সঙ্গীদের মধ্যে জামায়াত নেতাদের ওপরই ভরসা বিএনপির

নির্বাচন ঘিরে দাবি-দাওয়া তুলে ধরার ক্ষেত্রে গণফোরামের কামাল হোসেন সামনে থাকলেও ভোটের লড়াইয়ে পার পেতে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের ওপরই সবচেয়ে বেশি ভরসা রাখল প্রধান বিরোধী দলটি।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Dec 2018, 09:41 PM
Updated : 8 Dec 2018, 10:10 PM

একাত্তরে যুদ্ধাপরাধে জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের অধিকাংশের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলেও এই দলের ১৭ জন নেতার এবার ধানের শীষ প্রতীকে জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে। এর বাইরে আরও কয়েকটি আসন তাদের ভাগে জুটছে বলে জামায়াত নেতাদের কথায় উঠে এসেছে।

অপরদিকে কামাল হোসেন নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক দলগুলো নির্বাচনে ১৯টি আসনে বিএনপির চূড়ান্ত মনোনয়ন পেয়েছে। আরও দুয়েকটি আসন নিয়ে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে তাদের দর কষাকষি চলছে।

আগের দিন বিএনপির ২০৬ জন প্রার্থীকে চূড়ান্ত মনোনয়ন দেওয়ার পর শনিবার দলের আরও ১৪ জন নেতাকে মনোনয়নের চিঠি দেওয়া হয়েছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা দিনভর গুলশান কার্যালয়ে ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে আসন ভাগাভাগি করেন।

ঐক্যফ্রন্টকে ১৯টি আসন দেওয়ার পাশাপাশি জামায়াত বাদে ২০ দলীয় জোটের অন্য শরিক দলগুলোকে ১৭টি আসন ছাড়ছে বিএনপি। এদের মধ্যে বিজেপি একটি, খেলাফত মজলিশ দুটি, এলডিপি পাঁচটি, জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) দুটি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম চারটি, এনপিপি একটি, লেবার পার্টি একটি ও পিপিবিকে একটি আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক দলগুলোর মধ্যে কামাল হোসেন নেতৃত্বাধীন গণফোরামকে পাঁচটি, আ স ম আব্দুর রব নেতৃত্বাধীন জেএসডিকে পাঁচটি, মাহমুদুর রহমান মান্না নেতৃত্বাধীন নাগরিক ঐক্যকে পাঁচটি এবং কাদের সিদ্দিকী নেতৃত্বাধীন কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগকে তিনটি আসন দেওয়া হয়েছে।

এর বাইরে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সুলতান মো. মনুসর আহমেদকে ধানের শীষের টিকেট দেওয়া হয়েছে। সাবেক এই আওয়ামী লীগ নেতা মৌলভীবাজারের একটি আসন থেকে বিএনপির সমর্থন নিয়ে সংসদে যাওয়ার লড়াইয়ে থাকছেন।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা সবাই ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে এই নির্বাচনে লড়বেন।এলডিপির অলি আহমেদ ছাড়া ২০ দলীয় জোটের অন্যান্য প্রার্থীরাও বিএনপির প্রতীকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন হারানো জামায়াত নেতারাও ধানের শীষের প্রত্যয়ন নিয়েই মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন।

কামাল হোসেন নেতৃত্বাধীন গণফোরামের মোস্তফা মহসিন মন্টুকে ঢাকা-৭ আসনে মনোনয়ন দিয়েছে বিএনপি। এছাড়া দলটির নেতাদের মধ্যে এ এইচ এম খালেকুজ্জামানকে ময়মনসিংহ-৮ আসনে, আমসা আমিনকে কুড়িগ্রাম-২ আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের সাবেক অর্থমন্ত্রী প্রয়াত শাহ এ এম এস কিবরিয়ার ছেলে রেজা কিবরিয়া কয়েক দিন আগে এই দলে ভিড়ে হবিগঞ্জ-১ আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন।একইভাবে সম্প্রতি আওয়ামী লীগ ছেড়ে আসা অধ্যাপক আবু সাঈয়িদকেও পাবনা-১ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী করা হচ্ছে।

এদের বাইরে ঢাকা-৬ আসনে গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরীকে মনোনয়ন দেওয়ার জন্য বিএনপি নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় আছেন দলটির নেতারা। তবে ওই আসনে ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার ছেলে ইশরাক হোসেনও প্রার্থী থাকায় বিষয়টি নিয়ে এখনও সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি বিএনপি নেতারা।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সামনের কাতারের আরেক নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না বগুড়া-২ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী হচ্ছেন। তার দল নাগরিক ঐক্যেরও নিবন্ধন নেই নির্বাচন কমিশনে। এই দলের নেতা এস এম আকরাম নারায়ণগঞ্জ-৫, শাহ রহমত উল্লাহ রংপুর-১, মোফাখারুল ইসলাম রংপুর-৫ এবং নুরুর রহমান জাহাঙ্গীর বরিশাল-৪ আসনে ধানের শীষ নিয়ে ভোটের লড়াইয়ে যাচ্ছেন।

ঐক্যফ্রন্টের শরিক জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব ধানের প্রার্থী হচ্ছেন লক্ষ্মীপুর-৪ আসনে। তার দলের নেতা আবদুল মালেক রতন কুমিল্লা-৪, শহিদউদ্দিন মাহমুদ স্বপন ঢাকা-১৮, সাইফুল ইসলাম কিশোরগঞ্জ-৩ এবং নুরুল ইসলাম শরীয়পুর-১ আসনে বিএনপির চূড়ান্ত মনোনয়ন পেয়েছেন।

কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকী ঋণ খেলাপের দায়ে নির্বাচনের অযোগ্য হলেও তার মেয়ে কুঁড়ি সিদ্দিকীকে টাঙ্গাইল-৮ আসনে প্রার্থী করছে বিএনপি। এছাড়া দলটির নেতা রফিকুল ইসলাম টাঙ্গাইল-৪ আসনে এবং ইকবাল সিদ্দিকী গাজীপুর-৩ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী হচ্ছেন।

এই জোটের শরিক জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সুলতান মো. মনুসর আহমেদ ধানের শীষ নিয়ে লড়বেন মৌলভীবাজার-২ আসনে।

২০ দলীয় জোটের শরিকরা কে কোথায়

রাজধানীর অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত ঢাকা-১৭ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী হচ্ছেন বিজেপির আন্দালিব রহমান পার্থ। এখানে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন চিত্রনায়ক আকবার হোসেন পাঠান ফারুক। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদও এই আসনে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন।

এলডিপির অলি আহমেদ চট্টগ্রাম- ১৪ আসনে নিজের দলীয় প্রতীক ‘ছাতা’ নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। তার দলের নেতাদের মধ্যে মো. নুরুল আলমকে চট্টগ্রাম-৭ আসনে, রেদোয়ান আহমেদকে কুমিল্লা-৭ আসনে, সাহাদাত হোসেন সেলিমকে লক্ষ্মীপুর-১ আসনে এবং সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদকে ময়মনসিংহ-১০ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী করছে বিএনপি।

কল্যাণ পার্টির সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম ধানের শীষ নিয়ে লড়বেন চট্টগ্রাম- ৫ আসনে।এনপিপির ফরিদুজ্জামান ফরহাদ নড়াইল-২ আসনে, পিপিবির রিটা রহমান রংপুর-৩ আসনে, খেলাফত মজলিশের আহমেদ আবদুল কাদের হবিগঞ্জ-৪ আসনে এবং মুফতি মুনির হোসেন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী হচ্ছেন।

জমিয়তে উলামায়ে ইসলামীর শাহিনুর. পাশা সুনামগঞ্জ-৩ আসনে, আবদুল বাসিদ আজাদ হবিগঞ্জ-২ আসনে, মাওলানা ওবায়দুল্লাহ ফারুক সিলেট-৫ আসনে এবং মুফতি মোহাম্মদ ওয়াক্কাস যশোর-৫ আসনে ধানের শীষ নিয়ে লড়বেন।

জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) টিআই ফজলে রাব্বী গাইবান্ধা-৩ আসনে এবং আহসান হাবিব লিংকনকে কুষ্টিয়া-২ আসনে মনোনয়ন দিয়েছে বিএনপি। লেবার পার্টির মুস্তাফিজুর রহমান ইরান পিরোজপুর-২ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী হচ্ছেন।

জামায়াত ইসলামীর নেতাদের কতটি আসন দেওয়া হচ্ছে সে বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে এখনো কোনো কিছু বলা হয়নি। তবে জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, ২৪টি আসন চাইছেন তারা, যার মধ্যে ১৭টির বিষয়ে নিশ্চিত করা হয়েছে।

জামায়াত নেতাদের মধ্যে দলটির সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান ঢাকা-১৫ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী হচ্ছেন।দলটির অন্য নেতাদের মধ্যে রফিকুল ইসলাম খানকে সিরাজগঞ্জ-৪ আসনে, আবুল কালাম আজাদকে খুলনা-৬ আসনে, মিয়া গোলাম পারোয়ারকে খুলনা-৫ আসনে, সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরকে কুমিল্লা-১১ আসনে, শামসুল ইসলামকে চট্টগ্রাম-৭ আসনে, হামিদুর রহমান আযাদকে কক্সাবাজার-২ আসনে, ইকবাল হোসাইনকে পাবনা-৫ আসনে, আবু সাঈদ মো. শাহাদাত হোসাইনকে যশোর-২ আসনে, আবদুল হাকিমকে ঠাকুরগাঁও-২ আসনে, আবু হানিফকে দিনাজপুর-১ আসনে, আনোয়ারুল ইসলামকে দিনাজপুর-৬ আসনে, আজিজুল ইসলামকে নীলফামারী-৩ আসনে, মাজেদুর রহমানকে গাইবান্ধা-১ আসনে, মুহাদ্দিস আবদুল খালেককে সাতক্ষীরা-২ আসনে, গাজী নজরুল ইসলামকে সাতক্ষীরা-৪ আসনে এবং শামীম সাঈদীকে পিরোজপুর-১ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী করছে বিএনপি।

এর বাইরে বাগেরহাটের দুটি আসনেও জামায়াত নেতারা বিএনপির মনোনয়ন পাচ্ছেন বলে শোনা গেলেও কোনো পক্ষ থেকে তা নিশ্চিত করা হয়নি।

জামায়াতসহ ২০ দলকে কতটি আসন ছাড়া হয়েছে জানতে চাইলে জোটের সমন্বয়ক বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম খান শনিবার রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আসন ভাগাভাগির আলোচনা চলছে, শেষ না হলে বলাটা ঠিক হবে না।”

অপরদিকে গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু রাতে গুলশানের কার্যালয় থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে সাংবাদিকদের বলেন, “আসন বণ্টন নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো সমস্যা নেই। আমরা বলেছি, যারা জনপ্রিয় ও যোগ্য তাদেরকেই আসন দেওয়া হোক।

“আমরা ১০/১২টা আসন চেয়েছি। এখন কতটা দেবে সেটা বিএনপির ওপর ছেড়ে দিয়েছি। কালকে ভোরে এসে আমরা চিঠিগুলো নিয়ে যাব।”

সর্বশেষ ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ২৫৯টি আসনে দলীয় প্রার্থী দেয়।ওই নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীসহ চারদলীয় জোটের শরিকদের ৪১টি আসন ছেড়েছিল তারা।

তার আগে ২০০১ সালে জামায়াতসহ চারদলীয় জোট করে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল বিএনপি। সেই সরকারের মন্ত্রিসভায় জামায়াতের দুই নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে রেখেছিলেন খালেদা জিয়া।

দুর্নীতি মামলায় সাজা নিয়ে এখন কারাগারে বন্দি আছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা। অপরদিকে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলতে হয়েছে নিজামী-মুজাহিদকে। 

দলীয় ২২০ জন এবং দুই জোট মিলিয়ে এখন পর্যন্ত বিএনপির মনোনয়ন চূড়ান্ত হয়েছে ২৭৩ আসনে। রোববার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন থাকায় ওই দিনের মধ্যে বাকি আসনগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাতে হবে তাদের।