কুমিল্লার ভোটারদের ভাবনায় ভোটের দিনের পরিবেশ

‘হুমকি-ধামকি’ পাওয়ার কথা বললেন কয়েকজন ভোটার; চার প্রার্থীর মধ্যে তিনজনের কথাতেও প্রকাশ পেল শঙ্কা।

মাসুম বিল্লাহআবদুর রহমান কুমিল্লা থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 March 2024, 06:38 PM
Updated : 6 March 2024, 06:38 PM

কুমিল্লা সিটির মেয়র পদের উপ-নির্বাচনে টেবিল ঘড়ি মার্কার প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু গণসংযোগ করতে ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে গেলে তার সঙ্গে দেখা হয় সরাফত আলীর।

প্রার্থী চলে যাওয়ার পর মহিশপুরের একটি ধান মাড়ানোর মাঠে স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে বসে সেই আলাপ করছিলেন অশীতিপর এই বৃদ্ধ; ভোটের দিন কেমন যাবে সেটাই ছিল তাদের আলোচনার বিষয়।

যৌবনে কৃষি আর যোগালির কাজ করে সংসার চালাতেন সরাফত, এখন সন্তানদের উপার্জনে নিজের শেষ জীবন কাটাচ্ছেন।

ভোটের কী অবস্থা– এমন প্রশ্নে উত্তর দিতে প্রথমে কিছুটা দ্বিধা করলেও পরে মুখ খোলেন বৃদ্ধ। বলেন, “এখন তো পরিবেশ ভালোই দেখছি। ভোটের দিন কী হবে, এখনও জানি না।”

ভোটের দিন নিয়ে শঙ্কা কেন? সরাফত আলী বললেন, “হুমকি-ধামকি দিচ্ছে, যেন কেন্দ্রে না যায়।”

তবে, কারা হুমকি দিচ্ছে, সে বিষয়ে মুখ খোলেননি তিনি।

আগামী শনিবারের এ নির্বাচন ঘিরে প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকরা স্লোগান, মাইকিং আর গণসংযোগে মাঠের পরিবেশ সরগরম রাখলেও ভোটের দিনের পরিস্থিতি নিয়ে এমন শঙ্কা রয়েছে অনেক ভোটারের মনে।

দায়িত্ব গ্রহণের প্রায় দেড় বছরের মাথায় মেয়র আরফানুল হক রিফাতের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া মেয়র পদের নির্বাচনে ওই দিন ভোট দেবেন প্রায় আড়াই লাখ ভোটার।

কেন্দ্রে ভোটার বাড়ানোর কৌশলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এই সিটি নির্বাচনে কোনো প্রার্থীকে দলীয় মার্ক দেয়নি।

‘কেন্দ্রে ভোটার টানতে এবং দলীয় বিভেদ দূর করতে’ স্থানীয় সরকারের এই ভোটে কাউকে দলীয় প্রতীক দেয়নি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের দুই নেতার সঙ্গে বিএনপি ও স্বেচ্ছাসেবক দল থেকে বহিষ্কৃত দুই নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মেয়র পদের জন্য লড়ছেন।

বাস প্রতীক নিয়ে মাঠে নেমেছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও কুমিল্লা সদরের এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের মেয়ে তাহসীন বাহার সূচনা।

বিএনপির বহিষ্কৃত দুবারের সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কু চতুর্থবারের মতো সিটি ভোটে লড়ছেন টেবিল ঘড়ি প্রতীক নিয়ে।

নিজের পছন্দের ঘোড়া প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি নিজাম উদ্দিন কায়সার; যিনি ২০২২ সালে প্রথমবারের মত মেয়র পদে লড়ে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিলেন।

ভোটে কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ও ভিক্টোরিয়া কলেজের সাবেক ভিপি নূর-উর রহমান তানিমের মার্কা হাতি।

শনিবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ১০৫ কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে একটি পদের ভোটগ্রহণ করা হবে।

নির্বাচনের তফসিল অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার রাত ১২টা পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক প্রচার চালাতে পারবেন প্রার্থী ও তাদের কর্মী-সমর্থকরা।

কুমিল্লা সদর দক্ষিণ থানার মহিশপুরের বৃদ্ধ সরাফত আলীর শঙ্কার প্রতিধ্বনি মিলল প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার দূরে দ্বিতীয় মুরাদপুর এলাকার গৃহিণী হেনা বেগমের কণ্ঠেও।

মহিশপুর থেকে পুরাতন হাইওয়ে ধরে কুমিল্লা শহরে ফেরার পথে কিছু অংশ সিটি করপোরেশন এলাকায় পড়েনি। ওই এলাকা পার হয়ে আরও কিছু পথ এগোলে ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার হেনা বেগমের বাড়ি।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ভোট কেন্দ্রে যাব কি-না, এ নিয়ে শঙ্কায় আছি। আমাদেরকে বিভিন্নভাবে বলা হচ্ছে যেখানেই ভোট দিই- পাস করবে একজনই।

“এছাড়া আরো বিভিন্ন হুমকি আছে। তবে আশা আছে ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার। বাকিটা ভোটের দিনের পরিবেশের উপর নির্ভর করছে।”

বুধবার বিকালে নগরীর ৬ নম্বর ওয়ার্ডের শুভপুর এলাকার ভোটার মফিজুল ইসলামও ভোট দিতে যাওয়া নিয়ে শঙ্কা ও দ্বিধার কথা বলেছিলেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমাদের বাড়ি একদল লোক গিয়ে বলছে- কেন্দ্রে না গেলেই ভালো, ভোটের দিন বাড়িতে থাকবেন। এজন্য কিছুটা আতঙ্কে আছি।

“গত নির্বাচনে ভোট দিয়েছি। এ নির্বাচনে ভোট দিতে পারব কিনা জানি না। প্রশাসন যদি তৎপর হয়- তাহলে ভোটের দিন কেন্দ্রে যাব।”

শঙ্কা তিন প্রার্থীরও, ‘উৎসব’ দেখছেন সূচনা

বাস প্রতীকের প্রার্থী সূচনা নির্বাচনের উৎসবমুখর পরিবেশ দেখার কথা বললেও ভোটের দিনের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কার কথা বলছেন অপর তিন প্রার্থী; তাদের কারও অভিযোগের তীর সূচনার বাবা এমপি বাহারের দিকেই।

মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা, মেয়র প্রার্থী তানিম বলছেন, এমপি বাহারের কারণে কুমিল্লার মানুষের ‘ঘুম হারাম’ হয়ে গেছে।

“আমি আশা করি, অচিরেই কুমিল্লার মানুষ উনাকে জবাব দিয়ে দেবে, ৯ তারিখের নির্বাচনে উনার প্রার্থীকে পরাজিত করার মাধ্যমে এবং জনগণের পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ী করার মাধ্যমে।”

নির্বাচন কমিশন চাইলে এখনও ভোটকে শঙ্কামুক্ত করতে পারে মন্তব্য করে তানিম বলেন, “এজন্য নির্বাচন কমিশনের কয়েকটি পদক্ষেপই যথেষ্ট। বিশেষ করে ভোটের শেষ সময় পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ম্যাজিস্ট্রেটদেরকে কেন্দ্র এবং কেন্দ্রের বাইরে তৎপর থাকতে হবে।”

বুধবার দুপুরে ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে গণসংযোগ গিয়ে ভোটারদের উদ্দেশ্যে মেয়র প্রার্থী সাক্কু বলেন, “ভয়ভীতি দেখালে যাবেন না, তা তো না। আপনারা ভোটকেন্দ্রে যাবেন, পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেবেন।”

হুমকি দেওয়ার অভিযোগ করে তিনি বলেন, “হুমকিতো প্রতি মুহূর্তে। রাত ১২টার পর ওয়ার্ডভিত্তিক নেতা যারা আছে, বিশেষ করে বাসের নেতারা ঘরে ঘরে গিয়ে আমাদের কর্মীদের বলতেছে, ‘মারব-ধরব, ১০ তারিখের পর এলাকায় আসতে পারবে না’, বিভিন্ন রকমের। যেভাবে যেমন ভাষা ব্যবহার আর কি, হুমকি-ধামকিতো চলতেই আছে।”

ঘোড়া প্রতীকের প্রার্থী কায়সার বলেন, “আমি নির্বাচন কমিশনের কাছে দাবি জানাচ্ছি তারা যেন সব কেন্দ্রেকেই ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে সমানভাবে গুরুত্ব দেয়। তাহলে মানুষের শঙ্কা আরো দূর হয়ে যাবে।”

কেন্দ্রে ভোটার আনার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখা কাউন্সিলর প্রার্থীরা উপ-নির্বাচনে না থাকায় ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

কাউন্সিলররা না থাকলেও ভোটার উপস্থিতিতে প্রভাব পড়বে না মন্তব্য করে বাস প্রতীকের প্রার্থী সূচনা বলেন, “ভোটার উপস্থিতিতে পড়ছে না। কারণ, কুমিল্লাতে আপনারা সব জায়গায় দেখছেন যে, একটা উৎসবমুখর পরিবেশ হিসাবে জনগণ নির্বাচনটাকে নিয়েছে। সেক্ষেত্রে কাউন্সিলের উপস্থিতি না থাকলেও ভোটারদের যথেষ্ট পরিমাণ সাড়া আমরা পাচ্ছি।”

ভোটার আর প্রার্থীদের এমন শঙ্কার বিপরীতে নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা ফরহাদ হোসেন অভয় দিয়ে বলেন, ভোটারদের শঙ্কা থাকার কোনো ‘সুযোগই নাই’।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বৃহস্পতিবার রাত থেকে নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন শুরু হয়ে যাবে। প্রত্যেকটি ওয়ার্ডে পুলিশের একটি ও র‌্যাবের একটি মোবাইল টিম এবং একজন করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করবেন।

“জাতীয় নির্বাচনে প্রতি কেন্দ্রে দুজন করে পুলিশ ছিল, এখানে থাকবে পাঁচজন করে। প্রতি তিনটি ওয়ার্ডে একজন বিচারিক হাকিম থাকবেন। ১২ প্লাটুন থাকছে বিজিবি। শঙ্কা থাকার কিছু নাই। কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা হলে যেতে পাঁচ মিনিট লাগবে না। সবাই ঠিকমত ভোট দিতে পারবে।”

তবে শেষ মুহূর্তের প্রচারে ‘ব্যক্তিগত আক্রমণ’ নজরে পড়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “এটা যেন সংঘাতে রূপ না নেয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।”

প্রচারে সরগরম

ভোট ঘিরে বুধবারও সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সরগরম প্রচার-প্রচারণা চলেছে কুমিল্লা মহানগরীর অলিগলিতে।

আগে থেকেই পোস্টারে ছেয়ে আছে নগরীর প্রায় সব এলাকা; গানে-গানে আর স্লোগানে মাইকে চলছে ভোটের দেওয়ার আবেদন।

বেলা পৌনে ১১টার দিকে ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাগিচাগাঁও এলাকা থেকে বুধবারের গণসংযোগ শুরু করেন বাস প্রতীকের প্রার্থী সূচনা। ওই ওয়ার্ডের গণসংযোগ শেষ করে দুপুর পর্যন্ত ৮ নম্বর ওয়ার্ডে ছিলেন তিনি।

গণসংযোগের সময় ভোটারদের কাছে গিয়ে লিফলেট বিতরণের পাশাপাশি কয়েকটি পথসভায়ও বক্তব্য দেন এমপি বাহারের মেয়ে।

প্রার্থীর বাইরে প্রবাসীদের কয়েকটি দল নগরীতে বাস প্রতীকের প্রার্থীর পক্ষে গণসংযোগ করেছেন। প্রার্থীর সমর্থনে নগরীতে ১২টি উঠান বৈঠক হওয়ার কথা জানিয়েছে প্রার্থীর জনসংযোগ বিভাগ।

দুপুরে ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে মহিশপুর থেকে বুধবারের গণসংযোগ শুরু করেন টেবিল ঘড়ি প্রতীকের প্রার্থী সাক্কু; সেখানে মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে ভোট প্রার্থনা করেন তিনি এবং ভোটারদের কেন্দ্রে যাওয়ার আহ্বান জানান।

বিকেল সাড়ে ৪টায় কাপ্তান বাজার পাকার মাথায় এবং বিকাল ৫টায় কাপ্তান বাজার ময়েজ বাড়ি মাঠে উঠান বৈঠক করেন সাবেক মেয়র সাক্কু।

সকাল সাড়ে ১০টার পর নগরীর বাহার মার্কেট ও কান্দিরপাড় এলাকায় গণসংযোগ করেন ঘোড়া প্রতীকের প্রার্থী কায়সার। এরপর বিকালে ৬ নম্বর ওয়ার্ডের শুভপুরসহ কয়েকটি স্থানে উঠান বৈঠক করেন তিনি।

নগরীর ৬ নম্বর ওয়ার্ডের শুভপুরসহ কয়েকটি স্থানে গণসংযোগ করেন হাতি প্রতীকের প্রার্থী তানিম। এরপর বিকালে নিজের বাড়িতে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন।