ভোটের ফল চ্যালেঞ্জ নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে ৭৪ জনের মামলা

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল চ্যালেঞ্জ করে হাই কোর্টে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছেন বিএনপি, গণফোরাম ও প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দলের (পিডিপি) ৭৪ জন পরাজিত প্রার্থী।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Feb 2019, 04:12 PM
Updated : 14 Feb 2019, 04:12 PM

গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে ‘জাল ভোট’ দেওয়া, এজেন্টদের ‘বের করে দেওয়া’, ‘একতরফা ভোট’ দেওয়া, ‘কারচুপি’ ও ভোট ‘ডাকাতির’ অভিযোগ আনা হয়েছে।

প্রত্যেক আবেদনকারী নিজের নির্বাচনী আসনের অন্য প্রার্থীদের বিবাদী করে তাদের প্রতি নোটিস জারির পাশাপাশি সাক্ষীদের তলবের আরজি জানিয়েছেন।

সেই সঙ্গে নিজ নিজ নির্বাচনী আসনের বিজয়ী প্রার্থীদের সংসদ সদস্য পদ এবং ওই সংসদীয় আসনের নির্বাচন বাতিলের আবেদন করেছেন তারা। 

গত সোমবার থেকে এ পর্যন্ত মোট ৭৪ জন পরাজিত প্রার্থী নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে আবেদন করলেও হাই কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে ৬৬ জনের তালিকা পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে চারজন গণফোরামের, একজন পিডিপির, বাকি সবাই বিএনপির পরাজিত প্রার্থী।  

গণফোরামের চারজন হলেন- সুব্রত চৌধুরী (ঢাকা-৬) ও মফিজুল ইসলাম খান কামাল (মানিকগঞ্জ-৩), আব্দুল মোমেন চৌধুরী (চট্টগ্রাম-১৫) ও মোস্তফা মহসীন মন্টু, (ঢাকা-৭)।আর পিডিপির প্রার্থী সাব্বির আহমেদ (রংপুর-৩)।

মামলাকারী বিএনপির প্রার্থীরা হলেন- মেজর জেনারেল আ আ ম স আমিন (কুড়িগ্রাম-২), সাইফুল ইসলাম ফিরোজ (ঝিনাইদহ-৪), আবুল কালাম আজাদ সিদ্দিকী (টাঙ্গাইল-৭), জয়নুল আবেদীন (বরিশাল-৩), রুমানা মাহমুদ (সিরাজগঞ্জ-২), জহির উদ্দিন স্বপন (বরিশাল-১), শাহ রিয়াজুল হান্নান (গাজিপুর-৪), নাসের রহমান (মৌলভিবাজার-৩), আব্দুল হাই (মন্সিগঞ্জ-৩), হাফিজ ইব্রাহিম (ভোলা-২), রুহুল আমিন দুলাল (পিরোজপুর-৩)।

ডা. দেওয়ান মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন (ঢাকা-১৯), হাফিজ উদ্দিন আহমেদ (ভোলা-৩), তাজভীর উল আলম (কুড়িগ্রাম-৩), মো. সাইফুল ইসলাম (রংপুর-৬), মো. সাদেক রিয়াজ (দিনাজপুর-২), নজরুল ইসলাম আজাদ (নারায়ণগঞ্জ-২), মইনুল ইসলাম খান শান্ত (মানিকগঞ্জ-২), ইরফান ইবনে আমান অমি (ঢাকা-২), নবিউল্লাহ নবী (ঢাকা-৫), আমরাফ উদ্দিন (নরসিংদী-৫), মো. আমিরুল ইসলাম খান (সিরাগঞ্জ-৫), শহিদুল ইসলাম (টাঙ্গাইল-১), ফরহাদ হোসেন আজাদ (পঞ্চগড়-২), মো. হাসান রাজিব প্রধানও (লালমনিরহাট-১) মামলা করেছেন নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে।

মামলাকারীদের মধ্যে আরও আছেন মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী (চট্টগ্রাম-১৬), মো. আখতারুজ্জামান মিয়া (দিনাজপুর-৪), মো. শাহজাহান মিয়া (চাঁপাইনবাবগঞ্চ-১), মিজানুর রহমান (সুনামগঞ্জ-৫), মো. জি কে গউছ (হবিগঞ্জ-৩), মজিবুর রহমান চৌধুরী (মৌলভিবাজার-৪), ফারুখ আলম সরকার (গাইবান্ধা-৫), শফি আহমেদ চৌধুরী (সিলেট-৩), মো. আনোয়রুল হক (নেত্রকোনা-২), শাহ মো. ওয়ারেস আলী (জামালপুর-৫), নিতাই রায় চৌধুরী (মাগুরা-২) ও অনিন্দ্য ইসলাম অমিত (যশোর-৩)।

এছাড়া মো. আবু সুফিয়ান (চট্টগ্রাম-৮), মাসুদ অরুণ (মেহেরপুর-১), আমিন উর রশিদ (কুমিল্লা-৬), এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন (নোয়াখালী-১), শহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া (খাগড়াছড়ি), মুন্সী রফিকুল আলম (ফেনী-১), জয়নাল আবদীন ফারুখ (নোয়াখালী-২), সাচিং প্রু (বান্দরবান) শেখ ফরিদ আহমেদ মানিক (চাঁদপুর-৩), আবুল খায়ের ভূঁইয়া (লক্ষীপুর-২), জাকির হোসেন সরকার (কুষ্টিয়া-৩), রকিবুল ইসলাম (খুলনা-৩), শামা ওবায়েদ ইসলাম (ফরিদপুর-২), আনিসুর রহমান (মাদারীপুর-৩), আজিজুল বারি হেলাল (খুলনা-৪), শাহ মো. আবু জাফর (ফরিদপুর-১), মো. শরিফুজ্জামান (চুয়াডাঙা-১), হাবিবুল ইসলাম হাবিব (সাতক্ষিরা-১), আলী নেওয়াজ মো. খৈয়ুম (রাজবাড়ী-১), রুমানা মাহমুদ (সিরাজগঞ্জ-২), আকবর হোসেন (ফেনী-৩), বরকত উল্লাহ বুলু (নোয়াখালী-৩) ও আসমা আমিন (কুড়িগ্রাম-২) মামলা করেছেন।

৩০ ডিসেম্বরের ভোটে ২৫৭টি আসনে জয় পেয়ে টানা তৃতীয়বারের মত সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। জোটগতভাবে তাদের আসন সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৮৮টি।

অন্যদিকে বিএনপিকে নিয়ে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট পেয়েছে মাত্র আটটি আসন। নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে আবার নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে তারা। 

আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপিকে সংসদে এসে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানালেও তাদের নির্বাচিতরা এখনও সাংসদ হিসেবে শপথ নেননি। 

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতারা নির্বাচনের তিন দিন পর তাদের প্রার্থীদের ঢাকায় ডেকে ভোটের দিনের অভিজ্ঞতা শোনেন। তখনই নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে মামলা করার সিদ্ধান্ত জানানো হয়।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৪৯ ধারা অনুযায়ী নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নাম, ঠিকানাসহ গেজেট জারির ৪৫ দিনের মধ্যে নির্বাচনী অনিয়মের বিষয়ে হাই কোর্টে আবেদন করার সুযোগ রয়েছে।

নির্বাচন কমিশন গত ২ জনুয়ারি সংসদ সদস্যদের নাম, ঠিকানাসহ গেজেট প্রকাশ করে। সে হিসাবে ৪৫ দিন শেষ হওয়ার কথা শুক্রবার। কিন্তু সেদিন সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় বৃহস্পতিবারই ছিল আবেদন করার জন্য কার্যত শেষ দিন।

ঢাকা-৬ আসনের গণফোরামের প্রার্থী ও দলটির নির্বাহী সভাপতি সুব্রত চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার জানা মতে এখন পর্যন্ত আমিসহ গণফোরামের চারজন প্রার্থী ট্রাইব্যুনালে আবেদন করেছেন। বাকিরা করবেন কিনা জানি না। তবে আমার মাধ্যমে বিএনপির দুজন প্রার্থী আবেদন করেছেন।”

সাপ্তাহিক ছুটির কারণে এক দিন কম পাওয়ায় রোববারও এ আবেদন করার সুযোগ পাওয়া যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

অবেদনে কী বলা হয়েছে জানতে চাইলে সুব্রত চৌধুরী বলেন, “ভোট ডাকাতি, জালিয়াতি করে যে নির্বাচিত করা হয়েছে, সেটিকে চ্যালেঞ্জ করে নির্বাচিত প্রার্থীর ফল বাতিল ঘোষণা করে আমাকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হোক। তা না হলে বিকল্প আরজি হচ্ছে, নির্বাচনটিই বাতিল করা হোক।”

নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের আবেদন নিষ্পত্তির জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে আইনজীবীদের একটি প্যানেল গঠন করে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও বরিশাল-৩ আসনের প্ররাজিত প্রার্থী জয়নুল আবেদীন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমাদের নির্বাচনী বিষয়গুলো দেখার জন্য একেক বিভাগে একেক জন আইনজীবীকে দায়িত্ব দিয়ে একটি প্যানেল গঠন করা হয়েছে।”

বরিশাল বিভাগের জন্য জয়নুল আবেদীন নিজে, ঢাকা বিভাগের জন্য রুহুল কুদ্দুস কাজল, রাজশাহী বিভাগের জন্য আমিনুল হক, চট্টগ্রামে মীর মো. নাসিরুদ্দিন, রংপুর বিভাগের জন্য নওশাদ জামির, কিশোরগঞ্জ-ময়মনসিংহে ফজলুর রহমান, খুলনা ও ফরিদপুরের জন্য নিতাই রায় চৌধুরীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নেতা জয়নুল বলেন, “মূলত ইলেকশনে যে করাপশন হয়েছে সেগুলো চ্যালেঞ্জ করে এবং নির্বাচন বাতিল চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। আজকে পর্যন্ত অর্ধশতাধিক প্রার্থী আবেদন করেছেন। আগামীকাল ৪৫ দিন শেষ হচ্ছে। কিন্তু শুক্রবার বন্ধের দিন হওয়ায় রোববারও আমরা আবেদনের সুযোগ পাব।”

নির্বাচন সংক্রান্ত এসব আবেদন নিষ্পত্তি করতে সময়ের কোনো বাধ্যবাধকতা আছে কিনা জানতে চাইলে জয়নুল আবেদীন বলেন, “বলা আছে ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে।”

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অভিযোগের শুনানি হবে হাই কোর্টের ছয়টি একক বেঞ্চে। প্রধান বিচারপতি এসব বেঞ্চ গঠন করে দিয়েছেন বলে সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগের বিশেষ কর্মকর্তা সাইফুর রহমান জানিয়েছেন।

বিচারপতি সৌমেন্দ্র সরকার, বিচারপতি মো. রেজাউল হাসান, বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হক, বিচারপতি মো. খসরুজ্জামান, বিচারপতি মাহমুদুল হক ও বিচারপতি কাশেফা হোসেন এই ছয় বেঞ্চের দায়িত্বে রয়েছেন।