রজনীগন্ধা ডুবল কীভাবে?

ফেরিটিকে কোনো নৌযানের ধাক্কা দেওয়ার কথা জানেন না ডুবে যাওয়া ট্রাকের চালকরা। একাধিক জন দেখেছেন, ফেরিটির পেছনের দিকে একটি ঢাকনার নিচ দিয়ে পানি উঠেছে।

গোলাম মর্তুজা অন্তুমাহীদুল ইসলাম মাহীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Jan 2024, 02:07 PM
Updated : 17 Jan 2024, 02:07 PM

মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ঘাটের কাছে রজনীগন্ধা নামের ফেরিটি গাড়ি নিয়ে কেন ডুবে গেল, সেই প্রশ্নের সুনিশ্চিত জবাব পাওয়া যাচ্ছে না।

নৌ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী মালবাহী একটি ছোট জাহাজের ধাক্কার কথা বলছেন। তবে তা নাকচ করছেন ফেরিতে থাকা গাড়ির চালকরা। তাদের বক্তব্যে ফেরির পেছনের দিকে একটি গোল ঢাকনার মতো জায়গা দিয়ে নিচ থেকে পানি ওঠার কথা উঠে এসেছে।

চালকরা বলছেন, সেখানে অন্য কোনো নৌযানের ধাক্কার কোনো ঘটনা দেখেননি। বরং ধীরে ধীরে কাত হয়ে ফেরিটিকে ডুবতে দেখেছেন তারা।

ফেরি পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থা বিআইডব্লিউটিসির একজন পরিচালক বলেছেন, তারা তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। দুর্ঘটনার কারণ এখনই বলতে চান না। 

নারায়ণগঞ্জ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড শিপ বিল্ডার্স (এনইএস) থেকে তৈরি ফেরিটি ২০১৩ সালে বিআইডব্লিউটিসির বহরে যুক্ত হয়।

ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, অনেকক্ষণ ধরে ফেরিটিতে পানি উঠেছে। এ সময় ফেরি থেকে সাহায্য চেয়ে ঘাটে কোনো বার্তা দেওয়া হয়নি। লোকজনের চিৎকার শুনে কয়েকটি ট্রলার ফেরির কাছে গিয়ে লোকজনকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে।

কী বলেছেন প্রতিমন্ত্রী

সকালে নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কুয়াশার কারণে ফেরিটি নদীতে নোঙর করে ছিল। এ সময় মালবাহী একটি ছোট জাহাজের ধাক্কায় নোঙর করে থাকা ফেরিটি ডুবে যায়।”

ফেরি দুর্ঘটনার সময় অনেক ট্রাক চালক ঘুমিয়ে ছিলেন। পানি উঠে ফেরি কাত হয়ে যাওয়ার পর কর্মীরা চিৎকার-চেঁচামেচি করে সবাইকে নিজ দায়িত্বে নিরাপদ থাকার পরামর্শ দেন।

সরকারের সংস্থা বিআইডব্লিউটিসি হচ্ছে ফেরি পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত। আরেক সংস্থা বিআইডব্লিউটিএ ঘাট ও নৌ পরিবহনের বিষয়গুলো দেখভাল করে।

বিআইডব্লিউটিএ এর চেয়ারম্যান কমোডর আরিফ আহমেদ মোস্তফা জানান, “ফেরি ডুবে যাচ্ছে বা সেটি বিপদে পড়েছে এমন কোনো বার্তা ফেরি থেকে ঘাটে দেওয়া হয়নি। তবে ঘাটের লোকজনেরা চিৎকার শুনছিলেন। তবে সেই চিৎকার কীসের, কোন দিক থেকে আসছিল, তা কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। তখন অনেক কুয়াশা ছিল।” 

কারণ এখনই বলবে না বিআইডব্লিউটিসি

দুর্ঘটনার সংবাদে ফেরি দেখভালকরী সংস্থা বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান এ. কে. এম মতিউর রহমানসহ ঊর্ধ্বতনরা ঘাটে আসেন। তবে সকালের পর তারা আর তেমন কিছু বলছেন না।

ঘটনাটি কী করে ঘটল- এই প্রশ্নে বিআইডব্লিউটিসির পরিচালক (কমার্শিয়াল) আশিকুজ্জামান বলেন, এ বিষয়ে এখনই কিছু বলবেন না।

 “আমরা তদন্ত কমিটি করেছি। তদন্ত কমিটিগুলো কাজ করলে বোঝা যাবে কী করে ঘটনাটি ঘটল”, ঘাট সংলগ্ন বিআইডব্লিউটিসির ভাসমান কার্যালয়ে বেলা দুইটার দিকে বলেন তিনি।

ফেরির কর্মীরা কর্তৃপক্ষকে কী জানিয়েছেন- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “তারা তো সবাই অসুস্থ, বিপর্যস্ত। এখনো ভালো করে কিছুই বলতে পারছেন না।”

এই কর্মকর্তার তথ্য বলছে, ফেরিতে ১৫ জন কর্মী ছিলেন। তার মধ্যে সহকারী মাস্টার হুমায়ুন কবির নিখোঁজ রয়েছেন।

ফেরির মাস্টার এখন কোথায় জানতে চাইলে আশিকুজ্জামান জবাব দেননি।

পাশ থেকে বিআইডব্লিউটিসি শ্রমিক নেতা (এখন অবসরে) ফয়েজুর রহমান বলেন, “মাস্টারের নাম মেহের আলী। তিনি অনেক সিনিয়র, ৫০-৫২ বছর বয়স হবে। পানিতে ডুবে শীতের অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এজন্য তাকে বাসায় পাঠানো হয়েছে। অন্য কর্মীরাও আর কেউ কথা বলার মতো অবস্থায় নেই।” 

‘যে নাওটা ধাক্কা মারিল, সেডা কই?’

ট্রাক চালক আশিক শেখ বলছেন, গত রাত একটার দিকে তিনি দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে তুলা ভর্তি ট্রাকটি তোলেন। কিছুক্ষণ চলার পরই ফেরিটি ঝাঁকি দেয়। তখন তিনি সহকারীকে খোঁজ নিতে পাঠান। সহকারী ফেরির কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এসে জানান, ‘ফেরি রাতে আর যাবে না।’

কর্মীরা ঘুমিয়ে থাকতে বলার পর আশিক শেখ ট্রাকে উঠে দরজা জানলা আটকে ঘুমিয়ে পড়েন। সকালে ফেরির কর্মীদের চিৎকারেই তাদের ঘুম ভাঙে।

তারা চিৎকার করছিলেন, ‘ফেরি ডুইবে যাচ্ছে, যে যেমনে পারেন সেইভ হন।’

এরপর ফেরির কিছু কর্মীকে ফোলানো টায়ার বা বয়া নিয়ে পানিতে ভাসতে দেখেন আশিক শেখ।

ক্ষুব্ধ কণ্ঠে তিনি বলেন, “আমরা ফেরিতে গাড়িটা তুলছি তাদের ভরসায়। তারা আমাদের রাইখে পানিতে নেমে গেল। আমি আধঘণ্টা পানিতে যুদ্ধ করছি। পরে একটা ট্রলার আইসে আমারে তুলছে।

“এখন ঘাটে আইসে শুনছি, ফেরিতে নাকি বাল্কহেড ধাক্কা মারিছে। আমার কথা হচ্ছে, যেই নাওটা ধাক্কা মারিল, সেডা কই। আমার তো মনে হয় ফেরি নিজে থেকেই পানি উঠে ডুইবে গেছে।”

‘ফেরির পেছন দিয়ে পানি উঠেছে’

আরেক ট্রাক চালক মো. সাজ্জাদ ভাঙ্গারি মালামাল নিয়ে কুষ্টিয়া থেকে যাচ্ছিলেন নারায়ণগঞ্জের কাচপুর। তিনিও বলছেন, ধাক্কা মারার কোনো ঘটনা দেখেননি।

তিনি বলেন, তার গাড়ির ডান পাশের পাঠাতনে একটি গোল ঢাকনা ছিল। সেটি দিয়ে পানি উঠছিল।

একই কথা জানান বোয়ালমারির চামড়া বেপারী শহিদুল ইসলাম। তিনিসহ পাঁচজন ছিলেন একটি ট্রাকের উপরে। প্রায় ১১ লাখ টাকার চামড়া নিয়ে তারা সাভারের হেমায়েতপুরের দিকে আসছিলেন।

শহিদুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সকালে ঘুম ভেঙে দেখি ৬টা ৬ মিনিট। আমরা এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করতে গিয়ে দেখি ফেরির পেছনে ম্যানহোলের মত ঢাকনা থেকে পানি উঠছে।”

তিনি জানান, এটি দেখতে পেয়ে কয়েকজন ফেরির স্টাফদের ডাকাডাকি শুরু করেন। কিন্তু কেউ আসেননি। কিছুক্ষণ পর বয়স্ক একজন লোক আসেন। তাকে শহিদুল বলেন, ‘পানি উঠতিছে, আপনারা দেখেন।’

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সেই লোক তখন আরেকটা ছেলেরে পাঠাইল। এরপর উপর থেকে মুরুব্বি গোছের লোকটা বলল, ‘নোঙর তোল, ফেরি স্টার্ট দে’।”

শহিদুলের ভাষ্য, ততক্ষণে ফেরিতে পানি উঠতে শুরু করে এবং সেটি ধীরে ধীরে কাত হয়ে যাচ্ছিল। এক পর্যায়ে তিনি ও তার সহযোগীরা রেলিং ধরে ঝুলতে থাকেন। ফেরিটি ডুবতে শুরু করলে তারা একটি বয়া ধরে পানিতে লাফ দেন।

"পরে ফেরির লোকজন কইতেছে, অন্য জাহাজ নাকি আইসে ঘাই মারছে। আমরা ছিলাম, আমরা দেখছি এ রকম কিছুই হয় নাই", বলেন তিনি।

প্রত্যক্ষদর্শী রিয়াজ উদ্দিন বলেন, যখন তারা ফেরি থেকে তাড়াহুড়া করে নেমে যাচ্ছিলেন, সে সময় সহকারী মাস্টার মোবাইল বা জরুরি কোনো কিছু আনতে ফেরির ভেতরে ঢোকেন। এ সময়েই নৌযানটি কাত হয়ে উল্টে পড়ে।

ফেরি উদ্ধারে ঘটনাস্থলে পাঠানো হয় উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তমকে। বিকেল ৪টা পর্যন্ত একটি ট্রাক উদ্ধারের কথা জানিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ।