নারায়ণগঞ্জ পরিবেশ ফেরাবে, আশা পর্যবেক্ষকদের

স্থানীয় সরকারের সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে সহিংসতা ও অনিয়মের ব‌্যাপক অভিযোগের পর নারায়ণগঞ্জ সিটি ভোটের আগের দিন পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ উৎসবমুখর পরিস্থিতি দেশে নির্বাচনী পরিবেশ ফেরার আশা জাগাচ্ছে পর্যবেক্ষকদের মনে।   

মঈনুল হক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Dec 2016, 07:05 AM
Updated : 21 Dec 2016, 08:15 AM

তারা বলছেন, নারায়ণগঞ্জে প্রধান দুই দলের ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ’ লড়াইয়ের মধ‌্যে তারা জাতীয় নির্বাচনের আমেজ পাচ্ছেন। তাছাড়া বর্তমান নির্বাচন কমিশন তাদের ভাবমূর্তির স্বার্থেই মেয়াদের শেষ সময়ের এই ভোট সুষ্ঠুভাবে সারা চেষ্টা করবে বলে তারা আশা করছেন।   

রাজনৈতিক দলগুলোর প্রত‌্যাশা পূরণ করে একটি ‘স্মরণীয়’ নির্বাচন উপহার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন রিটার্নিং কর্মকর্তাও।

চলতি বছরের শুরু থেকে কয়েক মাস ধরে চলা ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে সহিংসতায় প্রাণহানি অতীতের সব নির্বাচনকে ছাড়িয়ে যায়; কেন্দ্র দখল ও ব‌্যালট ছিনতাই করে বাক্স ভরার ব‌্যাপক অভিযোগ আসে। উপজেলা পরিষদ ও পৌরসভার পরিস্থিতিও ছিল মোটামুটি একই রকম।

সেই প্রেক্ষাপটে নারায়ণগঞ্জের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে অনেকের মধ‌্যে শঙ্কা থাকলেও ভোটের আগের দিন বুধবার পর্যন্ত গোলযোগ বা বড় ধরনের অনিয়মের খবর আসেনি।

কয়েকটি নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংগঠনের মোর্চা ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের (ইডব্লিউজি) পরিচালক আবদুল আলীম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নারায়ণগঞ্জের ভোটে আমরা জাতীয় নির্বাচনের আবহ দেখতে পাচ্ছি। বড় দুই দলের জাতীয় নেতারা মাঠে গিয়েছেন, অথচ কোনো বাধা-হামলা ঘটেনি। প্রচারে এ পর্যন্ত নেতিবাচক তেমন কিছুও দেখিনি। সব মিলয়ে বছর শেষে ভালো নির্বাচন হতে যাচ্ছে বলা যায়।”

বর্তমান কমিশনের অধীনে উপজেলা, পৌরসভা ও ইউপিতে যে সহিংসতা হয়েছে তার সঙ্গে তুলনা করলে নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন ‘অনেক ভালো’ হওয়ার প্রত‌্যাশা জাগাচ্ছে বলে আবদুল আলীম মনে করেন।

তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের আগ্রহের পাশাপাশি সরকারের দিক থেকেও ‘সহায়তার মনোভাব’ তারা দেখতে পাচ্ছেন।

“ইসির ইমেজ বাড়াতে নারায়ণগঞ্জ সিটির ভোট ভূমিকা রাখবে মনে করি। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের মধ‌্যেও নির্বাচনের ভালো পরিবেশ নিয়ে আস্থা বাড়ার সুযোগ হবে। নৌকা ও ধানের শীষের মধ‌্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হবে। সব মিলিয়ে উৎসবমুখর ও সুষ্ঠু ভোটের আভাস পাচ্ছি; যা সবারই প্রত‌্যাশা।”

নারায়ণগঞ্জে এবারই প্রথম দলীয় প্রতীকে সিটি নির্বাচন হচ্ছে। বৃহস্পতিবার ভোট সামনে রেখে মঙ্গলবার রাতে আনুষ্ঠানিক প্রচার শেষ করেছেন প্রার্থীরা। বিভিন্ন দলের সাত প্রার্থী মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকলেও মূল আলোচনা চলছে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিগত মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী এবং বিএনপির সাখাওয়াত হোসেন খানকে নিয়ে।

মেয়র পদের বাকি পাঁচ প্রার্থীর মধ‌্যে বিপ্লবী ওয়ার্কাস পার্টির মাহবুবুর রহমান ইসমাইল ‘কোদাল’, এলডিপির কামাল প্রধান ‘ছাতা’, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মাসুম বিল্লাহ ‘হাতপাখা’, কল্যাণ পার্টির রাশেদ ফেরদৌস ‘হাতঘড়ি’ এবং ইসলামী ঐক্যজোটের মুফতি এজহারুর হক ‘মিনার’ প্রতীক নিয়ে এ নির্বাচনে লড়ছেন।

এই সাতজনের মধ‌্যে থেকেই ঢাকার লাগোয়া এই সিটি করপোরেশনের নতুন মেয়র বেছে নেবেন নারায়ণগঞ্জের পৌনে পাঁচ লাখ ভোটার।

জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের চেয়ারম‌্যান অধ‌্যাপক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ মনে করছেনন, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী-দল-ভোটারদের মনোভাব পরিবর্তন হয়েছে নারায়ণগঞ্জের ভোটে।

“এখন পর্যন্ত ভোটের পরিবেশে সুন্দর নির্বাচনেরই আভাস দিচ্ছে। প্রধান দুই দলের মনোভাবও ইতিবাচক। আশা করি, আগের সব নির্বাচনের চেয়ে ভালো নির্বাচন হবে এবার। বিদায়ের আগে বর্তমান কমিশনের জন‌্যও নারায়ণগঞ্জের ভোট একটি চ‌্যালেঞ্জ; তারা ভালো নির্বাচন করারই ইঙ্গিত দিচ্ছে।”

মঙ্গলবার বিকালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের সঙ্গে সাক্ষাত করার পর বিএনপ্রি স্থায়ী কমিটির সদস‌্য নজরুল ইসলাম খানও সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচনী প্রচারে কোনো ধরনের বিঘ্ন ঘটেনি; কেউ বাধার সৃষ্টি করেনি।

“বিদায়ের আগে একটি ভালো নির্বাচনের প্রত‌্যাশা করছি আমরা। ইসিও আপ্রাণ চেষ্টার কথা জানিয়েছে। আমরা আশ্বস্ত হতে চাই।”

অন‌্যদিকে বিএনপির অভিযোগ না থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, “আমাদের দল একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে স্বাধীন ও কর্তৃত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে নির্বাচন কমিশনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে। নারায়ণগঞ্জের মানুষ যাকে খুশি তাকে ভোট দেবে। এটাই আমরা চাই। এটাই আমাদের নেত্রীর নির্দেশ।”

‘চ‌্যালেঞ্জ নিচ্ছি’

এ নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. নুরুজ্জামান তালুকদার বলেন, তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে কারও কাছ থেকে তারা অভিযোগ পাননি। প্রার্থীদের জন‌্য সমান সুযোগ ইসি ‘নিশ্চিত করেছে’।

দলীয়ভাবে সিটি নির্বাচন করাকে একটি ‘চ‌্যালেঞ্জ’ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এ জন‌্যে সুন্দর ভোট আয়োজনে সব ব‌্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো অভিযোগ নেই কারও। আশা করি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হবে। রাজনৈতিক দলগুলোও একটা ভালো নির্বাচন দেখবে আশা করি।”

ইসির এ উপ সচিব জানান, বছর শেষে বর্তমান ইসির শেষ সময়ে ‘ইমেজ’ রক্ষায় তৎপর রয়েছেন তারা।

“গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভালো নির্বাচন হওয়া জরুরি। আমরাও ২২ ডিসেম্বর এমন একটি নির্বাচন উপহার দিতে চাই যেখানে দলের মধ‌্যে গভীর আশার সৃষ্টি হবে। তাদের প্রত‌্যাশা পূরণের পাশাপাশি অবিস্মরণীয় একটি ভোট দেখাতে চাই।”

তবে ভোটের দিন সব প্রার্থী যেন তাদের এজেন্টদের উপস্থিতি নিশ্চিত করে- সে বিষয়ে গুরুত্ব দেন রিটার্নিং কর্মকর্তা।

আইভী-সাখাওয়াতের আশার পাশে শঙ্কাও

প্রচারের শেষ দিনে মঙ্গলবার নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি সেলিনা হায়াৎ আইভীর বলেন, ইসি ‘নিরপেক্ষ থাকলে’ এবং আইনশৃঙ্খলাবাহিনী ‘সক্রিয় থাকলে’ নির্বাচন সুষ্ঠু হবে।

“এখন মানুষ ভোট দেবে, সেই অপেক্ষায় আছি। এখনকার শান্তিপূর্ণ পরিবেশ যেন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত থাকে।... কোনো আশঙ্কা আমি উড়িয়ে দিচ্ছি না। প্রার্থীদের মধ্যেতো চিন্তা থাকেই,” বলেন ক্ষমতাসীন দলের এই প্রার্থী।

এবারের ভোটে এখন পর্যন্ত কোনো গোলযোগ না ঘটলেও আশঙ্কা কাটেনি বলে মন্তব‌্য করেন সেনা মোতায়েনের দাবি জানিয়ে আসা সাখাওয়াত হোসেন খান।  

“আশঙ্কাতো আছেই। গত নির্বাচনে কী হয়েছে- সেটা সবাই দেখেছে। এরপরও আমরা আশা নিয়ে দাঁড়িয়েছি, এবার একটা সুষ্ঠু নির্বাচন হবে- এটা জনগণেরও আশা। সরকার ও নির্বাচন কমিশন জনগণের এই আশা পূরণ করবে, এটাই আমরা কামনা করি।

নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ জানান, নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনকে সুষ্ঠু করতে যত ধরনের ব‌্যবস্থা নেওয়া দরকার ‘সবটুকুই’ তারা করবেন। নির্বাচনে কোনো ধরনের গোলযোগের সুযোগ দেওয়া হবে না। 

“প্রার্থীদের মনে শঙ্কা থাকতেই পারে। আমরা নিশ্চিয়তা দিচ্ছি। শঙ্কা না রেখে নিঃসংকোচে ভোট কেন্দ্রে আসার আহ্বান জানাচ্ছি সবাইকে। কেউ অনিয়ম করলে কঠোর ব‌্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে; কাউকে ছাড়ও দেওয়া হবে না।

অভিযোগ ১০০, জরিমানা ২৫ জনকে

নারায়ণগঞ্জের ভোটে সাত মেয়র প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের কোনো অভিযোগ আসেনি বলে জানান রিটার্নিং কর্মকর্তা।

তবে ১৫৬ জন সাধারণ ও ৩৮ জন সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থীর মধ‌্যে অন্তত ১০০ জনের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ ইসি পেয়েছে।

“আমরা অনেককে সতর্ক করেছি, ২৫ জনকে জরিমানা করেছেন নির্বাহী হাকিমরা। কোথাও কোনো বাধা-হামলার ঘটনা ঘটেনি,” বলেন নুরুজ্জামান।

ভোটের পরিবেশ নিশ্চিত রাখতে মাঠে থাকবে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর সাড়ে ৯ হাজার সদস‌্য। পাশাপাশি থাকবেন নির্বাহী ও বিচারিক হাকিমরা। ভোট পর্যবেক্ষণে থাকবেন কয়েক হাজার সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকরা।