সংলাপের আহ্বান জানিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের চিঠি পাওয়ার পরদিন সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে একথা জানিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
তিনি বলেছেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনের পূর্বক্ষণে কোনো চাপের মুখে এই সংলাপ হচ্ছে না এবং তারা কোনো পূর্বশর্তও দিচ্ছেন না। তফসিলের আগেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের সঙ্গে সংলাপে বসবেন তারা।
কাদের বলেন, “আমরা কারও চাপের মুখে নতি স্বীকার করিনি। আমাদের পক্ষ থেকে আমরা কাউকে সংলাপে ডাকিনি। তারা সংলাপ করতে চান, ঐক্যফ্রন্ট নেতারা। সংলাপের দরজা সবার জন্য খোলা। আমরা ঐক্যফ্রন্টের প্রস্তাবে সম্মত।”
অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতার বিষয়টি তুলে ধরে মন্ত্রী কাদের বলেন, “শেখ হাসিনার দরজা কারো জন্য বন্ধ হয় নাই, বন্ধ থাকে না। এর মধ্য দিয়ে আপনারা বুঝতে পারছেন যে আমরা আমাদের নেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রস্তাবে সম্মত। আমরা সবাই এ ব্যাপারে নেত্রীর সঙ্গে একমত যে আমরা ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের সঙ্গে সংলাপে বসব।”
কাদেরের এই সংবাদ সম্মেলনের পরপরই মতিঝিলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদের চেম্বারে বৈঠকে বসেন ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্যরা। তারা সরকারের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। সংলাপের আহ্বানে সাড়া পেয়ে তারা ইসির কাছে যাওয়ার পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি বাতিলও করেছে।
এই বৈঠক চলার মধ্যেই কামাল হোসেনের দল গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসীন মন্টুকে টেলিফোন করে সংলাপের আমন্ত্রণ জানান ওবায়দুল কাদের।
গণভবনে এই সংলাপের আমন্ত্রণ জানিয়ে মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিক চিঠি দেওয়ার কথা মন্টুকে বলেছেন কাদের। আগামী বৃহস্পতিবার এই বৈঠক হবে বলে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
দশম সংসদ নির্বাচন বর্জনকারী বিএনপি ২০১৪ সালের ওই নির্বাচনের পর থেকেই সংলাপের আহ্বান জানিয়ে আসছিল। কিন্তু তার কোনো প্রয়োজন দেখছিল না আওয়ামী লীগ।
দশম সংসদ নির্বাচনের আগে আলোচনার জন্য বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করে শেখ হাসিনার প্রত্যাখ্যাত হওয়ার কথাও বলে আসছিলেন আওয়ামী লীগের নেতারা।
দুর্নীতির মামলায় দণ্ড নিয়ে খালেদা জিয়া কারাবন্দি হওয়া এবং গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার মামলায় খালেদার ছেলে তারেক রহমান দোষি সাব্যস্ত হওয়ার পর ‘খুনিদের’ সঙ্গে সংলাপে না বসার কথা আরও জোর গলায় বলছিলেন আওয়ামী লীগ নেতারা।
এদিকে আওয়ামী লীগকে নত করতে ব্যর্থ বিএনপি গত ১৩ অক্টোবর গণফোরাম সভাপতি কামালের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়ে ৭ দফা দাবি তুলে তা নিয়ে নতুন করে সংলাপের আহ্বান জানায়।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাত দফায় খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়ে সংসদ ভেঙে দিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি রয়েছে, যা বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী সম্ভবপর নয় বলে আওয়ামী লীগ নেতারা বলে আসছেন।
এর মধ্যে রোববার সংলাপের আহ্বান জানিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে লেখা কামাল হোসেনের চিঠি পৌঁছে দেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা।
সেই চিঠি পাওয়ার পর সোমবার সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর শেখ হাসিনা আলোচনা করেন বলে কাদের জানান।
তিনি বলেন, “আজকে মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর নেত্রী আমাদের নিয়ে অনির্ধারিত একটি বৈঠক করেন। উপস্থিত দলীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং সবার মতামত জানতে চান। অনির্ধারিত এ আলোচনায় সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর দরজা কারো জন্য বন্ধ নয়।”
কাদের বলেন, “আমাদের পক্ষ থেকে সংলাপে নেতৃত্ব দেবেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। খুব শিগগিরই আমরা সময়, স্থান ও আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো তাদের জানিয়ে দেব। এটা অনতিবিলম্বে জানিয়ে দেব।”
এক প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, “সংলাপ তফসিলের আগেই হবে।”
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাত দফা মানা হবে কি না- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। আলোচনা যখন হবে, আলোচনার রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করেন।”
আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর ধানমণ্ডির কার্যালয়ে ‘জরুরি’ এই সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই কাদের বলেন, “আমি এই মুহূর্তে শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে সমগ্র দেশবাসীর জন্য প্লিজেন্ট সারপ্রাইজ দেব, যা সারাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে স্বস্তির সুবাতাস বইয়ে দেবে।”
সংলাপের চিঠিতে আওয়ামী লীগের এক সময়ের নেতা কামাল লিখেছিলেন, “একটি শান্তিপূর্ণ ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে সকলের অংশগ্রহণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাথে একটি অর্থবহ সংলাপের তাগিদ অনুভব করছে এবং সে লক্ষ্যে আপনার কার্যকর উদ্যোগ প্রত্যাশা করছি।”
তিনি চিঠি শুরু করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির জনক বলার মাধ্যমে। শেষে প্রধানমন্ত্রীর সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করেন।
বর্তমান রাজনৈতিক ‘সঙ্কটের’ জন্য নির্দিষ্ট কাউকে দায়ী না করে কামাল লেখেন, “নেতিবাচক রুগ্ন রাজনীতি কিভাবে আমাদের জাতিকে বিভক্ত ও মহাসঙ্কটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে, তাও আমাদের অজানা নয়।”
কাদেরের সংবাদ সম্মেলনের পর বৈঠকের ফাঁকে সাংবাদিকদের সামনে এসে মওদুদ বলেন, “আমরা প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে সংলাপে বসার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলাম। আজকে আমরা জানতে পারলাম যে, আমাদের এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে সংলাপের জন্য আমাদেরকে আমন্ত্রণ জানানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।
“আমরা প্রধানমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। আনুষ্ঠানিকভাবে যখন আমাদেরকে জানানো হবে কখন, কোন সময়ে কোন তারিখে এই আলোচনা হবে। আমরা সেটা জানলে তার সমর্থনে অবশ্যই সাড়া দেব।”
ইসিতে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে মওদুদ বলেন, “যেহেতু প্রধানমন্ত্রী সেখানে আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন, সেজন্য আমরা মনে করছি, এই মুহুর্তে নির্বাচন কমিশনে বোধ হয় না গেলেই হয়। যাওয়ার প্রয়োজন নেই।
“কালকে আমাদের ইসিতে যাওয়ার কথা ছিল ৩টার সময়, আমরা ইসিতে যাচ্ছি না। নতুন ডেভেলপমেন্ট হল; এখন তো মূল বিষয়গুলো সংলাপে হবে। সেখানে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হবে।”
মওদুদ বলেন, “আজকের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট মামলায় বেগম খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে এই মামলার কার্যক্রম চলেছে এবং রায় দেওয়া হয়েছে, যা ন্যায়বিচারের পরিপন্থি। আমরা এর নিন্দা জানাই। নানা রকমের শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত বেগম জিয়ার ন্যায্য জামিন না দেওয়ার সরকারি পদক্ষেপেরও আমরা প্রতিবাদ করছি।
“আমরা আশা করি, সরকার বেগম জিয়ার জামিনের সব বাধা দূর করে তাকে দ্রুত মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। আমরা মনে করি, এই মামলা রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।”
জিয়া এতিমখানা দুর্নীতির মামলায় সাজার রায়ের পর আট মাস ধরে কারাবন্দি খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় রায় হয়েছে সোমবার। এতে তাকে সাত বছর কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।
মওদুদের সভাপতিত্বে এই বৈঠকে ছিলেন জেএসডির আ স ম আবদুর রব ও আবদুল মালেক রতন, গণফোরামের সুব্রত চৌধুরী, মোস্তফা মহসিন মন্টু ও মোকাব্বির খান, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না ও জাহেদুর রহমান, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সুলতান মো. মনসুর ও আ ব ম মোস্তফা আমিন। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি জাফরুল্লাহ চৌধুরীও এই বৈঠকে ছিলেন।