টিফিনের টাকা জমিয়ে কেনা হতো গানের অডিও ক্যাসেট। এইভাবে একদিন স্কুল শেষে ঘরে ফেরার পথে অডিও অ্যালবামের দোকানে একটি অডিও ক্যাসেটের প্রচ্ছদে চোখ পড়ে তাকাহাশি ওতানাবের।
খাবারের থালা সামনে নিয়ে বসা রুগ্ন শিশুর এই অ্যালবামে গায়ে লেখা ছিল ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। অডিও প্লেয়ার বাজার সময় জর্জ হ্যারিসনের ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ গানটি কতোবার শোনা হয়েছে তার কোন হিসেব নেই তাকাহাশির।
পরের দিন বন্ধু মহলে এই অ্যালবামটি নিয়ে কথা বলেন তিনি।
স্মৃতিচারণ শুনছিলাম জাপানের নাগরিক তাকাহাশি ওতানাবের মুখ থেকেই। এ মাসের ১২ তারিখ ছিল শুক্রবার। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে বার্ষিক জেঙ্গিস (চেঙ্গিস) খান পার্টির আয়োজন করা হয়েছিল। দুইশরও বেশি অতিথিদের জন্য আয়োজক ছিল আমার ল্যাব।
সেখানে পরিচয় হয় তাকাহাশির সাথে। বার্বিকিউ পার্টিতে কথাচ্ছলে তাকাহাশি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, আমি কোন দেশ থেকে জাপানে এসেছি?
আমি বললাম, বাংলাদেশ। তখন তাকাহাশি একটু উঁচু গলায় বলে উঠলেন, বাংলাদেশ!
ভদ্রলোকের কৌতুহলী জিজ্ঞাসায় আমি বললাম, বাংলাদেশ চেনেন? কখনো গিয়েছেন বুঝি?
এরপর তাকাহাশি শুরু করলেন ১৯৭১ সালের কথা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কথা একজন বিদেশির মুখে শুনতে গর্বে বুকটা ফুলে ওঠে।
যুক্তরাষ্ট্রের এক লেজার কোম্পানিতে চাকরিরত তাকাহাশি বললেন, “আমি তখন তরুণ ছিলাম। গান পাগল হওয়ায় অডিও ক্যাসেট কিনতাম অনেক।“
কেবল তোমাদের দেশকে সহযোগিতা করার জন্য আমরা বন্ধুরা মিলে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ এর একটি অডিও অ্যালবাম কিনেছিলাম।
আমি তাকাহাশিকে বললাম, সেই সময় জাপানে কি জর্জ হ্যারিসন জনপ্রিয় ছিলেন নাকি?
উত্তরে উনি বললেন, “আসলে আমি যুক্তরাষ্ট্রের গান পছন্দ করতাম। অনেক জাপানি সেই সময় আমেরিকান পপকে খুব ভালোবাসতো। জর্জ হ্যারিসন তালিকায় অনেক উপরে ছিলেন।”
“ওই অ্যালবামটি আমার অনেক ভাল লেগেছিল। আমি সত্যি আনন্দিত যে, সেদিন যে বাংলাদেশকে মনের গহীন থেকে ভালোবাসা জন্ম নিয়েছিল, সেই বাংলাদেশ আজ অনেক দূর এগিয়ে।“
কথাগুলো শোনার পর শ্রদ্ধায় আমার মাথা নুয়ে এলো।
১৯৭১ সালের ১ অগাস্ট নিউ ইয়র্ক শহরের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ হতে সংগৃহীত আড়াই লাখ মার্কিন ডলার বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের যে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন জর্জ হ্যারিসন তা দুনিয়ার কতজন গায়ক তা পেরেছিলেন?
কনসার্টের টিকেট, ক্যাসেট হতে প্রাপ্ত সমস্ত অর্থ ইউনিসেফের ফান্ডের মাধ্যমে যে বাংলাদেশে পাঠানো হবে তা নাকি ওই অডিও অ্যালবামের গায়ে লেখা ছিল।
তাকাহাশির সাথে পরিচয় না হলে ঠিক বুঝতে পারতাম না জর্জ হ্যারিসনরা কীভাবে জাপানিদের কাছে বাংলাদেশকে তুলে ধরেছিলেন।