দিনাজপুর মহারাজা গিরিজানাথ হাই স্কুল ট্রাজেডি

মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়েও ১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারির গিরিজানাথ হাই স্কুল ট্রাজেডির মতো এত অধিকসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা একই স্থানে একই সঙ্গে শহীদ হয়েছেন এমন নজির নেই বলে জানা যায়।

মুস্তাফিজুর রহমান রূপমমুস্তাফিজুর রহমান রূপম
Published : 6 Jan 2024, 03:01 PM
Updated : 6 Jan 2024, 03:01 PM

চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে, বিজয়ের মালা গলায় পরে তাঁরা শহীদ হয়েছেন— শত্রুর আক্রমণে নয়, বলা যায় এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায়। ১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি সন্ধ্যা নামার একটু আগে দিনাজপুর শহর কেঁপে উঠেছিল প্রচণ্ড এক বিষ্ফোরণে। কতজন যুদ্ধজয়ী বীর মুক্তিযোদ্ধা সেই বিষ্ফোরণে শহীদ হয়েছেন তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায় না। মনে করা হয় সেই সংখ্যা পাঁচ থেকে ছয়শত বা তারও অধিক হতে পারে। সংখ্যাটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরও অনেক গবেষণা ও অনুসন্ধান প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টজনেরা।

১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের দিনটির মাত্র ২০ দিন পর দিনাজপুর শহরের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত মহারাজা গিরিজানাথ হাই স্কুলে এক প্রচণ্ড মাইন বিষ্ফোরণ ঘটে। বিজয়ের আনন্দধারার মধ্যে নেমে আসে হতবিহ্বল করা এক শোক, বেদনা, করুণ কান্নার দিন। 

মুক্তিযুদ্ধের ৬ এবং ৭ নম্বর সেক্টরের যুদ্ধফেরত মুক্তিযোদ্ধার একটি অংশ ক্যাম্প করেছিলেন মহারাজা গিরিজানাথ হাই স্কুলে। স্কুলটি দিনাজপুরের প্রাচীন একটি স্কুল। দিনাজপুরের শেষ মহারাজা জগদীশ নাথ রায়ের পিতা গিরিজানাথ রায়ের আমলে তাঁর নিজের নামে নির্মিত। ১২টির অধিক কক্ষবিশিষ্ট চওড়া ইটের দেওয়ালের উপর লোহার বর্গা দেওয়া চুন-সুড়কির পুরু ছাদযুক্ত রাজকীয় স্থাপনার আদলে তৈরি স্কুলভবন এবং প্রশস্ত খেলার মাঠ। মুক্তিযুদ্ধে ৬ এবং ৭ নম্বর সেক্টরের আট শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান নিয়েছিলেন সেখানে। তাঁরা কাজ করছিলেন দেশের জন্য। দেশের মানুষ যারা শরণার্থী হয়ে রয়েছেন ভারতে এবং দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্নখানে; তাঁদের ঘরে ফেরাকে নিরাপদ করতে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধের পরেও কাজ করছিলেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে।

সদ্য স্বাধীন দেশে সর্বত্র ছড়িয়ে আছে পাকিস্তানি বাহিনীর নাশকতার স্পষ্ট চিহ্ন। বিশেষ করে দিনাজপুরে অসংখ্য স্থানে, পথে-ঘাটে–মাঠে বিভিন্ন মারাত্মক বিষ্ফোরক বিশেষত ল্যান্ড মাইন মাটির নিচে পুঁতে রাখা ছিল। এছাড়াও শত্রুদের ফেলে যাওয়া অসংখ্য আগ্নেয়াস্ত্র, গ্রেনেড পড়ে ছিল যেখানে-সেখানে। এসব অস্ত্রমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত জেলার পথেঘাটে চলা, বিশেষ করে গরুর গাড়ি, মোটর গাড়ি বা অন্যান্য যানবাহনে চলাচল করা ছিল ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক।

এই পরিস্থিতিতে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার (বর্তমান দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়) মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় অংশ মহারাজা স্কুল ক্যাম্পে অবস্থান নিয়ে বিপজ্জনক এলাকাগুলো চিহ্নিত করে মাইন তথা অস্ত্রমুক্ত করতে নিয়োজিত হন। মহারাজা স্কুল মাঠের পশ্চিম দিকে একটি বেশ বড় গর্ত খুঁড়ে সেটির চারিদিকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে উদ্ধারকৃত গোলাবারুদ সংরক্ষণের জন্য একটি রক্ষণাগার প্রস্তুত করা হয়।

মুক্তিযোদ্ধারা জেলার বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে তল্লাশি চালিয়ে শত্রুদের ফেলে যাওয়া অ্যান্টি ট্যাংক মাইন, অ্যান্টি পার্সোনাল মাইন, টু ইঞ্চ ও থ্রি ইঞ্চ মর্টার শেল, গ্রেনেড প্রভৃতি উদ্ধার করে এনে রক্ষণাগারে জমা করছিলেন। ক্যাপ্টেন শাহারিয়ারের নেতৃত্বে তাঁরা এই কাজ শেষ করে এনেছিলেন প্রায়। উদ্ধার করা বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ নির্দিষ্ট স্থানে জমা করা হয়েছিল, এমন অবস্থায় ৬ জানুয়ারি ১৯৭২ শীতের সন্ধ্যা নামার খানিক আগে ঘটে যায় মর্মান্তিক দুর্ঘটনা, বিস্ফোরণ। যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ‘মহারাজা গিরিজানাথ হাই স্কুল ট্রাজেডি’ নামে পরিচিত। 

সেই মৃত্যুর মিছিল থেকে বেঁচে যাওয়া একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহিম, বাড়ি দিনাজপুর সদরের উতরাইল ইউনিয়নের চকগোপাল গ্রামে। তিনি দীর্ঘদিন থেকে ব্রিটেন প্রবাসী। গেল ডিসেম্বরের ২৯ তারিখ সন্ধ্যায় ফোনে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। সেই দিনের কথা স্মরণ করে তিনি বলছিলেন, সময়টা ছিল আসরের নামাজের কিছু পরে। মহারাজা স্কুল মাঠে দুটি ট্রাক থেকে উদ্ধারকৃত গোলাবারুদ নামিয়ে রাখা হচ্ছিল নির্দিষ্ট স্থানে। তিনি সেই কাজই করছিলেন সহযোদ্ধা আইয়ুব আলীসহ। ইতোমধ্যে আরও একটি ট্রাক এসে সেখানে থামে। আব্দুর রহিম নিয়মিত নামাজ আদায় করতেন। এমনকি যুদ্ধের ময়দানেও তিনি নামাজ বাদ দেননি কখনো। সেদিন ট্রাক থেকে গোলাবারুদ নামানোর কাজে নিয়োজিত থাকায় তাঁর আসরের নামাজ আদায় করা হয়নি জামাতের সঙ্গে। এদিকে ওয়াক্ত শেষ হতে চলেছে, তাই তিনি অনুমতি নিয়ে মাঠের একপাশে টিনের বেড়া ও চালযুক্ত মসজিদে যান আসরের নামাজ আদায় করতে। তিনি নামাজ শুরু করেছিলেন মাত্র, তারপর আর কিছুই স্মরণ করতে পারেন না। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে তিনি নিজেকে আবিষ্কার করেন দিনাজপুর মিশন হাসপাতালের বিছানায়; এক হাতে স্যালাইন, বাম চোখ ব্যান্ডেজে ঢাকা, শরীরে প্রচণ্ড ব্যথার অনুভূতি নিয়ে।

পরে আব্দুর রহিম অন্যদের কাছ থেকে জানতে পারেন বিস্ফোরণের কথা, সাথীদের শহীদ হওয়ার কথা। আহত সঙ্গীদের চিকিৎসাধীন দেখেন হাসপাতালে তাঁরই সঙ্গে। কিছুক্ষণ পর সেখানে দেখতে পান তাঁর ফুপাতো ভাই রমজান আলীকে। রমজান আলী তাঁকে জীবিত দেখে অবাক এবং আবেগ আপ্লুত হয়ে জানান যে, তাঁকে শহীদ ভেবে গ্রামে তাঁর জানাজার নামাজ পরা হয়ে গিয়েছিল। রমজান আলী আব্দুর রহিমকে রেখে দ্রুত গ্রামে ফিরে যান তাঁর মামা-মামি অর্থাৎ আব্দুর রহিমের মা-বাবাকে সন্তানের জীবিত থাকার খবর দেওয়ার জন্য। ক’দিন পর সুস্থ হয়ে আব্দুর রহিম কমান্ডার ক্যাপ্টেন শাহারিয়ারের অনুমতি নিয়ে গ্রামে ফিরে যান। 

খুব সম্ভবত সেদিন আহত অচেতন আব্দুর রহিমকে ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে মিশন হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ। তিনি কমরেড আজাদ নামে দিনাজপুরে অধিক পরিচিত। দীর্ঘদিন কমিউনিস্ট পার্টির  দিনাজপুর জেলা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি । ৮১ বছর বয়সী অশীতিপর এক তরুণ যেন। তারুণ্যে ভরা মানুষটির কাছ থেকে জানা যায়, সেদিন সেই ক্ষণে তিনি অবস্থান করছিলেন দিনাজপুর শহরের মোটামুটি মধ্যস্থল চারুবাবুর মোড়ের কাছে, রহমান মিয়ার হোটেলের সামনে। গোধূলিবেলায় প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শক-ওয়েভে কেঁপে ওঠা সামলে নিয়ে তিনি তাঁর সঙ্গে থাকা সাইকেল চেপে শব্দের উৎসের সন্ধানে শহরের পূর্ব দিকে যেতে থাকেন। ঘাঘড়া খালের বাঞ্ছারাম পুলের উপর পৌঁছে দেখতে পান ধোঁয়া চক্রাকারে কুণ্ডলি পাকিয়ে উঠে যাচ্ছে আকাশের দিকে। জায়গাটা অনুমান করেন মহারাজা স্কুল। দ্রুত সাইকেল চালিয়ে কাছে পৌঁছে যান। দেখেন ধুলো এবং ধোঁয়ায় চারদিক অন্ধকার। কিছুই বোঝা যায় না। ধীরে ধীরে ধুলো কমে এলে এগিয়ে গিয়ে দেখতে পান ধ্বংস্তূপ ।

পুরো স্কুল ভবনটি ধ্বসে পড়ে আছে। চওড়া দেওয়ালের ইট ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। ভবনের ছাদ ধ্বসে পড়ে আছে মেঝের উপর আর সেই ছাদের নিচে চাপা পড়ে আছেন অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা। ইতোমধ্যে শীতের সন্ধ্যা নেমে আঁধার ঘনিয়ে এসেছে। যুদ্ধবিধবস্ত দিনাজপুর শহরে তখন বিদ্যুৎ ছিল না। পাক সেনারা শহর ছেড়ে যাওয়ার সময় বালুবাড়ি পাওয়ার হাউস ধ্বংস করে দিয়ে যায়। টর্চ, মোমবাতির আলোয় শুরু হয় উদ্ধারকাজ। বিস্ফোরণে স্কুল ভবনের ধ্বসে পড়া ছাদের নীচ থেকে মানুষের হাত পা বের হয়ে আছে আর শোনা যাচ্ছে মানুষের গোঙানির শব্দ। হাত পা ধরে টানাটানি করে কাউকে তেমন বের করে আনা যাচ্ছে না। দিনাজপুর পলিটেকনিক ইন্সিটিউট মহারাজা স্কুল থেকে দুই কিলোমিটার মতো দক্ষিণ দিকে। সেখানে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সৈন্যরা ক্যাম্প করে অবস্থান করছিল। অল্প সময়ের মধ্যে তারা গাড়ি নিয়ে চলে আসে। তাঁদের গাড়ির হেডলাইটের আলোয় দেখা যায়, স্কুল মাঠ জুড়ে অসংখ্য নিহত এবং আহত মুক্তিযোদ্ধারা পড়ে আছেন আর পড়ে আছে তাঁদের শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। আবুল কালাম আজাদ নিয়োজিত হন উদ্ধারকাজে , তাঁর সঙ্গে তারই বন্ধু মঞ্জুর আলম শহরের ষষ্ঠীতলা থেকে একরকম দৌঁড়ে এসে উদ্ধারকাজে শামিল হন। আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাস মালিক সমিতিতে লোক পাঠিয়ে একটি বা দুটি বাসের ব্যবস্থা করা হয়। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের দিনাজপুর সদর হাসপাতালে স্থান সংকুলান না হওয়ায় অনেককে মিশন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এই মিশন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কাজটি যারা করেছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আবুল কালাম আজাদ এবং মঞ্জুর আলম। মির্জা আনোয়ারুল ইসলাম তানুও যুক্ত হয়েছিলেন তাঁদের সঙ্গে। তাঁদের জামা-কাপড় রক্তে ভিজে লাল হয়ে গিয়েছিল এবং দিনাজপুরের জানুয়ারির শীতও তাঁরা সেদিন অনুভব করেননি।

পরদিন ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি সকালে উদ্ধারকারীরা মহারাজা স্কুল মাঠ থেকে মৃতদেহ এবং শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো সংগ্রহ করেন। প্রথমে চটের বস্তায় ভরা হয়। দিনাজপুর শহরের উত্তর দিকে চেহেলগাজী মাজারের সামনের অংশে দিনাজপুর-দশমাইল সড়কের পাশে ১০০টির মতো কবর খোঁড়া হয়। দিনাজপুর শহরে তখনও দোকানপাট তেমনভাবে চালু হয়নি। শহর অনেকাংশেই ফাঁকা ছিল। শহীদদের জন্য কাফনের কাপড় সংকুলান করা সম্ভব হয়নি। শহরের অল্পসংখ্যক মানুষের জন্য এত শহীদদের যথাযথ মর্যাদায় কবরস্থ করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছিল। তারপরও অসংখ্য মানুষ তাদের  মৃতদেহ বহন করে নিয়ে শোক মিছিলে শামিল হয়। কোনো কোনো কবরে একাধিক শহীদের দেহ কবরস্থ করা হয়। অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো কাফনের কাপড়ে আবৃত করে কবরস্থ করতে দুই তিনটি কবর পূর্ণ হয়ে যায়।

মুজিবনগর সরকারের পশ্চিমাঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট এম আবদুর রহিমের উপস্থিতিতে যথাসম্ভব সামরিক মর্যাদায় শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমাহিত করা হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী যে পাঁচজন জন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন, এম আব্দুর রহিম তাঁদের একজন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যদের বিরুদ্ধে দায়ের করা ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার লিগ্যাল এইড কমিটির একজন সদস্যও ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে কয়েকবার দিনাজপুর থেকে সংসদ সদস্য হয়েছেন।

পরে দিনাজপুরবাসীর পক্ষে সেখানে ৬ জানুয়ারির শহীদদের স্মরণে জাতীয় শহীদ মিনারের আদলে ছোট করে একটি স্মৃতিসৌধ এবং ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে আরও একটি স্তম্ভ এবং স্মৃতিচত্বর নির্মিত হয়। মিনারের গায়ে ১৭৭ জন শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম লিপিবদ্ধ আছে।

দিনাজপুর শহরের মহারাজা গিরিজানাথ হাই স্কুলে ভয়াবহ, বেদনাদায়ক ও মর্মান্তিক মাইন বিষ্ফোরণের ঘটনাটি ছিল রহস্যময়, ভূমিকম্পের মতোই আকস্মিক। সেই সময় বিভিন্ন সূত্রে অনুসন্ধান চালিয়েও বিষ্ফোরণের প্রকৃত কারণ ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক নাম, সংখ্যা ও পরিচয় উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। পরে ১৯৯৬-৯৭ সালে গভীর অনুসন্ধানের ফলে ঘটনার রহস্যময় কারণ, শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নাম  ও ঠিকানা আংশিক উদ্ধার করা গেছে। অ্যাডভোকেট এম আবদুর রহিমের পৃষ্ঠপোষকতায় ২০০১ সালের ৬ জানুয়ারি ঘটনাস্থলে একটি নাতিদীর্ঘ স্মৃতিস্তম্ভে ১২০ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এবং ৩৪ জন আহত মুক্তিযোদ্ধার নাম-ঠিকানাসহ স্মৃতিফলক উন্মোচন করেন তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলসের মহাপরিচালক বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল আলম ফজলুর রহমান। 

মহারাজা গিরিজানাথ স্কুলের অনতিদূরে মহারাজারই দানসূত্রে প্রাপ্ত স্বর্গীয় নিবারণ চন্দ্র বিশ্বাসের বসতবাড়ি। তারা সপরিবারে ভারতের রায়গঞ্জে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন যুদ্ধের সময়। তাঁর তৃতীয় পুত্র সুবাস বিশ্বাস ও কনিষ্ঠ পুত্র সমর বিশ্বাস দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রায়গঞ্জ থেকে নিয়মিত দিনাজপুরের বাড়িতে যাওয়া-আসা করছিলেন। ৬ জানুয়ারির বিষ্ফোরণের দিন তারা মহারাজা স্কুলের উত্তর-পশ্চিম দিকে অবস্থিত নিম কালী মন্দির সংলগ্ন বাড়িতে ছিলেন । সুবাস বিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁর অনুজ প্রয়াত সমর বিশ্বাস বিষ্ফোরণের সামান্য সময় আগেও সেই জায়গাতেই অবস্থান করছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ২০০ গজ মতো দূরে নিম কালী মন্দিরের কাছে আসা মাত্রই বিষ্ফোরণ ঘটে। সমর বিশ্বাস দীর্ঘসময় অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিলেন। তাদের মাটির তৈরি বসতঘর সম্পূর্ণ ধ্বসে পড়ে গিয়েছিল।

বিষ্ফোরণের কারণ হিসেবে যে বিষয়টি প্রতীয়মান হয় তা হলো উদ্ধারকৃত মাইন, গোলাবারুদ ট্রাক থেকে নামানোর সময় দুর্ঘটনাবশত একটি মাইন হাত থেকে পড়ে যায় এবং এর ফলে সংরক্ষিত মাইন, গোলাবারুদ, বিষ্ফোরণযোগ্য সব কিছুই একসঙ্গে বিষ্ফোরিত হয়ে এক মহাবিষ্ফোরণ ঘটে যায় মহারাজা স্কুলে।

২০২৩ সালে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে মহারাজা গিরিজানাথ হাই স্কুলে নতুন করে বেদি, স্মৃতিসৌধ ও জাদুঘর নির্মাণের কাজ শুরু হয়, যা বর্তমানে প্রায় সমাপ্তির পথে। 

মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়েও ১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারির গিরিজানাথ হাই স্কুল ট্রাজেডির মতো এত অধিক সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা একই স্থানে একই সঙ্গে শহীদ হয়েছেন এমন নজির নেই বলে জানা যায়। তথাপি মহারাজা গিরিজানাথ হাই স্কুল ট্রাজেডির কথা জাতীয় পর্যায়ে যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়নি। যদিও অকুতোভয় বীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের কাছে কোনো স্মৃতিসৌধ নির্মাণ, শ্রদ্ধা নিবেদন যথেষ্ট নয়, বরং অকিঞ্চিৎকর হয়ে যায়।