‘তখন সত্যি মানুষ ছিলাম’ উচ্চারণের কবি আসাদ চৌধুরী

তিনি ছিলেন মার্জিত রুচির, স্থির, দৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তাঁর বিচরণ ও গ্রহণযোগ্যতা ছিল নানা পথ মত বিশ্বাস ও রাজনীতির বহুবিধ বলয়ে। তাঁর বিশ্বাস ও চর্চা, ধারণ ও লালনের কেন্দ্রে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। আর অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধ।

আনিসুর রহমানআনিসুর রহমান
Published : 6 Oct 2023, 09:39 AM
Updated : 6 Oct 2023, 09:39 AM

শামসুর রাহমানদের ঠিক পরের দশকের গুরুত্বপূর্ণ একজন কবি আসাদ চৌধুরী।  তিনি লিখেছেন কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ও জীবনী। লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু এবং দেশ বিদেশের রূপকথা নিয়ে। হাত দিয়েছিলেন অনুবাদ সাহিত্যেও, বিশেষ করে উর্দু এবং আরবি কবিতার অনুবাদ। রচনা করেছেন ছোটদের জন্যে  তাৎপর্যপূর্ণ অনেকগুলো বই। 

জন্মেছিলেন বরিশালের বাকেরগঞ্জে জমিদার পরিবারে, ১৯৪৩ সালে। বাবা আরিফ চৌধুরী ছিলেন ১৯৪০-এর দশকে যুক্ত বঙ্গের আইন পরিষদের সদস্য। সেই সুবাদে বাবার সঙ্গে কলকাতা, ঢাকা ও বরিশাল দেখা ও বাস হয়ে গেছে শৈশবেই। দাঙ্গার আবহ দেখেছেন কলকাতায় খুব ছোটবেলায়। শহর ও গ্রাম উভয়বিধ আবহে তিনি বেড়ে উঠেছেন স্বাধীন পরিমণ্ডলে। বহুবিধ পত্রপত্রিকা ও বই পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন শৈশবেই। পরের জীবনে কবি হয়ে উঠার পেছনে এসবের একটা তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ছিল। 

পড়াশোনা করেছেন বরিশাল এবং ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬০-এর দশকে বাংলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। কর্মজীবনের নানা পর্যায়ে  শিক্ষকতা, সাংবাদিকতা এবং প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বেতার ও দূরদর্শনে অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। কাজ করেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে, জার্মান বেতারে, বাংলা একাডেমি এবং ঢাকার পত্রপত্রিকায়। 

আসাদ চৌধুরীর উচ্চারণ ও বাচনভঙ্গি ছিল  চমৎকার।  তিনি গুছিয়ে কথা বলতেন, তাঁর জীবনাচারণও ছিল গোছানো ও পরিপাটি। সঙ্গে থাকত তাঁর ঝোলানো ব্যাগ, এর ভেতরে বইতেন পানের ডিব্বা। যেখানে যেতেন এবং বসতেন পানের ডিব্বা বের করে পান সুপারির আসর জমাতেন। সকলকে আপন করে নেবার একটা ক্ষমতা তাঁর ছিল। 

তিনি পুরোটা জীবন সুস্থ ও সুন্দর সময় উদযাপনের উদাহরণ রেখে গেলেন। তিনি চলতেন নগর বাউলের মত।  কিন্তু জীবনকে তিনি ছন্নছাড়া খেই হারানো পরিণতির দিকে নিতেন না। তাঁর কথা কাজ ও লেখালেখির মধ্যে সবসময় ইতিবাচক একটা দৃষ্টিভঙ্গি তিনি ধারণ করতেন। তাঁর মধ্যে সম্মোহনী একটা ক্ষমতা ছিল। কারো মন খারাপ থাকলে তাঁর উপস্থিতিতে মন ভালো হয়ে যেতে পারতো।

১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে ১৫ অগাস্ট জাতীয় শোকদিবস উপলক্ষে 'শ্রদ্ধাঞ্জলি 'নামে  একটি স্মরণিকা প্রকাশিত হয়েছিল, ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবন থেকে। এই প্রকাশনার সম্পাদক ছিলেন শেখ রেহানা। এই সম্পাদনার অনেকটা দায়িত্ব সামলিয়েছিলেন সাংবাদিক বেবী মওদুদ। তাঁর সঙ্গে ছিলাম আমি এবং কবি আসলাম সানী। এই স্মরণিকার কাজ চলার সময়েই বেবী আপার পরামর্শে আসাদ চৌধুরীর বাসায় গিয়েছিলাম কোনো এক সন্ধ্যায়। সেই সন্ধ্যায় আসাদ চৌধুরীর স্ত্রী পিঠা আর চাসহ নানা কিছু দিয়ে খুব আপ্যায়ন করেছিলেন। আসাদ ভাই কাছে ডেকে সোফায় তাঁর পাশে বসিয়ে অনেক আলাপ করেছিলেন। এই আলাপের সময় সামনে ছিল আমাদের সদা দেখা পানের ডিব্বা। 

তিনি কবিতা উৎসবের সময় প্রায়ই উৎসব দফতরে  যেতেন। সঙ্গে থাকত পানের ডিব্বা। তিনি উপস্থিত হলে ঘরটা প্রাণবন্ত হয়ে উঠত। আসর এবং আড্ডা জমে উঠতে। জমজমাট বলতে যা বোঝায়। ছেলে মেয়ে শিশু তরুণ বয়োজ্যেষ্ঠ সকলের মাঝে তাঁর ছিল দৃষ্টিকাড়া গ্রহণযোগ্যতা। 

তিনি ছিলেন মানুষ হিসেবে মার্জিত রুচির স্থির দৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তাঁর বিচরণ ও গ্রহণযোগ্যতা ছিল নানা পথ মত বিশ্বাস ও রাজনীতির বহুবিধ বলয়ে। তাঁর বিশ্বাস ও চর্চা, ধারণ ও লালনের কেন্দ্রে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। আর অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীনতার প্রথম দিকে তরুণ বয়সে জাতির জনককে নিয়ে 'সংগ্রামী নায়ক বঙ্গবন্ধু' শিরোনামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এই বইয়ের বিষয়বস্তু ছিল বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির শুরু থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত ইতিহাসের নানা ঘটনাপ্রবাহের আলোকে ব্যক্তি শেখ মুজিবুর রহমানকে তুলে ধরা।  বইটি বাংলা একাডেমি প্রকাশ করেছিল। 

ওই সময়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত গুটিকয়েক স্বতন্ত্র গ্রন্থের মধ্যে তরুণ আসাদ চৌধুরীর এই বইটি অন্যতম। এই বইটিতে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য উপাত্ত বিবরণ নির্ভরযোগ্য। কেননা এই বইটি লেখা হয়েছিল এবং প্রকাশিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায়। ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে এই বইটির নতুন সংস্করণ প্রকাশ করেছিল বাংলা একাডেমি। একই বছর বাংলা একাডেমি একুশের গ্রন্থমেলার অনুষ্ঠানমালায় বইটির উপর একটি আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। ঘটনাক্রমে বইটির উপর আলোচনা করার জন্যে আমিও আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। আসাদ চৌধুরী দূরদেশ থেকে ঢাকায় এসেছিলেন।

আসাদ চোধুরী ছিলেন চলার পথে অবিচল এক যাত্রী। ঝড় বইবে, কারফিউ থাকবে কিন্তু আসাদ চৌধুরী অবিচল। তাঁর উপস্থিতি এমন সম্মোহনী সবাই যেন তাঁকে রাস্তা ছেড়ে দিবে। এরকম ঘটনা আমি কাছে দূরে থেকে খেয়াল করে দেখেছি নানা উপলক্ষে—বইমেলায়, বাংলা একাডেমিতে, কবিতা উৎসবে, শহীদ মিনারে। 

তাঁর লেখায় স্বতঃস্ফূর্ত সহজিয়া বৈশিষ্ট্য ছিল।  তাঁর জীবনচর্চাও ছিল সহজিয়া। তিনি কঠিনরে সহজ করে চিহ্নিত করতেন কবিতায় গল্পে এবং প্রবন্ধে। তিনি ছিলেন চলনে বলনে জীবনে ও যাপনে সহজ মানুষ, কবিতায় কঠিন পণ করা এক দৃঢ় কবি। 

প্রতিটি ভাষায় কিছু বিরল মানুষের আবির্ভাব হয় যাঁদের নামটাই সৃষ্টির সঙ্গে সমার্থক হয়ে যায়।  বাংলা ভাষায় এরকম নাম লালন ফকির, মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, আহমদ ছফা, রফিক আজাদ প্রমুখ। এই নামগুলোর সঙ্গে আর 'কবি' শব্দ যুক্ত করার দরকার পড়ে না।  নামগুলোই বলে দেয় তা এক একজন কবি বা লেখক। তেমন একটি নাম আসাদ চোধুরী। পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের ভূখণ্ডের ভেতরে যে কোনো প্রান্তের কবিতানুরাগী মানুষের বহুল চেনা প্রিয় নাম আসাদ চৌধুরী। ঠিক তেমনি দেশের বাইরে এই ভাষার মানুষ এবং এই ভাষার কবিতার খবর রাখেন অন্য ভাষার অন্যদেশের মানুষেরাও আসাদ চোধুরীকে আপন মনে করেন। 

তিনি ঢাকার লেখালেখির পরিমণ্ডল খবরের কাগজের অলিগলি ঘুরে বেড়াতেন, আড্ডা দিতেন।  এরকম ঢাকার দুয়েকটি খবরের কাগজে তাঁর আলাপচারিতা শোনার সুযোগ আমি অনেকবার পেয়েছি। তিনি কথা বলতেন দিলখোলাভাবে। স্বভাবসুলভভাবে পানের ডিব্বা খুলে পান সাজিয়ে নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে আপ্যায়ন করতেন। সবাই যেন তাঁর কাছে ভিড়ে যেত।  আমার কখনও কখনও মনে হত তিনি কি কিছুটা এস এম সুলতানের বোহেমিয়ান বৈঠকি ক্যারিশমা রপ্ত করেছিলেন? 

তিনি দেশের প্রায় সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেছিলেন। তিনি নিজেও অনেক পুরস্কার কমিটির প্রধানের দায়িত্বও পালন করেছিলেন। যতদূর জানি সেইসব পুরস্কার বাছাই ও মূল্যায়ন পর্যায়ে তিনি যথেষ্ট ন্যায়ানুগ ভূমিকা রাখার চেষ্টা করতেন। তিনি সময় এবং সত্য ও সুন্দরের স্বার্থে সকলকে নিয়ে চলার পক্ষে ছিলেন। তাই তিনি চলার পথে সকলের শুভাশিস পেতেন। সকলেই তাঁকে সমীহ করত। 

তিনি ছোট বড় সকলের লেখালেখির খবর রাখতেন। খোঁজ নিতেন। তিনি উৎসাহ আর উদ্দীপনা সঙ্গে করে নিয়ে চলতেন। তিনি ছিলেন অফুরান অনুপ্রেরণার এক ঠিকানা। তাই তো সব বয়সের মানুষেরা তাঁকে ঘিরে থাকত। একাকী হবার বা একাকিত্বে বন্দী হবার সুযোগ আসাদ চৌধুরীর ছিল না। 

চিত্রকলার প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল ব্যাপক। তিনি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পিকাসো , জয়নুল আবেদিনকে নিয়ে আলাদা আলাদা বই লিখেছেন। তিনি লিখেছেন রাজনীতিবিদ আবুল হাশিম, ফরাসি জাতীয় বীর জুয়ান অব আর্ককে নিয়ে। তিনি লিখেছেন নৃত্যকলার গুরু বুলবুল চৌধুরীর জীবনী। 

তাঁর লেখাজোখায় রয়েছে ইতিহাস, জীবন ও সময়ের ছাপ। তিনি সহজ এবং কঠিন সত্য সহজ করেই বলেছেন তাঁর গদ্য-পদ্যে। 

শেষ জীবনে তিনি ছেলে এবং মেয়ের কাছে থাকার জন্যে দূরদেশের বাসিন্দা হয়েছিলেন ঠিকই।  কিন্তু দেশের ঘটনাপ্রবাহ এবং লেখালেখি অঙ্গনে তাঁর উপস্থিতি ছিল সরব।  কাউকে না জানালে তার পক্ষে বোঝা সহজ ছিল না, আসাদ চৌধুরী দেশের বাইরে দূরদেশের অধিবাসী। 

লেখালেখি অঙ্গনে ঢাকার বাইরে মফস্বল এবং গ্রাম পর্যন্ত তাঁর যোগাযোগের পরিধি ছিল।  সকলেই যেমন তাঁকে আপন মনে করতো, তিনিও তেমনি সকলকে আপন করে নিতে পারতেন। এ এক অসাধারণ গুণ তাঁর ছিল।  তিনি সময় জীবন এবং মাতৃভূমিকে তাঁর কবিতায় ধারণ করতে পেরেছিলেন।  এখানে তাঁর একটি কবিতা তুলে ধরছি, কবিতাটির শিরোনাম ‘তখন সত্যি মানুষ ছিলাম’ 

নদীর জলে আগুন ছিলো 

আগুন ছিলো বৃষ্টিতে 

আগুন ছিলো বীরাঙ্গনার 

উদাস-করা দৃষ্টিতে।

আগুন ছিলো গানের সুরে

আগুন ছিলো কাব্যে, 

মরার চোখে আগুন ছিলো 

এ-কথা কে ভাববে?

কুকুর-বেড়াল থাবা হাঁকায়

 ফোসে সাপের ফণা

 শিং কৈ মাছ রুখে দাঁড়ায়

 জ্বলে বালির কণা।

আগুন ছিলো মুক্তি সেনার 

স্বপ্ন-ঢলের বন্যায়— 

প্রতিবাদের প্রবল ঝড়ে 

কাঁপছিলো সব-অন্যায়।

এখন এ-সব স্বপ্নকথা 

দূরের শোনা গল্প, 

তখন সত্যি মানুষ ছিলাম 

এখন আছি অল্প।

তিনি এভাবে জীবন সময় ও স্বদেশের সত্য উচ্চারণ করে গেছেন। তিনি সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডেও সরব  উপস্থিতি রেখে গেছেন। কিছু মানুষের, কিছু প্রতিভার কিছু মেধার আবির্ভাব হয় যুগে যুগে, কালে কালে, দেশে দেশে, যার কোনো বিকল্প তাঁদের জীবদ্দশাতে খুঁজে পাওয়া যায় না;  তাঁরা চলে যাবার পরও ওরকম একজন মানুষের জায়গা পূরণ করে এরকম বিকল্প কারো আবির্ভাবও প্রায় অসম্ভব রকম ঘটনা। আসাদ চৌধুরী ছিলেন এরকম বিরল একজন মানুষ। আর এই বিরল বৈশিষ্ট্যের কারণে ঢাকার কাব্যপরিমণ্ডলের ইতিহাসে তিনি স্থায়ী একটি জায়গা অধিকার করে থাকবেন।