। এতে প্রায়সময় দুর্ঘটনা ঘটে এবং শ্রমিকরা প্রাণ হারান। এইসব কারখানায় কাজ করা ৯৫ শতাংশ শ্রমিকের কোনো না কোনো অঙ্গহানি হয়েছে। এমন কোনো শ্রমিক নেই যার গায়ে আগুনের ছ্যাঁকা লাগেনি।”
শ্রমিকদের নিরাপত্তার ব্যাপারে বারবার বললেও কর্তৃপক্ষ কর্ণপাত করেন না অভিযোগ করে এই শ্রমিক ইউনিয়ন নেতা বলেন, “তদারকি করার জন্য সরকারি যেসব সংস্থা আছে তারা আর্থিক সুবিধা নিয়ে কোনো ব্যবস্থা নেন না। প্রতিমাসে একবার কারখানায় পরিদর্শন করা দরকার। কিন্তু অসাধু সরকারি কর্মকর্তারা পরিদর্শনে গিয়ে টাকা নিয়ে পরে চুপ থাকেন। এমনকি কারখানার অধিকাংশ শ্রমিকের নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র দেওয়া হয় না। হতাহত হলে আইন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ পাওয়ারও সুযোগ থাকে না।”
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক রাজীব চন্দ্র দাস বলেন, “অধিকাংশ কারখানাতেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঠিকমতো থাকে না। নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র না দিয়ে আউটসোর্সিং হিসেবে কাজ করান। আমরা প্রায় সময় এসব কারখানা ভিজিট করে তাদের নোটিস দিই। নোটিসের পরও ব্যবস্থা না নিলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়।
“কিন্তু কারখানা কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে সব সময়ই উদাসীন। গত ৪ মে বিস্ফোরণ হওয়া আরআইসিএল নামে কারখানাটিতেও আমরা পিপিইর দুর্বলতা পেয়েছি। কারখানার শ্রমিকদেরও নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র পাইনি।”
নিজেদের জনবল সংকট এবং মালিকপক্ষ আইনের দুর্বল দিকগুলোর সুযোগ নেয় বলেও মনে করেন তিনি।
রাজীব দাস বলেন, “মামলা করার পর তা নিষ্পত্তি হতে এক থেকে দুই বছর সময় লাগে। দুই বছর পর ওই কারখানার মালিককে মাত্র দুই হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। অথচ পুরো প্রক্রিয়াটিতে যেতে অনেক সময় লাগতেছে। শুধুমাত্র সরকারি সংস্থার তদারকির ব্যাপার না, মালিকপক্ষকেও সচেতন হতে হবে। সমন্বিত উদ্যোগ না হলে দুর্ঘটনাও কমানো যাবে না, প্রাণহানিও না।”
বাংলাদেশ রি রোলিং মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিআরএমএ) সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান জুয়েলের ভাষ্য, “কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা ধাপে ধাপে বাড়ানোর ব্যাপারেও আমরা কাজ করছি। শ্রমিকদের নিয়োগপত্র ও মজুরির ব্যাপারেও কারখানা মালিকদের নিয়ে আমরা নিয়মিত বৈঠক করছি। কিছু কিছু জায়গায় ঘাটতি আছে। তবে সেসব সমাধানে সম্মিলিত উদ্যোগ নিচ্ছি।”